করতোয়ায় নৌকাডুবি

অপেক্ষার প্রহর শেষ হচ্ছে না নিখোঁজ তিনজনের স্বজনদের

নৌকাডুবির পর করতোয়া নদীর দুই পাড়ে স্থানীয় লোকজনের ভিড়
ফাইল ছবি

মহালয়ার অনুষ্ঠানে যোগ দিতে দুই মেয়েসহ ছয় স্বজনের সঙ্গে নদী পার হচ্ছিলেন সরেন্দ্র নাথ বর্মণ (৬৫)। নৌকায় ভিড় থাকায় সবাই ছিলেন কাছাকাছি। মাঝনদীতে নৌকা তলিয়ে যাওয়ার পর সাঁতরে তীরে আসেন বিনয় চন্দ্র বর্মণ (৪২) নামের তাঁদের এক স্বজন। কিন্তু হারিয়ে যান অন্য ছয়জন।

এরপর একে একে দুই মেয়েসহ পাঁচজনের লাশ উদ্ধার হলেও সরেন্দ্র নাথের খোঁজ মেলেনি এখনো। অন্য স্বজনদের দাহ-শ্রাদ্ধ শেষ হলেও বাবার জন্য অপেক্ষার প্রহর শেষ হচ্ছে না সরেন্দ্রের সন্তানদের। তাঁরা বাবাকে জীবিত বা মৃত অবস্থায় খুঁজে পেতে চান।

নৌকাডুবিতে নিখোঁজ তিনজন হলেন পঞ্চগড় সদর উপজেলার ঘাটিয়ারপাড়া এলাকার শিশু জয়া রানী (৪), দেবীগঞ্জ উপজেলার হাতিডোবা-ছত্রশিকারপুর এলাকার ভূপেন্দ্র নাথ বর্মণ (৪২) ও বোদা উপজেলার ডাঙ্গাপাড়া-কলেজপাড়া এলাকার সরেন্দ্র নাথ বর্মণ (৬৫)।

সরেন্দ্র নাথের স্বজনদের মতো পঞ্চগড়ের বোদা উপজেলার মাড়েয়া বামনহাট ইউনিয়নের করতোয়া নদীর আউলিয়ার ঘাটে নৌকাডুবির ঘটনায় নিখোঁজ তিনজনের পরিবারে শোকের সঙ্গে চলছে অপেক্ষার পালা। ঘটনার ১৩ দিনেও খোঁজ মেলেনি ৩ জনের। কেউ আদরের সন্তানের জন্য আবার কেউ শেষবারের মতো বাবার মুখটি দেখার অপেক্ষা করছেন।

জেলা প্রশাসনের তথ্য অনুযায়ী, নৌকাডুবিতে নিখোঁজ ওই তিনজন হলেন পঞ্চগড় সদর উপজেলার ঘাটিয়ারপাড়া এলাকার শিশু জয়া রানী (৪), দেবীগঞ্জ উপজেলার হাতিডোবা-ছত্রশিকারপুর এলাকার ভূপেন্দ্র নাথ বর্মণ (৪২) ও বোদা উপজেলার ডাঙ্গাপাড়া-কলেজপাড়া এলাকার সরেন্দ্র নাথ বর্মণ (৬৫)।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ঘটনার দিন দুই মেয়ে নিয়ে বাবার বাড়ির লোকজনের সঙ্গে নদী পার হচ্ছিলেন আলোশ্বরী রানী (২৪)। নৌকায় মানুষের ভিড়ে ছোট মেয়ে জ্যোতি রানীকে (২) নিজের কোলে রেখে বড় মেয়ে জয়া রানীকে (৪) দিয়েছিলেন নানির কোলে। মাঝনদীতে নৌকা ডুবে গেলে মা ও নানির কোল থেকে জ্যোতি ও জয়া পানিতে পড়ে যায়। উদ্ধারকারীদের মাধ্যমে আলোশ্বরী পাড়ে উঠতে পারলেও হারিয়ে যায় তাঁর দুই মেয়ে, মা, বোন ও কাকি। ঘটনার পর জ্যোতিসহ অন্য ব্যক্তিদের লাশ উদ্ধার হলেও এখনো জয়াকে খুঁজে পাওয়া যায়নি।

অন্যদিকে স্ত্রী রূপালী রানী (৩৬) ও তিন বছর বয়সী ছেলে দীপুকে নিয়ে নদী পার হচ্ছিলেন ভূপেন্দ্র নাথ বর্মণ (৪২)। নৌকাডুবির পর শিশু দীপু উদ্ধার হলেও নদীতে হারিয়ে যান ভূপেন-রূপালী দম্পতি। পরের দিন রূপালীর লাশ উদ্ধার হলেও ভূপেন্দ্র এখনো নিখোঁজ।

জয়ার বড় ভাই (বাবার প্রথম স্ত্রীর ছেলে) শান্ত রায় প্রথম আলোকে বলেন, ছোট্ট দুই মেয়েকে চোখের সামনে হারিয়েছেন মা। এর মধ্যে একজনের লাশ পাওয়া গেলেও জয়াকে খুঁজে পাওয়া যায়নি। তাঁদের জন্য মা এখন শয্যাশায়ী। মাকে মাঝেমধ্যে স্যালাইন দিতে হচ্ছে।

নিখোঁজ সরেন্দ্র নাথের ছেলে তপন চন্দ্র বর্মণ বলেন, ‘নৌকাডুবির ঘটনায় মারা যাওয়া আমার বড় দুই বোন, এক ভগ্নিপতিসহ পাঁচজনের লাশ দাহ করেছি, শ্রাদ্ধও শেষ হয়েছে। কিন্তু তাঁদের সঙ্গে থাকা আমার বাবার খোঁজ আজও পাইনি। ১৩ দিন ধরে আমরা বাবার জন্য অপেক্ষায় আছি। পুলিশ, ফায়ার সার্ভিস কেউই বাবার খবর দিতে পারছে না। প্রতিদিন নদীতে বাবাকে খুঁজতে যাই, কিন্তু পাই না। বাবাকে খুঁজে পেতে নদীতে গঙ্গাপূজাও করছি।’

এর আগে ঘটনার চতুর্থ দিন ২৮ সেপ্টেম্বর বিকেলে সর্বশেষ এক ব্যক্তির লাশ উদ্ধার করা হয়। দুর্ঘটনায় এখন পর্যন্ত ৬৯ জনের লাশ উদ্ধার করা হয়েছে। এর আগে গত সোমবার ভোরে রংপুর, কুড়িগ্রাম ও রাজশাহী থেকে আসা ফায়ার সার্ভিসের ডুবুরিরা উদ্ধারকাজ বন্ধ করে নিজ নিজ ইউনিটে ফিরে গেছেন। পরে পঞ্চগড় ও দেবীগঞ্জ ইউনিটের সদস্যরা ফিরে যান। বর্তমানে স্থানীয়ভাবে বোদা ফায়ার সার্ভিসের একটি দল ঘটনাস্থল ও আশপাশ এলাকায় টহল দিচ্ছে।

বোদা ফায়ার সার্ভিসের ভারপ্রাপ্ত স্টেশন কর্মকর্তা মো. শাহজাহান আলী আজ বিকেলে প্রথম আলোকে বলেন, নৌকাডুবির ঘটনার ১৩ দিনে এসেও নিখোঁজ ৩ জনের সন্ধান পাওয়া যায়নি। এখন শুধু বোদা ইউনিটের একটি টহল দল মাঝেমধ্যে ঘটনাস্থল ও আশপাশ এলাকায় টহল দিচ্ছে।

গত ২৫ সেপ্টেম্বর দুপুরে করতোয়া নদীর আউলিয়া ঘাট থেকে শতাধিক মানুষ নিয়ে শ্যালো ইঞ্জিনচালিত একটি নৌকা বড়শশী ইউনিয়নের বদেশ্বরী মন্দিরের দিকে যাচ্ছিল। যাত্রীদের অধিকাংশই বদেশ্বরী মন্দিরে মহালয়ার অনুষ্ঠানে যোগ দিতে যাচ্ছিলেন। ঘাট থেকে কিছু দূর যাওয়ার পর নৌকাটি ডুবে যায়।