শরীয়তপুরে দুই পুলিশ কর্মকর্তার বিরুদ্ধে পদক্ষেপ নিতে এসপিকে আদালতের নির্দেশ

নির্যাতনের ক্ষতচিহ্ন দেখাচ্ছেন ছিনতাই মামলায় গ্রেপ্তার হওয়া সাদ্দাম চোকদার
ছবি: প্রথম আলো

শরীয়তপুরের নড়িয়া সার্কেলের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার রাসেল মনির ও সদ্য বদলি হওয়া পদ্মা সেতু দক্ষিণ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) শেখ মোহাম্মদ মোস্তাফিজুর রহমানের বিরুদ্ধে আইনগত পদক্ষেপ নিতে জেলা পুলিশ সুপারকে (এসপি) নির্দেশ দিয়েছেন আদালত।

জাজিরার পদ্মা সেতু দক্ষিণ থানার একটি মারামারি ও ছিনতাই মামলার চার আসামিকে মারধর করে আহত করার ঘটনায় শরীয়তপুরের সিনিয়র জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আল ইমরান ৭ জুন এই আদেশে স্বাক্ষর করেন।

আজ রোববার আদালত পরিদর্শকের কার্যালয় থেকে ওই আদেশের কপি পুলিশ সুপারের কার্যালয়ে পাঠানো হয়েছে। আগামী ৯ জুলাইয়ের মধ্যে ‘নির্যাতন এবং হেফাজতে মৃত্যু নিবারণ আইন, ২০১৩’-এর ৫ ধারা অনুযায়ী ওই দুই পুলিশ কর্মকর্তার বিরুদ্ধে আইনগত পদক্ষেপ নিয়ে আদালতে প্রতিবেদন দাখিল করতে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।

শরীয়তপুরের আদালত পরিদর্শক মেজবাহ্ উদ্দিন আহম্মেদ এ তথ্য নিশ্চিত করেছেন। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘আসামিদের গ্রেপ্তার করে নির্যাতন করার অভিযোগে দুই পুলিশ কর্মকর্তার বিষয়ে আমলি আদালত থেকে একটি আদেশ দেওয়া হয়েছে। ওই আদেশের নথি বৃহস্পতিবার শেষবেলায় আমাদের কাছে পৌঁছায়। শুক্র-শনিবার বন্ধ থাকায় তা পুলিশ সুপারের কার্যালয়ে পাঠাতে পারিনি। আজ সকালে পাঠিয়েছি। ওই আদেশে দুই পুলিশ কর্মকর্তার বিষয়ে আইনগত পদক্ষেপ নিয়ে আদালতে প্রতিবেদন দিতে বলা হয়েছে।’

পদ্মা সেতু দক্ষিণ থানা সূত্র ও ভুক্তভোগীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, জাজিরার আহাদী বয়াতিকান্দি গ্রামের শাহীন আলম শেখ ও তাঁর সহযোগী ছোট কৃষ্ণনগর গ্রামের সেকান্দার মাদবরের কাছ থেকে গত ২১ মে ১৭ হাজার ডলার, টাকা ও মুঠোফোন ছিনতাই হয় বলে অভিযোগ ওঠে। তাতে ২১ লাখ ১৫ হাজার ২৫০ টাকা খোয়া গেছে এমন অভিযোগ এনে পদ্মা সেতু দক্ষিণ থানায় মামলা করেন শাহীন আলম। এতে বকুল চোকদার, মো. সাদ্দাম চোকদার, সাইদুল শেখ, মো. আনোয়ার হোসেনসহ ৯ ব্যক্তিকে আসামি করা হয়।

ভুক্তভোগী ওই চার আসামির ভাষ্য অনুযায়ী, ২৯ মে তাঁরা উচ্চ আদালত থেকে ছয় সপ্তাহের জামিন পান। এরপর রাতে তাঁরা ঢাকার কেরানীগঞ্জের একটি বাসায় ছিলেন। সেখানে তাঁদের ওপর চড়াও হন জাজিরা উপজেলা ছাত্রলীগের সভাপতি রুবেল ব্যাপারী ও ছিনতাই মামলার বাদীর আত্মীয় শহীদুল ইসলাম। পরে রুবেল অতিরিক্ত পুলিশ সুপার রাসেল মনির ও ওসি শেখ মোস্তাফিজুর রহমানকে মুঠোফোনে কেরানীগঞ্জের ওই বাসায় ডেকে নেন। সেখানে একটি কক্ষে আটকে তাঁদের শারীরিকভাবে নির্যাতন করা হয়।

নির্যাতনের অভিযোগ তোলা বকুল চোকদার

জানতে চাইলে জাজিরা উপজেলা ছাত্রলীগের সভাপতি রুবেল ব্যাপারী মুঠোফোনে প্রথম আলোকে বলেন, যাঁর ডলার ও টাকা ছিনতাই হয়েছে, তিনি তাঁর ভাগনে হন। তাঁকে সহযোগিতা করার জন্য সামাজিকভাবে তিনি মামলার আসামিদের ওপর চাপ প্রয়োগ করেছিলেন। ঢাকায় তাঁদের অনুসরণ করে পুলিশে ধরিয়ে দিয়েছেন। তখন ধস্তাধস্তিতে তাঁরা ব্যথা পেতে পারেন।

শরীয়তপুর আদালত সূত্রে জানা গেছে, ২৯ মে রাতে ওই চার যুবককে গ্রেপ্তার করা হলেও ১ জুন তাঁদের চিফ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে হাজির করেন পদ্মা সেতু দক্ষিণ থানার পরিদর্শক (তদন্ত) সুরুজ উদ্দিন আহম্মেদ। তিনি আসামিদের আদালতে উপস্থাপন করার প্রতিবেদনে উল্লেখ করেন, আসামিদের গ্রেপ্তারের সময় ধস্তাধস্তিতে জখম হয়েছেন। তাঁদের জাজিরা উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে চিকিৎসা দেওয়া হয়েছে। ৪ জুন ওই চার আসামির জামিন ও রিমান্ড শুনানির দিন ছিল। ওই দিন আসামিপক্ষের আইনজীবী চারজনকে গ্রেপ্তারের পর শারীরিক নির্যাতনের বিষয় আদালতের নজরে আনেন। আদালত তাঁদের চিকিৎসা দিয়ে মেডিকেল প্রতিবেদন দাখিল করার জন্য শরীয়তপুর সদর হাসপাতালের তত্ত্বাবধায়ককে নির্দেশ দেন।

সদর হাসপাতাল থেকে ৬ জুন আদালতে প্রতিবেদন দাখিল করা হয়। মেডিকেল প্রতিবেদনের বিষয়ে শরীয়তপুর সদর হাসপাতালের আবাসিক চিকিৎসা কর্মকর্তা সুমন কুমার পোদ্দার প্রথম আলোকে বলেন, ৪ জুন সিনিয়র জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আল ইমরান চার আসামিকে হাসপাতালে পাঠিয়েছেন। তাঁদের হাসপাতালে ভর্তি করে চিকিৎসা দেওয়া হয়। শারীরিক পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে দেখেছেন, তাঁদের শরীরে বিভিন্ন স্থানে আঘাতের চিহ্ন রয়েছে। এ আঘাতগুলো কীভাবে করা হয়েছে, তা বলতে পারবেন না।

মেডিকেল প্রতিবেদনে নির্যাতনের সত্যতা পেয়ে শরীয়তপুরের সিনিয়র জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আল ইমরান তা আদালতে নথিভুক্ত করেন। এরপর তিনি ৭ জুন এ বিষয়ে আদেশ দেন। ‘নির্যাতন এবং হেফাজতে মৃত্যু নিবারণ আইন, ২০১৩’–এর ৫ ধারার বিধান অনুযায়ী অভিযুক্ত নড়িয়া সার্কেলের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার রাসেল মনির ও পদ্মা সেতু দক্ষিণ থানার ওসি শেখ মোহাম্মদ মোস্তাফিজুর রহমানের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নিতে বলা হয়। এরপর ৯ জুলাইয়ের মধ্য আমলি আদালতে প্রতিবেদন দাখিলের জন্য পুলিশ সুপার শরীয়তপুরকে নির্দেশ দেওয়া হয়।

ভুক্তভোগী সাদ্দাম চোকদার বলেন, ‘আমাদের চোখ বেঁধে আটকে রেখে দুই দিন ধরে পিটিয়েছে। হাতুড়ি দিয়ে হাড় ও হাত–পায়ের গিরায় পেটানো হয়েছে। প্লাস দিয়ে হাত ও পায়ের নখ তুলে দেওয়া হয়েছে। আমার বাঁ চোখে লাথি মেরেছেন অতিরিক্ত পুলিশ সুপার রাসেল মনির।’

বকুল চোকদার বলেন, ‘আমাদের পিটিয়েছে আর জিজ্ঞেস করেছে—টাকা কোথায় রেখেছিস? তোদের ৭২ লাখ টাকা দিতে হবে, তোরা টাকা নিয়েছিস, তা স্বীকার কর। চোখ বেঁধে দুজনকে আলাদা করে ফেলেছিল। দুজনকে এনকাউন্টারে দেওয়া হয়েছে বলে ভয় দেখানো হয়েছে। আমার চাচাতো ভাই সাদ্দামকে মেরে ফ্লোরে ফেলে রাখার পর সে পানি খেতে চেয়েছিল। তখন আমাকে ভাইয়ের মুখে প্রস্রাব করে দিতে বলে। আমি কান্না করি, আবার পেটায়। বাধ্য হয়ে ভাইয়ের শরীরে প্রস্রাব করে দিই।’

এসব অভিযোগে গত বুধবার ওসি মোস্তাফিজুর রহমানকে পদ্মা সেতু দক্ষিণ থানা থেকে বদলি করে পুলিশ সুপারের কার্যালয়ে সংযুক্ত করা হয়েছে।

আদালতের আদেশের বিষয়ে শরীয়তপুরের পুলিশ সুপার সাইফুল হক প্রথম আলোকে বলেন, ‘এসব ঘটনা আমরা তদন্ত করছি। অভিযোগের বিষয় প্রমাণিত হলে বিভাগীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে। আর আদালত থেকে কোনো আদেশ বা নির্দেশনা আমার দপ্তরে পৌঁছায়নি। আদালত কোনো নির্দেশনা দিলে পদক্ষেপ নেওয়া হবে।’