দেশের প্রথম অত্যাধুনিক গ্রিনহাউস গ্যাস নির্গমন নিরূপণ ল্যাব স্থাপন করা হলো বরিশালে। বরিশাল নগরের সাগরদী এলাকায় বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউটের (ব্রি) আঞ্চলিক কার্যালয়ের ধানের জাত গবেষণা প্লটে গতকাল বুধবার দুপুরে এই ডিজিটাল ল্যাব স্থাপন করা হয়।
ব্রির বিজ্ঞানীরা বলছেন, এই ল্যাব ২৪ ঘণ্টা স্বয়ংক্রিয়ভাবে ধানের খেত থেকে কতটুকু গ্রিন হাউস গ্যাস নির্গমন করে, তার তথ্য সংগ্রহ করবে এবং নিজে নিজেই সেসব তথ্য বিশ্লেষণ করবে। আগে ব্রির বিজ্ঞানীরা ম্যানুয়াল–পদ্ধতিতে সাত দিন অন্তর এই তথ্য সংগ্রহ করে পর্যালোচনা করতেন।
২০২১ সালে নিউইয়র্কভিত্তিক আন্তর্জাতিক সংবাদ সংস্থা ব্লুমবার্গের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছিল, বাংলাদেশের বিভিন্ন উৎস থেকে ‘রহস্যময়’ মিথেন গ্যাসের বিশাল কুণ্ডলী বায়ুমণ্ডলে নির্গত হচ্ছে। প্রতিবেদনে দাবি করা হয়েছিল, বাংলাদেশ বিশ্বের ১২তম বৃহত্তম মিথেন গ্যাসের উৎসে পরিণত হয়েছে। প্রতিবেদনে এই গ্যাস নিঃসরণের উৎস হিসেবে তিনটি ক্ষেত্রের কথা উল্লেখ করা হয়েছিল। এর অন্যতম ছিল ধান উৎপাদনের খেত। দেশের কৃষিবিজ্ঞানীরা ওই প্রতিবেদনকে উদ্দেশ্যমূলক ও অন্যায্য বলে অভিহিত করেছিলেন।
২০১২ সাল থেকে এই বিষয় নিয়ে কাজ করছেন ব্রির গাজীপুর প্রধান কার্যালয়ের মৃত্তিকা বিজ্ঞান বিভাগের ঊর্ধ্বতন বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা এস এম মফিজুল ইসলাম। তাঁর গবেষণার বিষয় ছিল ‘পরিবেশ সহায়ক প্রযুক্তি উদ্ভাবন’। এই কাজের জন্য তিনি ২০২২ সালে জাতীয় পরিবেশ পদক পেয়েছিলেন।
এস এম মফিজুল ইসলাম আজ বৃহস্পতিবার দুপুরে প্রথম আলোকে বলেন, ‘ব্লুমবার্গের ওই প্রতিবেদনের তথ্য নিয়ে আমাদের দ্বিমত রয়েছে। আমার কাছে মনে হয়েছে, এটা উদ্দেশ্যমূলক। কারণ, বাংলাদেশ একটি ছোট দেশ। সেখানে চীন, ভিয়েতনাম আয়তনে আমাদের চেয়ে বড়। সেখানে কৃষিক্ষেত্রও আমাদের চেয়ে অবারিত। এ জন্য বাংলাদেশের ধান উৎপাদন খেত গ্রিনহাউস গ্যাস নির্গমনের জন্য অন্যতম দেশ হতে পারে না।’
মফিজুল ইসলাম বলেন, ‘এত দিন আমাদের এ–সংক্রান্ত ডেটা সংগ্রহ ও অ্যানালাইসিস করার আধুনিক কোনো প্রযুক্তি ছিল না। তাই আমরা ব্লুমবার্গের ওই তথ্যকে চ্যালেঞ্জ করতে পারিনি। এখন অত্যাধুনিক এই ল্যাব স্থাপনের ফলে এখন আমরা সারা বছরের তথ্য-উপাত্ত এবং তার পর্যালোচনা করতে পারব।’
গতকাল ব্রির গবেষণা প্লটে গ্রিনহাউস গ্যাস নির্গমন নিরূপণ ল্যাবটি উদ্বোধন করেন ব্রির মহাপরিচালক মোহাম্মাদ খালেকুজ্জামান। অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন ব্রির আঞ্চলিক কার্যালয়ের প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা মুহম্মাদ আশিক ইকবাল খান। বিশেষ অতিথি ছিলেন কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের অতিরিক্ত পরিচালক মো. রফিকুল ইসলাম এবং ব্রির মৃত্তিকাবিজ্ঞান বিভাগের মুখ্য বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা মো. রফিকুল ইসলাম।
২০২১ সালে ব্লুমবার্গের ওই প্রতিবেদনে দেখা যায়, ইউরোপীয় মহাকাশ সংস্থার (ইএসএ) স্যাটেলাইটের তথ্য বিশ্লেষণ করে প্রতিবেদনটি তৈরি করা হয়েছিল। এতে ধানখেত, পয়োনিষ্কাশন ও প্রাকৃতিক গ্যাস সরবরাহের পাইপলাইনে ফাটল বা গর্ত দেশে মিথেন নির্গমনের প্রধান কারণ হতে পারে বলে উল্লেখ করা হয়েছিল। ব্রির বিজ্ঞানীরা বলছেন, বাংলাদেশ আয়তনে ছোট একটি দেশ। তাই বিভিন্ন জলবায়ুগত উপাদানের কারণে এই মিথেন গ্যাস অন্যান্য দেশ থেকে এ দেশের পরিবেশে সংশ্লেষ ঘটতে পারে।
মৃত্তিকাবিজ্ঞানী এস এম মফিজুল ইসলাম এ বিষয়ে বলেন, ‘আমাদের দেশে ধানসহ প্রায় ৫০ ধরনের ফসল ফলানো হয়। এগুলোর মধ্যে অর্ধেক ফসলই শাকসবজি ও অন্যান্য। তিনি বলেন, অনেক ধানখেতে জলাবদ্ধ করে সেচ দেওয়া হয়, তবে মৌসুমের মাঝামাঝি তা শুকিয়ে যাওয়া, ভেজা, আবার শুকিয়ে যাওয়ার যে প্রক্রিয়া, তার ফলস্বরূপ মিথেন নির্গমন হ্রাস পায়। কৃষি বিজ্ঞানের পরিভাষায় একে “অলটারনেট ওয়েটিং অ্যান্ড ড্রাইং (এডব্লিউডি)” বা ভেজা ও শুকানোর পর্যায়ক্রমিক পদ্ধতি বলা হয়। এই পদ্ধতি অনুসরণ করে মিথেন নির্গমনের বিষয়ে ব্রি গবেষণা কার্যক্রম পরিচালনা করেছে। এই গবেষণায় দেখা গেছে, এতে কার্বন নিঃসরণের পরিমাণ কমে। কারণ, এতে উচ্চতর রেডক্স পটেনশিয়াল উচ্চতর বিয়োজন ক্ষমতা বজায় থাকার কারণে খুব কম মিথেন নির্গমনের হার প্রমাণিত হয়েছে।
ব্রির বিজ্ঞানীরা বলছেন, যুক্তরাষ্ট্রের আন্তর্জাতিক উন্নয়ন সংস্থার (ইউএসএআইডি) ও আন্তর্জাতিক সার উন্নয়ন কেন্দ্রের (আইএফডিসি) সহায়তায় প্রায় দুই কোটি টাকা ব্যয়ে এই ল্যাব স্থাপন করা হয়েছে। ভ্রাম্যমাণ এই ল্যাব বরিশালে এক বছর তথ্য সংগ্রহের পর অন্য এলাকায় স্থানান্তর করা হবে। এভাবে ল্যাবটি সারা দেশের বেশ কয়েকটি স্থানের তথ্য সংগ্রহ করে তা বিশ্লেষণ করে গ্রিন হাউস গ্যাস নির্গমনে ধানখেত কতটা ভূমিকা রাখে, তার বৈজ্ঞানিক ফলাফল নিরূপণ করা সম্ভব হবে। আর এই গবেষণালব্ধ ফলাফলের তথ্য দিয়ে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে বিষয়টিকে চ্যালেঞ্জ করা সম্ভব হবে।
ব্রি গাজীপুরের সেচ ও পানি ব্যবস্থাপনা বিভাগের জ্যেষ্ঠ বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা প্রিয় লাল চন্দ্র পাল প্রথম আলোকে বলেন, আমাদের গবেষণাক্ষেত্রে একটি অভূতপূর্ব সুযোগ এনে দিয়েছে। বাংলাদেশকে গ্রিন হাউস নির্গমনের জন্য গুরুত্বপূর্ণ দেশ হিসেবে চিহ্নিত করার যে প্রয়াস বা অপপ্রয়াস, সেটি চ্যালেঞ্জ করার জন্য প্রয়োজনীয় তথ্য-উপাত্ত হাতে পাওয়ার অবারিত সুযোগ করে দেবে।