‘সিল মারো ভাই সিল মারো, নৌকা মার্কায় মারো’

ব্রাহ্মণবাড়িয়া-২ আসনের উপনির্বাচনে প্রকাশ্যে নৌকা প্রতীকে সিল মারার একটি ভিডিও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়েছে। ভিডিওর স্ক্রিনশট
ছবি: ভিডিও থেকে সংগৃহীত

ব্রাহ্মণবাড়িয়া-২ (সরাইল-আশুগঞ্জ) আসনের উপনির্বাচনে প্রকাশ্যে নৌকা প্রতীকে সিল মারার একটি ভিডিও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে ছড়িয়ে পড়েছে। ২ মিনিট ২৩ সেকেন্ডের ওই ভিডিওতে নৌকা প্রতীকে সিল মারার সময় এক যুবককে বলতে শোনা যায়, ‘সিল মারো ভাই সিল মারো, নৌকা মার্কায় মারো।’

ভিডিওর প্রথম ১০ সেকেন্ডে দেখা যায়, ওই কেন্দ্রের একজন নারী সহকারী প্রিসাইডিং কর্মকর্তার সামনে দাঁড়িয়ে আছেন তিনজন। সহকারী প্রিসাইডিং কর্মকর্তা তাঁদের একের পর এক ব্যালট ছিঁড়ে দিচ্ছেন। একজন যুবক ব্যালটে বৃদ্ধাঙ্গুলির ছাপ দিয়ে নৌকা প্রতীকে সিল মারছেন। পাশে থাকা আরেক যুবক ব্যালট ভাঁজ করছেন।

ভিডিওর ১১ সেকেন্ড থেকে আরেকটি বুথের চিত্র দেখা যায়। সেখানে সহকারী প্রিসাইডিং কর্মকর্তার দায়িত্বে আছেন আরেক নারী। তিনি হাসতে হাসতে ব্যালট পেপারের পেছনে স্বাক্ষর করছেন। তাঁর সামনে তখন পাঁচ-ছয়জন যুবক। ব্যালটে সিলের কালি হয়নি এক যুবকের কথার পরিপ্রেক্ষিতে সহকারী প্রিসাইডিং কর্মকর্তা বলেন, ‘আরে কালি হইছে।’ ওই কর্মকর্তার পাশে থাকা এক যুবকের গলায় নৌকা প্রতীকের প্রার্থী শাহজাহান আলমের ছবি-সংবলিত কার্ড ঝুলছিল। কর্মকর্তা স্বাক্ষর শেষে একে একে ব্যালট ছিঁড়ে দিচ্ছেন। আর তাঁরা প্রকাশ্যে একের পর এক ব্যালটে নৌকায় সিল মারেন। তখন এক যুবককে বলতে শোনা যায়, ‘সিল মারো ভাই সিল মারো।’ আরেক যুবক বলেন, ‘নৌকা মার্কায় মারো।’

সহকারী প্রিসাইডিং কর্মকর্তার উদ্দেশে নৌকা প্রতীকের আরেক সমর্থক বলেন, ‘আরে আপনে ছিঁড়েন না। ৮-১০টা ছেঁড়া লইন না। ছেঁড়া দিয়া দেন। মাইরা দিই। এরপর আপনি লেখেন, আস্তে আস্তে। আপনি ছিঁড়েন ১০-২০টা। আমরা সিল মারি।’ এ সময় একজন বলেন, ‘আরে আমি দিমু, ঠাস ঠাস ঠাস।’ আরেকজন বলেন, ‘আস্তে আস্তে।’

ভিডিওর এ পর্যায়ে আবার শুরুর দিকের নারী সহকারী সহকারী প্রিসাইডিং কর্মকর্তার বুথের চিত্র দেখা যায়। এ সময় ওই সহকারী প্রিসাইডিং কর্মকর্তার সঙ্গে আরেকজন নারী পোলিং এজেন্ট সহায়তা করেন। তাঁরা ব্যালট পেপার ছিঁড়ে দিচ্ছেন। নৌকার সমর্থকেরা ব্যালটে প্রকাশ্যে সিল মারছেন। নারী সহকারী প্রিসাইডিং কর্মকর্তা ভোটার নম্বর ২৩৯ কি না জানতে চাইলে নৌকার সমর্থকেরা বলেন, ‘না ১৩৯।’

ফেসবুকে ছড়িয়ে পড়া ভিডিওটি নিয়ে স্বতন্ত্র প্রার্থী জিয়াউল হক মৃধা সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলেছেন। তাঁর দাবি, ভিডিওটি আশুগঞ্জ উপজেলার শরীফপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় ভোটকেন্দ্রের দুটি বুথের।

আজ বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় ওই কেন্দ্রের প্রিসাইডিং কর্মকর্তা মোহাম্মদ শফিউল্লাহকে হোয়াটসঅ্যাপে দুটি বুথের বোরকা পরিহিত নারী সহকারী প্রিসাইডিং কর্মকর্তা এবং শাড়ি-চশমা পরিহিত আরেক নারী সহকারী প্রিসাইডিং কর্মকর্তার ছবি পাঠানো হয়। শাড়ি-চশমা পরিহিত নারী তাঁর কেন্দ্রের সহকারী প্রিসাইডিং কর্মকর্তা ছিলেন বলে তিনি প্রথম আলোকে নিশ্চিত করেন। তবে অন্যজনের ছবি স্পষ্ট না হওয়ায় নিশ্চিত করতে পারেননি তিনি।

মোহাম্মদ শফিউল্লাহ প্রথম আলোকে বলেন, প্রত্যন্ত অঞ্চলে ছিল কেন্দ্রটি। ১০টি বুথে ১০ জন সহকারী প্রিসাইডিং কর্মকর্তা ও ২০ জন পোলিং এজেন্ট ছিলেন। কেন্দ্রে একটু ঝামেলা হয়েছিল। দুজন নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট এসেছিলেন। তবে প্রকাশ্যে সিল মারা ও ভিডিও ছড়িয়ে পড়ার ঘটনা তাঁর জানা নেই বলে তিনি দাবি করেন।

উপনির্বাচনের সহকারী রিটার্নিং কর্মকর্তা ও আশুগঞ্জ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) শ্যামল বশাক প্রথম আলোকে বলেন, ‘ভিডিওর প্রসঙ্গে আমি আগে শুনিনি। মাত্রই আপনার কাছে শুনলাম।’

স্বতন্ত্র প্রার্থী জিয়াউল হক মৃধা বলেন, ‘ওই কেন্দ্রের ভিডিও আমার হাতে এসেছে। আশুগঞ্জের প্রতিটি ভোটকেন্দ্রেই ভোট কারচুপি হয়েছে। কোনো কেন্দ্রেই ভোটার ছিল না। কিন্তু ফলাফলে ভোটার দেখানো হয়েছে। যাঁদের ছত্রচ্ছায়ায় অপকর্মগুলো হয়েছে, তাঁদের হাতেই তদন্তের দায়ভার দেওয়া হয়েছে। এ তদন্ত কমিটির প্রতি অনাস্থা জানাই। এটি প্রশ্নবিদ্ধ তদন্ত হবে।’

জানতে চাইলে নৌকার প্রার্থী অধ্যক্ষ শাহজাহান আলম প্রথম আলোকে বলেন, ‘এমন হওয়ার কথা নয়। কর্মী-সমর্থকদের প্রতি নির্দেশনা ছিল ভোটকেন্দ্রে এমন কিছু করা যাবে না, যাতে দল বিতর্কিত হয়। তাঁরা আমার কর্মী-সমর্থক ছিল কি না বা অন্য কেউ গলায় আমার কার্ড ঝুলিয়ে গিয়েছে কি না, আমার জানা নেই।’

গত রোববার ব্রাহ্মণবাড়িয়া-২ আসনের উপনির্বাচনে ভোট গ্রহণ করা হয়। রিটার্নিং কর্মকর্তা ইতিমধ্যে ভোটের ফলও প্রকাশ করেছেন। তবে ভোটের দিন কয়েকটি ভোটকেন্দ্রে প্রকাশ্যে সিল মারার অভিযোগ ওঠে। এ নিয়ে বিভিন্ন গণমাধ্যমে প্রতিবেদনও প্রকাশিত হয়। এর পরিপ্রেক্ষিতে সংশ্লিষ্ট জেলা প্রশাসক, পুলিশ সুপার ও জেলা নির্বাচন কর্মকর্তাকে অনিয়মের অভিযোগ তদন্ত করার নির্দেশ দেয় নির্বাচন কমিশন। পাশাপাশি ফলাফলের গেজেট প্রকাশ স্থগিত রাখার কথা জানায়। গতকাল বুধবার দিনভর আশুগঞ্জ উপজেলা পরিষদের সম্মেলনকক্ষে ভোট-সংশ্লিষ্ট ৯০ জনের বক্তব্য শোনে পৃথক দুই তদন্ত কমিটি।