আদালতের রায়ের পর বিএনপির মেয়র প্রার্থী শাহাদাত হোসেনকে চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের মেয়র ঘোষণা করে গতকাল মঙ্গলবার রাতে প্রজ্ঞাপন জারি করে নির্বাচন কমিশন। এই প্রজ্ঞাপন জারির পর মেয়র হিসেবে শাহাদাত হোসেন কীভাবে ও কবে শপথ নেবেন, তা নিয়ে আলোচনা চলছে। আলোচনা রয়েছে মেয়াদ নিয়েও।
ছাত্র-জনতার আন্দোলনে গত ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর দেশের ১২টি সিটি করপোরেশনের নির্বাচিত সব মেয়র ও ওয়ার্ড কাউন্সিলরদের অপসারণ করে বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকার। মেয়রদের পরিবর্তে সরকারি আমলাদের সিটি করপোরেশনে প্রশাসক নিয়োগ দিয়েছে অন্তর্বর্তী সরকার। এমন পরিস্থিতিতে আদালতের রায়ে নির্বাচিত মেয়র শাহাদাত হোসেন কবে শপথ ও দায়িত্ব নেবেন, তা নিয়ে আলোচনা চলছে।
সাড়ে তিন বছর আগে অনুষ্ঠিত চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন (চসিক) নির্বাচনে বিএনপির মেয়র প্রার্থী শাহাদাত হোসেনকে জয়ী ঘোষণা করে ১ অক্টোবর রায় দেন আদালত। ওই দিন আদালত ১০ দিনের মধ্যে প্রজ্ঞাপন জারি করতে সরকারকে নির্দেশ দেন। চট্টগ্রাম প্রথম যুগ্ম জেলা জজ ও নির্বাচনী ট্রাইব্যুনালের বিচারক খাইরুল আমিন এ রায় দেন।
রায় ঘোষণার দিন বাদীর আইনজীবী মফিজুল হক ভূঁইয়া প্রথম আলোকে বলেন, ২০২১ সালে অনুষ্ঠিত চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন নির্বাচনে কারচুপির প্রমাণ পেয়েছেন আদালত। এ জন্য বিএনপির প্রার্থী শাহাদাত হোসেনকে চসিকের মেয়র ঘোষণা করেছেন।
২০২১ সালের ২৭ জানুয়ারি চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। নির্বাচনে আওয়ামী লীগের মেয়র প্রার্থী মো. রেজাউল করিম চৌধুরী ৩ লাখ ৬৯ হাজার ২৪৮ ভোট পেয়ে মেয়র নির্বাচিত হন। তাঁর প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী বিএনপির শাহাদাত হোসেন ৫২ হাজার ৪৮৯ ভোট পান। নির্বাচনে কারচুপির অভিযোগে ওই বছরের ২৪ ফেব্রুয়ারি নির্বাচনী ট্রাইব্যুনালে রেজাউল করিমসহ ৯ জনকে বিবাদী করে মামলাটি করেছিলেন নির্বাচনে বিএনপির মেয়র প্রার্থী নগর বিএনপির সাবেক আহ্বায়ক শাহাদাত হোসেন।
আদালত ১০ দিন সময় দিলেও ৭ দিন পরেই নির্বাচন কমিশন প্রজ্ঞাপন জারি করে। সংশোধিত বিজ্ঞপ্তি শিরোনামে বলা হয়েছে, নির্বাচনী ট্রাইব্যুনাল ও যুগ্ম জেলা জজ ১ম আদালত, চট্টগ্রামে দায়েরকৃত নির্বাচনী ট্রাইব্যুনাল মামলার গত ১ অক্টোবরের আদেশে ২০২১ সালের ২৭ জানুয়ারি অনুষ্ঠিত চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন নির্বাচনে মেয়র পদে ‘নৌকা’ প্রতীকের প্রার্থী ও ১ নম্বর বিবাদী মো. রেজাউল করিম চৌধুরীকে নির্বাচিত ঘোষণা বাতিল করে ‘ধানের শীষ’ প্রতীকের প্রার্থী শাহাদাত হোসেনকে নির্বাচিত মেয়র ঘোষণা করে প্রজ্ঞাপন জারি করা হলো।
মেয়াদ কত দিনের
ইসির প্রজ্ঞাপন বিশ্লেষণ করে এবং সিটি করপোরেশনের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের সঙ্গে আলাপ করে জানা গেছে, চট্টগ্রাম নগর বিএনপির সাবেক আহ্বায়ক শাহাদাত হোসেনকে মেয়র হিসেবে ঘোষণা করে প্রজ্ঞাপন জারি করা হলেও তিনি পূর্ণ মেয়াদে দায়িত্ব পালন করতে পারবেন না। যদি চলতি মাসে শপথ নেন, তাহলে সর্বোচ্চ ১৬ মাস দায়িত্ব পালন করতে পারবেন। কেননা, সিটি করপোরেশনের ষষ্ঠ পরিষদের পাঁচ বছর মেয়াদ ২০২৬ সালের ২২ ফেব্রুয়ারি শেষ হওয়ার কথা ছিল। এই পরিষদের নির্বাচিত মেয়র মো. রেজাউল করিম চৌধুরী ও ওয়ার্ড কাউন্সিলরদের প্রথম সাধারণ সভা অনুষ্ঠিত হয় ২০২১ সালের ২৩ ফেব্রুয়ারি। সাধারণত প্রথম সাধারণ সভার দিন থেকে পরিষদের মেয়াদ গণনা করা হয়।
২০২১ সালের ২৭ জানুয়ারি অনুষ্ঠিত নির্বাচনে মেয়র পদে জয়ী হয়েছিলেন নগর আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মো. রেজাউল করিম চৌধুরী। তিনি দায়িত্ব নিয়েছিলেন ওই বছরের ১৫ ফেব্রুয়ারি। তিনি ছিলেন সিটি করপোরেশনের চতুর্থ নির্বাচিত মেয়র। রেজাউল করিম চৌধুরীসহ ১২ সিটি করপোরেশনের মেয়রকে ১৯ আগস্ট অপসারণ করে সরকার।
রেজাউল করিম চৌধুরীর আগে নগর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এ বি এম মহিউদ্দিন চৌধুরী টানা তিনবার, এরপর বিএনপি–সমর্থিত মোহাম্মদ মনজুর আলম একবার ও নগর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আ জ ম নাছির উদ্দীন একবার করে মেয়র নির্বাচিত হয়েছিলেন। অর্থাৎ শাহাদাত হোসেন শপথের পর দায়িত্ব নিলে সিটি করপোরেশনের পঞ্চম নির্বাচিত মেয়র হবেন।
পূর্ণ মেয়াদ না পেলেও যেটুকু সময় পাবেন, তার মধ্যে নগরের উন্নয়নে সর্বোচ্চ চেষ্টা করবেন বলে জানিয়েছেন বিএনপির নেতা শাহাদাত হোসেন। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, দায়িত্ব নেওয়ার পর কী করবেন, তার একটা পরিকল্পনা করেছেন। সবচেয়ে বেশি প্রাধান্য থাকবে জলাবদ্ধতা নিরসনে। দায়িত্ব পালনের সময় নগরবাসীর দীর্ঘদিনের এই দুর্ভোগ লাঘবে কাজ করবেন। মানুষের ঘরবাড়ি ও দোকানপাটে যাতে পানি না ওঠে, সে জন্য পদক্ষেপ নেবেন। এরপর একটি বাসযোগ্য নগর হিসেবে চট্টগ্রামকে গড়ে তোলার বিষয়ে মনোনিবেশ করবেন। ক্লিন, গ্রিন ও হেলদি সিটি হিসেবে গড়ে তুলবেন। গুরুত্ব দেবেন শিক্ষা ও স্বাস্থ্যের বিষয়েও।
কীভাবে ও কবে শপথ
বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকার ছাত্র-জনতার আন্দোলনে পতন হওয়া আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে অনুষ্ঠিত নির্বাচনে নির্বাচিত সিটি করপোরেশনের মেয়র ও ওয়ার্ড কাউন্সিলরদের অপসারণ করেছে। এ জন্য স্থানীয় সরকার (সিটি করপোরেশন) আইন ২০০৯ সংশোধন করে। সংশোধনী অনুযায়ী, বিশেষ পরিস্থিতিতে অত্যাবশ্যক বিবেচনা করলে বা জনস্বার্থে সব সিটি করপোরেশনের মেয়র ও কাউন্সিলরদের অপসারণ করতে পারবে সরকার। এ ছাড়া বিশেষ পরিস্থিতিতে প্রশাসক নিয়োগ ও কমিটি গঠনের ক্ষমতা দেওয়া হয় সরকারকে।
১৭ আগস্ট এই সংশোধনের পর ১৯ আগস্ট সিটি করপোরেশনের মেয়রদের অপসারণ ও প্রশাসক নিয়োগ করা হয়। চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের প্রশাসকের দায়িত্ব পালন করছেন চট্টগ্রাম বিভাগীয় কমিশনার মো. তোফায়েল ইসলাম। এমন অবস্থায় সিটি করপোরেশনের মেয়র হিসেবে শাহাদাত হোসেনের শপথ কীভাবে ও কবে হবে, তা নিয়ে আলোচনা চলছে।
তবে মেয়র হিসেবে শপথ আয়োজনের বিষয়টি স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের ওপর নির্ভর করছে বলে জানান শাহাদাত হোসেন। সাধারণত প্রজ্ঞাপন জারির পর নির্বাচিত মেয়রদের শপথ পাঠ করান সরকারপ্রধান।
স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের এক দায়িত্বশীল কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করে আজ বুধবার বিকেলে প্রথম আলোকে বলেন, বিএনপি নেতা শাহাদাত হোসেনকে মেয়র ঘোষণা করে নির্বাচন কমিশন প্রজ্ঞাপন জারি করেছে। তবে মন্ত্রণালয়ে এখন পর্যন্ত নির্বাচন কমিশন থেকে আনুষ্ঠানিক কোনো চিঠিপত্র আসেনি। চিঠিপত্র আসুক। তারপর ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের সঙ্গে আলোচনা করে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেওয়া হবে।
সিটি করপোরেশনের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা শেখ মুহম্মদ তৌহিদুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের মেয়র হিসেবে শাহাদাত হোসেন কবে শপথ নেবেন এবং দায়িত্ব গ্রহণ করবেন, তা নির্ভর করছে স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের ওপর। মন্ত্রণালয় থেকে তাঁদের যেভাবে নির্দেশনা দেবে, সেভাবে পদক্ষেপ নেবে।
সার্বিক বিষয়ে স্থানীয় সরকার বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক তোফায়েল আহমেদ প্রথম আলোকে বলেন, বিএনপি নেতা শাহাদাত হোসেনকে মেয়র ঘোষণা করে রায় দিয়েছেন আদালত। আদালতের এই রায়ের বিরুদ্ধে এখন পর্যন্ত সরকার আপিল করেনি। এর মধ্যে নির্বাচন কমিশনও প্রজ্ঞাপন জারি করেছে। তাই বলা যেতে পারে, চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের মেয়র পদে বসার ক্ষেত্রে শাহাদাত হোসেনের তেমন কোনো প্রতিবন্ধকতা নেই। এখন পর্যন্ত তাঁর মেয়রের আসনে বসার অধিকার রয়েছে। তাই বলা যেতে পারে, সরকার যদি আর আপিল না করে, তাহলে শপথের মাধ্যমে মেয়রের দায়িত্ব নিতে পারবেন।