হেমন্তের বিকেল ধীরে নামছে। বহুদূর, পশ্চিমে গ্রামের ওপারে সূর্য ডুবছে। ঠিক এ রকম একটা সময়ে হাজারো মানুষের পদচারণে উচ্ছল-উচ্ছ্বাসে ভাসতে থাকে কুশিয়ারা নদীর দুই পাড়। ঢোল, খোল, করতাল ও কাঁসরের ঝংকারে মুখর হয়ে ওঠে কুশিয়ারার প্রশস্ত বুক। একদিকে বাদ্যবাজনা, জলতরঙ্গের ছলাৎ ছলাৎ, অন্যদিকে মানুষের আনন্দ-কোলাহল, হইচই।
ওখানে কুশিয়ারা নদীতে ছিল আবহমান গ্রামবাংলার ঐতিহ্য-সংস্কৃতির অন্যতম লোক–অনুষঙ্গ নৌকাবাইচ প্রতিযোগিতা। গত সোমবার বিকেলে কুশিয়ারা নদীতে এ রকম একটি নৌকাবাইচের আয়োজন করেছিল মৌলভীবাজার সদর উপজেলার খলিলপুর ইউনিয়নের হামরকোনা গ্রামবাসী। এই নৌকাবাইচ দেখতে বৃহত্তর সিলেটের নানা প্রান্তের মানুষের ঢল নামে কুশিয়ারা নদীর শেরপুর অংশে।
স্থানীয় লোকজন বলেন, নৌকাবাইচ এই জল-নদীর দেশে জনবিনোদনের একটি অন্যতম মাধ্যম। বর্ষায় থইথই জলে নদ-নদী, হাওর-বাঁওড় ভরে উঠলে নৌকাবাইচের আয়োজন শুরু হয়ে যায়। বন্যা, দুর্যোগের মতো দুর্ভোগ ভুলে এই অন্যতম লোক–উপাদান নৌকাবাইচ থেকে মানুষ অন্য রকম আনন্দ পান। শেরপুর স্থানটির সঙ্গে সিলেট বিভাগের চারটি জেলারই সড়ক ও নদীপথে যোগাযোগ রয়েছে। প্রতিবছরই কুশিয়ারা নদীতে স্থানীয় মানুষের উদ্যোগে নৌকাবাইচ হয়ে আসছে। এবারও হামরকোনা গ্রামের ব্যানারে নৌকাবাইচের আয়োজন হয়েছে।
সোমবার দুপুর গড়ানোর সময় থেকেই নৌকাবাইচ দেখতে বৃহত্তর সিলেটের নানা প্রান্ত থেকে ছুটে আসতে থাকেন নানা বয়সের মানুষ। বিকেল হতেই মানুষের ঢল নামে কুশিয়ারার দুই পাড়ে। একদিকে মানুষের হইচই, আনন্দ-উচ্ছ্বাস। অন্যদিকে কুশিয়ারার বুকে ঝংকার তুলছে নানা রঙের নাও। মাঝিমাল্লার কণ্ঠে কত কথার, কত ঢঙের গান।
কোনো নাওয়ের মাঝিরা যদি গেয়ে ওঠেন, ‘ছাড়িলাম হাসনের নাওরে’, অন্যদের কণ্ঠে ‘কোন মেস্তরি নাও বানাইলো কেমন দেখা যায়, ঝিলমিল ঝিলমিল করে রে ময়ূরপঙ্খি নায়...।’ সঙ্গে ঢোল বাজছে, কাঁসর বাজছে। বাজছে খোল-করতাল। থইথই করে নাচছে জলকুমারী ঢেউগুলোও। ছলাৎ ছলাৎ করে ঢেউ-তরঙ্গ আছড়ে পড়ছে তীরে। এ এক অন্য রকম বিকেল। তখন নদীর বুকে, নদীর তীরে ঝরে পড়ছে বিকেল-ক্লান্ত কুয়াশার মতো গাঢ় পর্দা। কিন্তু রংবেরঙের পোশাকের মাঝিমাল্লার কণ্ঠ ও বাহুতে, কিংবা দর্শকসারিতে সেই ক্লান্তির কোনো রেশ নেই। প্রতিযোগিতায় প্রতিবার নৌকা ছোটে, আর যেন নতুন করে জেগে ওঠে ভিড়।
আয়োজকদের সূত্রে জানা গেছে, সিলেট বিভাগের সুনামগঞ্জ, হবিগঞ্জ, মৌলভীবাজার ও সিলেটের বিভিন্ন স্থান থেকে ১৪টি নৌকা এই বাইচে অংশ নিয়েছে। শাহ পরানের তরি, শাহ মোস্তফার তরি, কুশিয়ারার তরি, কানাই শাহর তরি, নগর পবন, ইশানের তরি, সোনার তরিসহ ভিন্ন ভিন্ন নামের এই নৌকাগুলো কুশিয়ারার প্রশস্ত বুকে ছুটে গেছে। আর নেচেগেয়ে হইহই করে উঠেছে নারী-পুরুষ, শিশু দর্শকের সারি। কে যে কোন নৌকার সমর্থক, এটা বোঝার কোনো উপায় নেই। ভেতরে–ভেতরে কেউ হয়তো কোনো নির্দিষ্ট নৌকার সমর্থকই। তাতে কিছু যায়–আসে না। জলের বুকে যখন বৈঠার কোপ পড়ে, ছলছল করে রাজহাঁসের মতো গলা বাড়িয়ে ছুটতে থাকে নৌকা, তখন সবাই আর একক কোনো নৌকার সমর্থক থাকে না; সবাই সবার সমর্থক হয়ে যায়, সবাই শুধু এই লোক-আনন্দেরই অংশীদার তখন। ওখানে লোকপ্রাণের সম্মিলনই শুধু ঘটে।
ছয়টি ধাপে প্রতিযোগিতা হয়েছে। চূড়ান্ত পর্বে অংশ নিয়েছে তিনটি নৌকা। কুশিয়ারা নদীর আলীপুর থেকে শেরপুর লঞ্চঘাট পর্যন্ত প্রায় দুই কিলোমিটারের মধ্যে এই নৌকাবাইচ হয়েছে।
শেরপুর শ্রীহট্ট সাহিত্য সংসদের সভাপতি নুরুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, ‘নৌকাবাইচ গ্রামবাংলার একটি প্রাচীন খেলা। যুগ যুগ ধরে এই খেলা মানুষকে নির্মল আনন্দ দিয়ে আসছে। গ্রামীণ অনেক খেলাই এখন হারিয়ে যাওয়ার পথে। লোকবিনোদনের উপাদান দ্রুত কমে আসছে। অনেক খেলাই এরই মধ্যে প্রায় বিলুপ্ত হয়ে গেছে। এ রকম সময়ে নৌকাবাইচের আয়োজন মানুষকে আনন্দ দিতে পেরেছে। আয়োজকদের কাছে প্রত্যাশা, তাঁরা যেন এই নির্মল আনন্দের উদ্যোগটি অব্যাহত রাখেন। কুশিয়ারার বুকে নৌকাবাইচ যেন কোনো কারণে থেমে না যায়।’
আয়োজকেরা জানান, চূড়ান্ত পর্বে চ্যাম্পিয়ন হয়েছে মৌলভীবাজারের রাজনগর উপজেলার শাহ মোস্তফার তরি, রানার্সআপ হবিগঞ্জের নবীগঞ্জের শাহ পরানের তরি, তৃতীয় হয়েছে সদর উপজেলার শেরপুরের কুশিয়ারা তরি ও চতুর্থ স্থান লাভ করেছে সিলেটের ওসমানীনগরের কানাই শাহর তরি। পুরস্কার বিতরণী অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন স্থানীয় ব্যবসায়ী কর্নেল আহমদ। প্রধান অতিথি ছিলেন সাবেক সংসদ সদস্য ও জেলা বিএনপির সভাপতি এম নাসের রহমান।