ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় অবস্থিত বাংলাদেশ গ্যাস ফিল্ডস কোম্পানি লিমিটেডের (বিজিএফসিএল) প্রধান কার্যালয়ে কর্মচারী নিয়োগে প্রশ্নপত্র ফাঁসসহ মোটা অঙ্কের অর্থের লেনদেনের অভিযোগ উঠেছে। অনৈতিকভাবে কার্যালয়ের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তার ভাতিজা, সিবিএর নেতার ছেলেসহ স্বজন, নিরাপত্তা প্রহরীর দুই ছেলে, কর্মচারীদের স্বজনসহ মামলার আসামিকে চাকরি দেওয়া হয়েছে। এ ছাড়া নিয়োগপ্রাপ্ত ব্যক্তিদের স্বাস্থ্য পরীক্ষাও শ্রমিক-কর্মচারী ইউনিয়নের (সিবিএ) সাবেক নেতাসহ ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তার ভাইয়ের হাসপাতাল থেকে সম্পন্ন হয়েছে।
অত্যন্ত স্বচ্ছতার সঙ্গে পরীক্ষা ও নিয়োগ হয়েছে দাবি করে বিজিএফসিএলের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. শোয়েব প্রথম আলোকে বলেন, ম্যাজিস্ট্রেটের পাহারায় প্রশ্নপত্র কেন্দ্রে পাঠানো হয়েছে। নিয়মনীতির মধ্যে চাকরি হয়েছে। অত্যন্ত গরিব ঘরের ছেলেরাও চাকরি পেয়েছেন। অনেকেই চাকরি পেয়ে বিস্ময় প্রকাশ করেছেন। কারণ, তাঁরা চাকরির জন্য কাউকে কিছু বলেননি, টাকা দেননি। এটাই স্বচ্ছতার বড় প্রমাণ।
বিজিএফসিএল সূত্রে জানা গেছে, ২০২১ সালের ২৮ সেপ্টেম্বর ৯টি ভিন্ন ক্যাটাগরির ১৪৯টি পদের বিপরীতে নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করে পেট্রোবাংলা পরিচালিত এই প্রতিষ্ঠান। পদগুলো হলো মেকানিক-৩ (জেনারেটর ও ভেহিকেল), ওয়েল্ডার-৩, অ্যাটেনডেন্ট-২ (জেনারেটর), অ্যাটেনডেন্ট-২ (কমপ্রেসার), ইনস্ট্রুমেন্ট মেকানিক-৩, টার্নার-৩, ইলেকট্রিশিয়ান-৩, চালক-৩ ও নিরাপত্তা প্রহরী-৪। ২০২২ সালের ২৪ সেপ্টেম্বর এসব পদের বিপরীতে ঢাকায় লিখিত পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হয়। প্রাথমিক বাছাইয়ে উত্তীর্ণ ব্যক্তিদের মৌখিক ফলাফল প্রকাশের পর নভেম্বর থেকে ডিসেম্বরের মধ্যে মৌখিক পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হয়। চলতি বছরের ২৮ ফেব্রুয়ারি ১৪৯টি পদের চূড়ান্ত উত্তীর্ণ কর্মচারীদের প্রাক্-নিয়োগের স্বাস্থ্য পরীক্ষাসংক্রান্ত বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করে বিজিএফসিএল। ২০ মার্চের মধ্যে নিয়োগপ্রাপ্ত ব্যক্তিদের যোগ দেওয়ার কথা।
এ অবস্থায় ১২ মার্চ দুপুরে বিজিএফসিলের প্রধান কার্যালয়ের সামনে নিয়োগবঞ্চিত ব্যক্তিরা প্রশ্নপত্র ফাঁস ও ঘুষের বিনিময়ে হওয়া এই নিয়োগ বাতিলের দাবিতে বিক্ষোভ ও মানববন্ধন করেছেন। এর আগে গত ২০ নভেম্বর নিয়োগপ্রত্যশী রিপন মিয়া বিজিএফসিএলের এই নিয়োগ স্থগিত চেয়ে হাইকোর্টে একটি রিট আবেদন করেন। রিট আবেদনে জ্বালানিসচিব, বিজিএফসিএলের ব্যবস্থাপনা পরিচালক, মহাপরিচালক (প্রশাসন) ও দৈনিক ভিত্তিতে কর্মচারী নিয়োগ দেওয়া ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান মেসার্স মামুন এন্টারপ্রাইজের স্বত্বাধিকারী কাজী হাবিবুল্লাহকে অভিযুক্ত করা হয়। ওই রিট আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে হাইকোর্ট ডিভিশনের বিচারপতি জাফর আহমেদ ও বিচারপতি মো. আখতারুজ্জামানের যৌথ বেঞ্চ বিজিএফসিএলের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও মহাপরিচালককে (প্রশাসন) গত বছরের ১৮ ডিসেম্বরের মধ্যে কারণ দর্শানোর নির্দেশ দেন।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, বিজিএফসিএলের প্রধান কার্যালয়ের মহাপরিচালক (প্রশাসন) মাহমুদুন নবীর ভাতিজা আশরাফ উন নজুমাশরারুন নবী ওরফে উৎস অ্যাটেনডেন্ট-২ (জেনারেটর) পদে, কার্যালয়ের শ্রমিক ইউনিয়নের (সিবিএ) সাধারণ সম্পাদক মুর্শেদুল আলমের ছেলে রাফাতুল আলম ওরফে সুফল অ্যাটেনডেন্ট-২ (জেনারেটর) পদে, বিজিএফসিএলের নিরাপত্তা প্রহরী রফিকুল ইসলামের দুই ছেলে শেখ সিরাজুল ইসলামের ইনস্ট্রুমেন্ট মেকানিক পদে ও শেখ সাইদুর রহমানের অ্যাটেনডেন্ট-২ (কমপ্রেসার) পদে চাকরি হয়েছে। এ ছাড়া রফিকুলের দূরসম্পর্কের এক নাতিও অ্যাটেনডেন্ট পদে চাকরি পেয়েছেন।
এ ছাড়া ২০২০ সালের ৫ মে সদর থানায় জেলা ছাত্রলীগের সভাপতি রবিউল হোসেনের করা ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের মামলার প্রধান আসামি জালাল হাজারীর টার্নার-৩ পদে এবং জ্বালাও-পোড়াও মামলার আসামি উবায়দুল হাজারীর মেকানিক পদে চাকরি হয়েছে। জালাল হাজারী সম্পর্কে সিবিএর নেতা মুর্শেদুল আলমের দূরসম্পর্কের শ্যালক হন। ফলাফল প্রকাশের পর মামলার দুই আসামি সিবিএর ওই নেতাসহ এক উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাকে মিষ্টিমুখ করিয়েছেন বলে জানা গেছে। নিয়োগবঞ্চিত ব্যক্তিদের দাবি, সিবিএর নেতার ছেলেরসহ অধিকাংশের অভিজ্ঞতা ও ট্রেড সনদ ভুয়া। সাত–আট হাজার টাকা দিয়ে একটি প্রতিষ্ঠান থেকে একেকটি ট্রেড সনদ সংগ্রহ করা হয়েছে। এ ছাড়া নিয়োগপ্রাপ্ত ব্যক্তিদের মধ্যে ৭৪ জন ব্রাহ্মণবাড়িয়া শহরের কমফোর্ট হসপিটাল অ্যান্ড ডায়াগনস্টিক সেন্টার থেকে এবং শহরের দ্য ল্যাবএইড ডায়াগনস্টিক সেন্টার অ্যান্ড স্পেশালাইজড হসপিটাল থেকে ৭৫ জন স্বাস্থ্য পরীক্ষা করেছেন। এ জন্য প্রত্যেককে ৭ হাজার ২০০ টাকা দিতে হয়েছে। এর মধ্যে কমফোর্ট হসপিটালের ব্যবস্থাপনা পরিচালক হলেন বিজিএফসিএলের মহাপরিচালক (প্রশাসন) মাহমুদুন নবীর ভাই আখলাক-উন-নবী। এ ছাড়া দ্য ল্যাবএইড ডায়াগনস্টিক সেন্টারের মালিক হলেন সিবিএর সাবেক সাধারণ সম্পাদক মামুন নাজির।
বিজিএফসিএলের একাধিক কর্মচারী নাম প্রকাশ না করার শর্তে প্রথম আলোকে বলেন, বিজিএফসিএলে টাকা ছাড়া চাকরি পাওয়া ‘আকাশকুসুম’ চিন্তা। ১২–১৫ লাখ টাকার বিনিময়ে একেকটি পদে নিয়োগ হয়েছে। তাঁদের দাবি, গ্যাস ফিল্ডের সিবিএর সাধারণ সম্পাদক মুর্শেদুল আলম ও যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক রুহুল আমিন ওরফে বাবুর মাধ্যমে নিয়োগপ্রার্থীরা মোটা অঙ্কের টাকার লেনদেন করেছেন। এর সঙ্গে গ্যাস ফিল্ডের প্রধান কার্যালয়ের একাধিক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাও জড়িত।
নিয়োগে অনিয়মের অভিযোগের বিষয়ে বিজিএফসিএলের মহাপরিচালক (প্রশাসন) ও নিয়োগ বোর্ডের আহ্বায়ক মাহমুদুন নবী প্রথম আলোকে বলেন, কেউ মামলার আসামি হয়ে থাকলে পুলিশ সেটি যাচাই করবে। এ ছাড়া মুক্তিযোদ্ধা কোটা মানা হয়েছে। কোনো অনিয়ম হয়নি। টাকাপয়সা লেনদেনের প্রশ্নই ওঠে না। নিয়োগপ্রাপ্ত ব্যক্তিরা ২০ মার্চ যোগ দেবেন।
ভাতিজার নিয়োগের বিষয়ে জানতে চাইলে মাহমুদুন নবী বলেন, ‘মেধাতালিকায় এবং মুক্তিযোদ্ধা কোটায় আমার ভাইয়ের ছেলের চাকরি হয়েছে।’
নাম প্রকাশ না করার শর্তে বিজিএফসিএলের একাধিক কর্মচারী প্রথম আলোকে বলেন, ‘এই নিয়োগে টাকার ছড়াছড়ি হয়েছে। ১২ লাখ টাকা করে তিনজন প্রার্থীর নিয়োগের জন্য মোট ৩৬ লাখ টাকা সিবিএর সাধারণ সম্পাদককে দিয়েছি। এর মধ্যে দুজনের চাকরি হয়েছে। একজনের হয়নি, টাকা ফেরত পেয়েছি।’
আরকেজন বলেন, ‘ওয়েল্ডার পদে চাকরির জন্য সিবিএর সাধারণ সম্পাদককে এক প্রার্থী ১০ লাখ টাকা দিয়েছেন।’
অভিযোগের বিষয়ে সিবিএর সাধারণ সম্পাদক মুর্শেদুল আলম প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমাদের বিরোধী দল এসব অপপ্রচার চালাচ্ছে। পেট্রোবাংলা ও মন্ত্রণালয় নিয়োগ দিয়েছে। এখানে আমাদের সিবিএর কোনো হাত নেই। মেধায় আমার ছেলের চাকরি হয়েছে। তার অভিজ্ঞতা ও ট্রেড সনদ ভুয়া থাকলে সেটি কর্তৃপক্ষ যাচাই করবে। আর টাকা নেওয়ার অভিযোগটি মিথ্যা।’
অ্যাটেনডেন্ট-২ (জেনারেটর) পদে মৌখিক পরীক্ষা দিয়েছেন এক প্রার্থী। নাম প্রকাশ না করার শর্তে তিনি বলেন, ‘মৌখিক পরীক্ষা অনেক ভালো হয়েছে। চাকরি জুটবে বলে আশাবাদী ছিলাম। আমার পারিবারিক অবস্থা ভালো নয়। তারপরও ধার করে তিন লাখ টাকা দিয়েছিলাম। কিন্তু মোটা অঙ্কের টাকা দিতে না পারায় চাকরি হয়নি। যাঁরা চাকরি পেয়েছেন, তাঁদের প্রত্যেকেই ন্যূনতম ১৫ লাখ থেকে সর্বোচ্চ ২২ লাখ টাকা দিতে হয়েছে।’