নোয়াখালী সদর উপজেলায় যুবলীগ নেতা মো. আবদুস শহীদকে (৪৩) প্রতিপক্ষের লোকজন পেটানোর পর গণপিটুনি বলে প্রচার করার অভিযোগ পাওয়া গেছে। এ–সংক্রান্ত একটি ভিডিও ঘটনার পরপরই সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়েছে। এতে দেখা গেছে, মারধরে অংশ নেওয়া লোকজন ওই এলাকার একটি সন্ত্রাসী গ্রুপের সদস্য। তাঁদের সঙ্গে শহীদের দীর্ঘদিনের বিরোধ ছিল। হত্যাকাণ্ডের ঘটনা ধামাচাপ দিতেই এটিকে গণপিটুনি হিসেবে প্রচার করা হয়েছিল বলে এলাকার বাসিন্দারা ধারণা করছেন।
গতকাল শনিবার বিকেলে নোয়াখালী সদর উপজেলার ১৯ নম্বর চর মটুয়া ইউনিয়নের সূর্যনারায়ণবহর গ্রামে শহীদকে পিটিয়ে খুন করা হয়। নিহত আবদুস শহীদ ওই গ্রামের মমিন উল্যাহর ছেলে। আবদুস শহীদের এলাকার একাধিক বাসিন্দা, রাজনৈতিক দলের নেতা-কর্মী ও পুলিশের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, সাবেক এই যুবলীগের নেতা পরিকল্পিত হত্যাকাণ্ডের শিকার হয়েছেন।
এ ঘটনার পর সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়া ভিডিও চিত্রে দেখা যায়, স্থানীয় একটি সন্ত্রাসী গ্রুপের প্রধান নুরুল ইসলাম ওরফে মিয়া মাঝির নেতৃত্বে শহীদকে একটি পাকা দালানের কক্ষে আটকে রেখে পেটানো হচ্ছে। মিয়া মাঝির উপস্থিতিতে একাধিক তরুণকে দেখা গেছে শহীদকে পেটাতে ও লাথি দিতে।
ব্যাপক মারধরের পর হামলাকারীরা অস্ত্রসহ সন্ত্রাসী আটকের নাটক সাজান এবং গণপিটুনির বিষয়টি প্রচার করেন। রাতে চিকিৎসাধীন অবস্থায় তাঁর মৃত্যু হলে পুলিশও তখন আট মামলার পলাতক আসামির মৃত্যু হয়েছে বলে জানায়। নিহত শহীদ যে যুবলীগের নেতা ছিলেন, বিষয়টি তখন পুলিশ জানায়নি।
রাতে পিটুনির ঘটনার ভিডিও চিত্র সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ার পর আজ রোববার দুপুরে সুধারাম থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মীর জাহেদুল হক প্রথম আলোকে বলেন, শহীদকে মারধরের একটি ভিডিও চিত্র তিনি দেখেছেন। এতে মিয়া মাঝি, তাঁর ছেলেসহ কয়েকজনকে শহীদকে মারধর করতে দেখা গেছে। তবে ওই ভিডিও গতকালের কি না, তা পরিষ্কার নয়। বিষয়টি খতিয়ে দেখতে হবে। কারণ, তাঁদের মধ্যে আগেও ঝামেলা হয়েছিল।
হত্যার শিকার আবদুস শহীদের এলাকার বাসিন্দারা জানান, নুরুল ইসলাম ওরফে মিয়া মাঝির সঙ্গে নিহত আবদুস শহীদের বিরোধ পুরোনো। মিয়া মাঝি এলাকায় একটি সন্ত্রাসী গ্রুপ নিয়ন্ত্রণ করেন। অপর দিকে আবদুস শহীদের একটি সন্ত্রাসী গ্রুপ রয়েছে। শহীদ পূর্ব চর মটুয়া ইউনিয়ন পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান নুরুল আমিনের অনুসারী ছিলেন এবং তাঁর প্রশ্রয়ে মাদক ব্যবসাসহ বিভিন্ন অপরাধ করে বেড়াতেন। বিগত নির্বাচনে নুরুল আমিন পরাজিত হলে শহীদ দুর্বল হয়ে পড়েন। তবু তিনি মাদক ব্যবসাসহ বিভিন্ন অপরাধ চালিয়ে যান।
সূত্র জানায়, রাজনৈতিক ও মাদক ব্যবসার বিরোধের জেরে বছরখানেক আগেও শহীদের ওপর হামলা চালিয়েছিলেন মিয়া মাঝির লোকজন। কিন্তু ঘটনাচক্রে ওই হামলার ঘটনায় গুরুতর আহত হলেও প্রাণে বেঁচে যান শহীদ। কিন্তু তাঁদের মধ্যকার বিরোধ থেকে যায় আগের মতোই। যার জের ধরে গতকাল বিকেলে মিয়া মাঝির নেতৃত্বে তাঁর ছেলে ও অন্য সাঙ্গপাঙ্গরা বাড়ির পাশ থেকে শহীদকে তুলে নিয়ে যান। এরপর একটি পাকা দালানের ভেতর একটি কক্ষে নিয়ে মারধর করা হয়। একই সময় মারধর করা হয় শহীদের অনুসারী আরও তিনজনকে। এরপর মিয়া মাঝির লোকেরাই থানায় ও যৌথ বাহিনীর কাছে ফোন করে অস্ত্রসহ সন্ত্রাসী আটকের নাটকের খবর দেন।
স্থানীয় বাসিন্দাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, মিয়া মাঝি একসময় বিএনপির রাজনীতিতে সক্রিয় থাকলেও আওয়ামী লীগের স্থানীয় নেতাদের সঙ্গে তাঁর সখ্য ছিল। তিনি বিগত ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে ৭ নম্বর ওয়ার্ড থেকে সদস্য প্রার্থী হয়ে পরাজিত হয়েছিলেন। আর নিহত শহীদ ইউনিয়ন যুবলীগের সাবেক সহসভাপতি ছিলেন। গত ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর মিয়া মাঝির নেতৃত্বে স্থানীয় ৭ নম্বর ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের সভাপতি ও ইউপি সদস্য তোফায়েল আহমদের বাড়িতে হামলা, ভাঙচুর ও লুটপাট চালানো হয়। দফায় দফায় হামলা ও সশস্ত্র মহড়ার এক পর্যায়ে তোফায়েল এলাকা ছেড়ে আত্মগোপনে চলে যান।
বাসিন্দারা জানান, যুবলীগের নেতা শহীদকে পিটিয়ে হত্যার ভিডিও প্রকাশ পাওয়ার পর এলাকা ছেড়ে গা ঢাকা দিয়েছেন মিয়া মাঝি ও তাঁর বাহিনীর সদস্যরা। স্থানীয় একাধিক ব্যক্তি জানান, লক্ষ্মীপুরের সীমান্তবর্তী এলাকা হওয়ায় মিয়া মাঝি, শহীদ বাহিনীসহ ওই এলাকায় আরও কয়েকটি ছোট ছোট সন্ত্রাসী গ্রুপ রয়েছে। ওই গ্রুপগুলো এলাকায় মাদক ব্যবসা পরিচালনাসহ বিভিন্ন অপকর্মের সঙ্গে জড়িত।
ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ফয়সাল ভূঁইয়া প্রথম আলোকে বলেন, ইউনিয়ন যুবলীগের সহসভাপতি আবদুস শহীদ ব্যক্তি হিসেবে খারাপ হতে পারেন। অন্যায় থাকলে তাঁকে আইনের হাতে সোপর্দ করা যেত। তা না করে এভাবে পিটিয়ে মারা হলো কোন যুক্তিতে?
অন্যদিকে ৭ নম্বর ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের সভাপতি ও ইউপি সদস্য তোফায়েল আহমেদ বলেন, মিয়া মাঝি ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ ক্ষমতা ছাড়ার পর তাঁর বাড়িতেও হামলা, ভাঙচুর ও লুটপাট চালিয়েছেন। ঘর থেকে সাড়ে চার লাখ টাকা লুট করে নিয়ে গেছেন। ওই ঘটনায় তিনি আদালতে মামলা করায় এখন পালিয়ে বেড়াচ্ছেন।
সুধারাম থানার ওসি জাহেদুল হক বলেন, হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় আবদুস শহীদের মৃত্যু হলেও আজ দুপুর পর্যন্ত তাঁর পরিবারের কেউ থানায় যোগাযোগ করেননি। তিনি জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তাসহ ঘটনাস্থলে গিয়ে পরিবারের সঙ্গে কথা বলে পরবর্তী আইনি পদক্ষেপ গ্রহণ করবেন। একই সঙ্গে ঘটনার সঙ্গে যাঁরা জড়িত বলে তথ্য পাওয়া যাবে, তাঁদের আইনের আওতায় আনতে পদক্ষেপ নেওয়া হবে।
প্রসঙ্গত, গতকাল বিকেলে বিকেলে পূর্ব চর মটুয়া এলাকায় শহীদ নামের এক অস্ত্রধারী ও তাঁর অপর তিন সহযোগীকে আটক করা হয়েছে বলে যৌথ বাহিনীর কাছে খবর পাঠান স্থানীয় বাসিন্দারা। এই চারজন হলেন আবদুস শহীদ, মো. জামাল, মো. জাবেদ ও মো. রিয়াদ। খবর পেয়ে সেনাবাহিনীর ১৬ রেজিমেন্ট আর্টিলারি ক্যাপ্টেন ইফতেখার আহমেদের নেতৃত্বে সেনাবাহিনী ও পুলিশ যৌথ অভিযান পরিচালনা করে। অভিযানে স্থানীয় জনতার হাতে আটক ওই চার ব্যক্তিকে গুরুতর আহত অবস্থায় উদ্ধার করা হয়। এ সময় একটি শটগান জব্দ করা হয়। যৌথ বাহিনী আহত চারজনকে হাসপাতালে ভর্তি করে। সেখানে চিকিৎসাধীন অবস্থায় রাত আটটার দিকে শহীদ মারা যান। অন্য তিনজন একই হাসপাতালে চিকিৎসাধীন।