ময়মনসিংহ নগরের শশীলজ জাদুঘর। ৯ একর জমির ওপর সবুজের সমারোহে নান্দনিক এক দর্শনীয় স্থান
ময়মনসিংহ নগরের শশীলজ জাদুঘর। ৯ একর জমির ওপর সবুজের সমারোহে নান্দনিক এক দর্শনীয় স্থান

রবীন্দ্রনাথ-নজরুলের স্মৃতিধন্য ময়মনসিংহ, সঙ্গী প্রাকৃতিক সৌন্দর্য

হাওর, জঙ্গল, মহিষের শিং—এই তিনে ‘ময়মনসিং’। প্রবাদ-প্রবচনে একসময় এভাবেই পরিচয় করানো হতো ময়মনসিংহকে। ১৩টি উপজেলা নিয়ে এ জেলার বিস্তৃতি। জেলার এক পাশে সীমান্তঘেঁষা প্রাকৃতিক সৌন্দর্য। আর আছে নানা প্রাচীন স্থাপনা। বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ও জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের স্মৃতিধন্য এই জেলার বুক চিরে বয়ে গেছে ব্রহ্মপুত্র নদ।

ব্রহ্মপুত্রের সৌন্দর্য উপভোগের পাশাপাশি ঘুরে দেখার জন্য আছে শশীলজ, আলেকজান্ডার ক্যাসল, গৌরীপুর লজ, শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিন সংগ্রহশালা, জয়নুল আবেদিন উদ্যান, মিনি চিড়িয়াখানা, এশিয়ান মিউজিক মিউজিয়ামে বিরল বাদ্যযন্ত্রের সংগ্রহশালা, বিজিবি পার্ক, বিপিন পার্ক, ময়মনসিংহ জাদুঘর, বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়, বোটানিক্যাল গার্ডেন, মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউটে মাছের জাদুঘর, মুক্তাগাছার জমিদারবাড়ি, গৌরীপুর রাজবাড়ি, রামগোপালপুর জমিদারবাড়ি, ফুলবাড়িয়ার অর্কিড বাগান, রাবারবাগান, ধোবাউড়ার চিনামাটির পাহাড়, হালুয়াঘাটের গাবরাখালী পার্ক, গফরগাঁওয়ে ভাষাসৈনিক আবদুল জব্বার স্মৃতি জাদুঘর, ভালুকার কুমিরের খামার, ত্রিশালের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম স্মৃতি জাদুঘর, চেচুয়াবিল বা শাপলাবিল, ঈশ্বরগঞ্জের আঠারবাড়ি জমিদারবাড়ি।

শশীলজ জাদুঘর

শহরের জিরো পয়েন্টের কাছেই দেখা মিলবে শশীলজ, যা বর্তমানে শশীলজ জাদুঘর নামে পরিচিত। মূল ফটক ভেদ করতেই প্রাসাদের সামনে বাগান স্বাগত জানাবে। মহারাজা শশীকান্ত আচার্যের পরিবার নবাব মুর্শিদকুলি খাঁয়ের আমলে প্রথম জমিদারি লাভ করেন এবং তাঁরা মুক্তাগাছাকে কেন্দ্র করে জমিদারি পরিচালনা করতে থাকেন। আঠারো শতকে মহারাজা মুক্তাগাছার বাইরে শশীলজ তৈরি করেন, যা স্থাপত্যশৈলীর অনন্য নিদর্শন হিসেবে এখনো মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে। ৯ একর জমির ওপর সবুজের সমারোহে নান্দনিক এক দর্শনীয় স্থান। মূল ভবনের পেছনে অবস্থিত ‘জলঘর’ খ্যাত দোতলা পুকুরঘাট। ভবনের ভেতরে আছে প্রত্নতাত্ত্বিক জাদুঘরে ঐতিহাসিক জিনিস দেখার সুযোগও।

আলেকজান্ডার ক্যাসল

আলেকজান্ডার ক্যাসল ময়মনসিংহ জজ আদালতের পেছনেই অবস্থিত একটি প্রাসাদ। এই শহরের প্রাচীন স্থাপনাগুলোর একটি। এটি স্থানীয়ভাবে লোহার কুঠিরও বলা হয়। মহারাজা সূর্যকান্ত আচার্য চৌধুরী প্রাসাদটি নির্মাণ করেন। ১৮৮৯ সালে ৪৫ হাজার টাকা ব্যয়ে নির্মিত ভবনটিতে লোহার ব্যবহারের কারণে লোহার কুঠি নামে পরিচিত। তৎকালীন ভারত সম্রাট সপ্তম এডওয়ার্ডের স্ত্রী আলেকজান্দ্রার নাম অনুসারে ভবনটির নাম করা হয়েছিল ‘আলেকজান্দ্রা ক্যাসল’। পরে লোকমুখে এটি আলেকজান্ডার ক্যাসল বা লোহার কুঠির বলে পরিচিতি পায়। শশীলজ থেকে মাত্র পাঁচ মিনিট হাঁটলেই যাওয়া যাবে এই ক্যাসলে।

গৌরীপুর লজ

নগরের জুবিলীঘাট এলাকায় ব্রহ্মপুত্র নদের তীরে অবস্থিত ঐতিহাসিক একটি জমিদারবাড়ি। দোতলা এই বাড়ি থেকে দেখা মিলত ব্রহ্মপুত্র নদের অপার সৌন্দর্য। ১৮২৮ সালে মহারাজা শশীকান্তের শাসনামলে বর্তমান ময়মনসিংহ সদরের ব্রহ্মপুত্র নদের তীরে গৌরীপুরের জমিদার ব্রজেন্দ্র কিশোর এই দ্বিতল বাড়িটি বানান। জমিদার ব্রজেন্দ্র কিশোর বাড়িটি তৈরি করতে চীন থেকে মিস্ত্রি এনেছিলেন বলে কথিত আছে। বর্তমানে সোনালী ব্যাংক হিসেবে ব্যবহৃত হয় এই বাড়ির আঙিনা। নগরের জিরো পয়েন্ট থেকে পাঁচ মিনিট হাঁটলে দেখা মেলে দৃষ্টিনন্দন এই বাড়ির।

ময়মনসিংহ শহরের প্রাচীন স্থাপনাগুলোর একটি আলেকজান্ডার ক্যাসল

জয়নুল সংগ্রহশালা ও উদ্যান

শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিন সংগ্রহশালাটি ব্রহ্মপুত্র নদের পাড়েই অবস্থিত। ময়মনসিংহ শহরের জিরো পয়েন্টের কাছেই জয়নুল সংগ্রহশালা। ১৯৭৫ সালে সংগ্রহশালাটি প্রতিষ্ঠিত হয়। ৬৩টি চিত্রকর্ম নিয়ে সাজানো এ সংগ্রহশালা। এখানে চিত্রকর্মের পাশাপাশি শিল্পাচার্যের ব্যবহার্য জিনিসও রয়েছে।

নদের তীরে চমৎকার পরিবেশে আছে জয়নুল আবেদিন পার্ক। বিনোদনের জন্য এই পার্কে আছে দোলনা, ট্রেন, ম্যাজিক নৌকা, মিনি চিড়িয়াখানা, বৈশাখী মঞ্চ, ঘোড়ার গাড়ি, চরকি ও বিভিন্ন খাবারের দোকান। যাঁরা নদের বুকে ভাসতে চান, তাঁদের জন্য সারি সারি নৌকার ব্যবস্থাও আছে।

কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়

ময়মনসিংহ শহর থেকে মাত্র ৪ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়টি। প্রায় ১ হাজার ২০০ একর জায়গা নিয়ে এটি অবস্থিত। তাই এক দিনের মধ্যে পুরো বিশ্ববিদ্যালয় এলাকা ঘুরে দেখা সম্ভব নয়। তবে পর্যটকেরা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফুলের বাগান, বৈশাখী চত্বর, লিচু ও আমবাগান, সবুজ মাঠ, লেক, ফিশ মিউজিয়াম, কৃষি মিউজিয়াম, সেন্ট্রাল মসজিদ, বিভিন্ন ফসলের খেত, মাছ চাষের পুকুর, গবাদিপশুর খামার, নান্দনিক সড়ক, বিশ্ববিদ্যালয় রেলস্টেশন ও বিভিন্ন দর্শনীয় ভাস্কর্য ঘুরে দেখতে পারেন কম সময়েই। এখানে আছে বোটানিক্যাল গার্ডেন। বিশ্ববিদ্যালয় চত্বরেই বাংলাদেশ মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউটে আছে ফিশ মিউজিয়াম। ১৬৯ প্রজাতির মাছ নিয়ে এই মিউজিয়াম নানা দেশি-বিদেশি মাছের সঙ্গে পরিচিত হওয়ার সুযোগ করে দেবে।

মুক্তাগাছায় যা দেখার আছে

ময়মনসিংহের মুক্তাগাছা জমিদার বাড়িটি সবার কাছে পরিচিত। ময়মনসিংহ শহর থেকে এই জমিদারবাড়ির দূরত্ব ১৭ কিলোমিটার। মুক্তাগাছার জমিদারবাড়ি দেখার পাশাপাশি আশপাশে আরও দর্শনীয় কিছু ঐতিহাসিক স্থাপনা আছে এখানে। রাজেশ্বরী মন্দির জমিদারবাড়ি-সংলগ্নই। দেখার আছে পাথরের শিবমন্দির, জোড়া মন্দির, তিন শিব মন্দির, জমিদার শশীকান্তের প্রাসাদ ও বড় হিস্যার বাড়ি বা এন এন পাইলট উচ্চবিদ্যালয়। এখানে এলে মুক্তাগাছার মণ্ডার স্বাদ নিতে ভুলবেন না।

কবি নজরুলের স্মৃতিধন্য ত্রিশাল

ময়মনসিংহ শহর থেকে ২৪ কিলোমিটার দূরে এবং ত্রিশাল বাসস্ট্যান্ড থেকে তিন কিলোমিটার দূরে রামপুর ইউনিয়নে আছে বিশাল চেচুয়াবিল। যা এখন শাপলাবিল নামে পরিচিত। বর্ষা মৌসুম থেকে শুরু করে শীতের শুরু পর্যন্ত এখানে প্রচুর শাপলা ফোটে। দর্শনার্থীরা নৌকায় করে বিলের সৌন্দর্য উপভোগ করতে আসেন।

কবি কাজী নজরুল ইসলামের স্মৃতিধন্য ত্রিশাল। এখানেই কেটেছে কবির শৈশব। ত্রিশালে দুটি স্থানে নজরুল স্মৃতিকেন্দ্র গড়ে তোলা হয়েছে। একটির অবস্থান ত্রিশালের বৈলর ইউনিয়নের কাজীর শিমলা গ্রামের দারোগা বাড়িতে, যা ময়মনসিংহ শহর থেকে মাত্র ১০ কিলোমিটার দূরত্বে। অন্যটির অবস্থান ত্রিশালের নামাপাড়ায় বিচুতিয়া ব্যাপারী বাড়িতে। এটি শহর থেকে ২৩ কিলোমিটার দূরে। সংস্কৃতিবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের উদ্যোগে দুটি স্মৃতিকেন্দ্র পরিচালিত হয়। এখানে রয়েছে কবির নানা স্মৃতি।

ময়মনসিংহের হালুয়াঘাটের গাবরাখালী পর্যটনকেন্দ্র

আঠারবাড়ি জমিদারবাড়ি

শহর থেকে ৩৯ কিলোমিটার দূরে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের স্মৃতিবিজড়িত আঠারবাড়ি জমিদারবাড়ি। আঠারবাড়ির জমিদার প্রমোদ রায় চৌধুরীর আমন্ত্রণে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ১৯২৬ সালের ১৯ ফেব্রুয়ারি রাজবাড়িটিতে এসেছিলেন। জমিদার তাঁর জন্য মধ্যাহ্নভোজ, গান ও নাটকের আয়োজন করেন। বর্তমানে বাড়িটি আঠারবাড়ি ডিগ্রি কলেজ হিসেবে ব্যবহৃত হয়।

গৌরীপুরে যা আছে

সদর থেকে ২০ কিলোমিটার পূর্বে গৌরীপুর উপজেলা সদর। কারও কারও মতে, গৌরীপুরের জমিদার শ্রীকৃষ্ণ চৌধুরীর গৌরী নামে এক মেয়ে ছিল। তাঁর নাম অনুসারে এই উপজেলার নাম গৌরীপুর হয়েছে। আবার অনেকের মতে, হিন্দুদের গৌরী দেবীর নাম অনুসারে এই স্থানের নাম গৌরীপুর। আনুমানিক ১৭০০ সালের দিকে গৌরীপুর জমিদারবাড়িটি প্রতিষ্ঠিত হয়েছে বলে ধারণা করা হয়। এখানে পাশাপাশি দুই জমিদারের জমিদারি ছিল। তাই তাদের আলাদা দুটি বাড়ি ছিল। স্থানীয় লোকজন একটিকে আনন্দ কিশোরের ও অন্যটিকে সুরেন্দ্র প্রসাদ লাহিড়ীর জমিদারবাড়ি বলে থাকেন। জমিদার আনন্দ কিশোরের বাড়িটি এখন গৌরীপুর মহিলা কলেজ এবং জমিদার সুরেন্দ্র প্রসাদ লাহিড়ীর বাড়িটি গৌরীপুর সরকারি কলেজ হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে।

হালুয়াঘাট ও ধোবাউড়ার চিনামাটির পাহাড়

প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের লীলাভূমি ময়মনসিংহ জেলার হালুয়াঘাট ও ধোবাউড়া উপজেলার গাবরাখালী ও গলইভাঙ্গা গ্রাম। এখানের সমতল ভূমি পরিবেষ্টিত পাহাড়, পাখির কলরব আর সূর্যাস্ত দেখতে অনেক সুন্দর। ১২৫ একর এলাকাজুড়ে ছোট-বড় ৬৭টি পাহাড় নিয়ে গাবরাখালী পর্যটনকেন্দ্র। ময়মনসিংহ শহর থেকে হালুয়াঘাটের দূরত্ব ৪৯ কিলোমিটার। আর হালুয়াঘাট উপজেলা সদর থেকে এর দূরত্ব ১৪ কিলোমিটার।

একেবারে ভারত সীমান্ত লাগোয়া ময়মনসিংহের ধোবাউড়া উপজেলা। দক্ষিণ মাইজপাড়া ইউনিয়নের পুঁটিমারী বাজারের পাশেই অবস্থিত সাদা সোনাখ্যাত চিনামাটির পাহাড়। এখানে সমতল ভূমির বুক চিরে যেমন দাঁড়িয়ে আছে গারো পাহাড়, তেমনি আছে নয়নাভিরাম লীলাভূমি চীনামাটির পাহাড়। এখানে ছোট-বড় নানা আকারের চিনামাটির পাহাড়ের ফাঁকে আছে চোখজুড়ানো নীল রঙের পানির ছোট-বড় জলাশয়।

ফুলবাড়িয়ার অর্কিডবাগান ও রাবারবাগান

ময়মনসিংহ শহর থেকে ফুলবাড়িয়া উপজেলা সদরের দূরত্ব ২০ কিলোমিটার। সেখান থেকে ১২ কিলোমিটার দূরে এনায়েতপুর গ্রামে গেলে দেখা মিলবে অর্কিড বাগানের। বাংলাদেশের একমাত্র অর্কিডবাগান এখানে। বাগানে দুই শতাধিক প্রজাতির অর্কিড আছে। কাছেই নাওগাঁও ইউনিয়নের সন্তোষপুর গ্রামে আছে রাবারবাগান। প্রায় ১০৬ একর জমি নিয়ে অবস্থিত এই রাবারবাগান। বাগান থেকে সংগৃহীত রাবার প্রক্রিয়াজাত করে দেশ-বিদেশে রপ্তানি করা হয়।