পাহাড়ের বর্ষবিদায় ও বরণের উৎসব আর কদিন পরই। এ উৎসবের অপরিহার্য অনুষঙ্গ হলো পাজন। ৩০ থেকে ৫০ পদের সবজি দিয়ে রান্না করা হয় এই বিশেষ খাবার। কার পাজনে কত পদের তরকারি থাকল, সেটাও একটা আলোচনার বিষয় বটে। উৎসবের দিন ঐতিহ্যবাহী এই খাবার দিয়ে অতিথি আপ্যায়ন করা হয়।
পার্বত্য চট্টগ্রামে ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর উৎসব বিজু, সাংগ্রাই, বৈসুক, বিষু, বিহু ও চাক্রানের অন্যতম অনুষঙ্গ পাজন। উৎসবকে সামনে রেখে এবার রাঙামাটিতে হলো পাজন রান্নার প্রতিযোগিতা।
পার্বত্য চট্টগ্রামের রাঙামাটিতে ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী সাংস্কৃতিক ইনস্টিটিউটের আয়োজনে মেলা চলছে। ৩ এপ্রিল থেকে শুরু হওয়া এই মেলার শেষ দিন আজ শুক্রবার। বর্ষবিদায় ও বর্ষবরণের মূল উৎসব হবে ১২ এপ্রিল থেকে ১৪ এপ্রিল। এর আগেই চাকমাদের উৎসব বিজু, মারমাদের সাংগ্রাই, ত্রিপুরাদের বৈসুক, তঞ্চঙ্গ্যাদের বিষু, অহমিয়াদের বিহু এবং চাকদের উৎসব চাক্রান উপলক্ষে মেলার আয়োজন করা হয়েছে। মেলায় অন্তত ৪০টি দোকানে পাজন বিক্রি হচ্ছে। আর মেলার অন্যতম আকর্ষণ হিসেবে আয়োজন করা হয় পাজন রান্নার প্রতিযোগিতার। এতে অংশ নেয় ছয়টি দল।
পাজন রান্নার ঐতিহ্য কয়েক শ বছরের। পাহাড়ে বসবাস করা সব সম্প্রদায়ই এটি রান্না করে। তবে সম্প্রদায় ভেদে এর নাম আলাদা।
পাজন রান্না প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করেন দোলন ত্রিপুরা। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমরা আনন্দের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় অংশ নিয়েছি। চারজন মিলে রান্না করেছি। গত বছরও এই প্রতিযোগিতায় অংশ নিয়েছিলাম। আমি ৩৫ প্রকার সবজি দিয়ে পাজন রান্না করেছি।’
বিজু, সাংগ্রাই, বৈসুক, বিষু ও বিহু উৎসবের দু-এক দিন আগেই হাট-বাজার থেকে সবজি সংগ্রহ করেন তাঁরা। উৎসবের দিন অতিথিদের আপ্যায়নের মূল আকর্ষণ এই পাজন। পাহাড়িরা বিশ্বাস করেন, সাতটি বাড়ি ঘুরে পাজন খেলে রোগ-ব্যাধি উপশম হয়। এটি পাহাড়িদের কাছে বেশ জনপ্রিয়। ঐতিহ্যবাহী সবজি হওয়ায় এখন মেলা ও বিভিন্ন উৎসবে পাজন রান্নার প্রতিযোগিতা হয়।
পাহাড়ি সংস্কৃতি গবেষক ও শিক্ষাবিদ মং সা নু চৌধুরীর মতে, পাজন রান্না ও খাওয়ার প্রচলন কয়েক শ বছর আগের। পাজন শব্দটি মূলত চাকমারা ব্যবহার করেন। ভিন্ন ভিন্ন জাতিসত্তার মানুষেরা ভিন্ন ভাষায় ডাকেন ‘পাজন’কে। যে ভাষায়ই ডাকা হোক, বিষয়টি একই। নানা ধরনের সবজি মিলিয়ে তৈরি একটি তরকারি। আর বর্ষবিদায় এ বর্ষবরণে এটি অপরিহার্য।
অধ্যাপক মং সা নু বলেন, পাহাড়িদের বিশ্বাস পাজন খেলে শারীরিকভাবে সুস্থ ও রোগব্যাধিমুক্ত থাকা যায়। বন ও খেতের সবজি মিলে পাজন রান্না করা হয়।
পাহাড়ের এই উৎসবের নাম যেমন জাতি ভেদে ভিন্ন, তেমনি ভিন্ন পাজনেরও নাম। অধ্যাপক মং সানু জানান, মারমা জাতিসত্তার মানুষেরা পাজনকে ‘হাং–র’ বলেন।
ত্রিপুরা ভাষায় পাজনকে বলা হয় ‘মৈজারবং’। এ তথ্য জানান সজীব ত্রিপুরা। তিনি রাঙামাটি বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের কম্পিউটার সায়েন্স ও ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের সহকারী অধ্যাপক। এ ছাড়া ত্রিপুরাদের ককবরক ভাষার একটি অভিধানও লিখেছেন। সজীব ত্রিপুরা বলেন, মৈ শব্দের অর্থ তরকারি। আর জারবং শব্দের অর্থ মিশ্রণ। নানা ধরনের তরকারির মিশ্রণে তৈরি হয় বলে এ তরকারির নাম এমন।
চাক ভাষায় পাজনকে ‘কাইনবোং’ নামে ডাকা হয় বলে জানান নাইক্ষ্যংছড়ির বাসিন্দা পাই থুই চাক।
রাঙামাটি ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী সাংস্কৃতিক ইনস্টিটিউটের বিজু, সাংগ্রাই, বৈসুক, চাক্রান, বিষু ও বিহু মেলা পরিচালনা কমিটির সদস্য বিজ্ঞান্তর তালুকদার বলেন, গতকাল বৃহস্পতিবার মেলার ষষ্ঠ দিনে বিশিষ্টজনদের স্মৃতিচারণ, নাটক ও বিভিন্ন খেলাধুলার পাশাপাশি মূল আকর্ষণ ছিল পাজন রান্নার প্রতিযোগিতা। এ বছর ছয়টি দল প্রতিযোগিতায় অংশ নেয়।
১২ এপ্রিল পাহাড়িদের প্রধান সামাজিক উৎসব বিজু, সাংগ্রাই, বৈসুক, বিষু, বিহু ও চাক্রান উৎসব শুরু হবে। ওই দিন চাকমা সম্প্রদায়ের নদীতে ফুল ভাসানোর মধ্য দিয়ে উৎসব শুরু হবে। পরদিন পাজনসহ অন্যান্য খাবার দিয়ে অতিথি আপ্যায়ন করা হবে। তৃতীয় দিন বিভিন্ন ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানে পূজা-অর্চনা হবে। সম্প্রদায় ভেদে পাঁচ দিন কিংবা এক সপ্তাহ ধরে চলবে এই উৎসব। ইতিমধ্যে পাহাড়ের বিভিন্ন গ্রামে উৎসবের আমেজ ছড়িয়ে পড়েছে।