গ্রামে একজন মাত্র মুক্তিযোদ্ধা। তাঁর বয়স এখন ৭৬ বছর। বিজয় দিবস উপলক্ষে তাই গ্রামের শিশুদের সব আনন্দ আয়োজন সেই বীর মুক্তিযোদ্ধাকে ঘিরে। তাঁকে ফুলের মালা পরিয়ে, ফুলের পাপড়ি ছিটিয়ে বাড়ি থেকে মাঠে নিয়ে আসা, তাঁকে ঘিরে বসে গল্প শোনা, খেলাধুলা করা ও বাড়ি বাড়ি থেকে চাল-ডাল তুলে রান্না করে একসঙ্গে খাওয়ার আয়োজন করা হয়। একজন কৃষক গ্রামের সেই বীর মুক্তিযোদ্ধা ও শিশুদের নিয়ে কয়েক বছর থেকে এই আয়োজন করেন। আজ সোমবার দুপুর থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত তাদের এই আয়োজন চলে।
গ্রামটি রাজশাহীর গোদাগাড়ী উপজেলায়। নাম চৈতন্যপুর। মুক্তিযোদ্ধার নাম জয়চাঁদ মণ্ডল। আর যে কৃষক শিশুদের নিয়ে এই আয়োজন করেন, তাঁর নাম মনিরুজ্জামান। তাঁকে সারাক্ষণ সঙ্গ দেন একজন পেশাদার আলোকচিত্রী আবদুল মালেক। তিনিও শিশুদের সংগঠিত করতে সহযোগিতা করেন।
দুপুরে চৈতন্যপুর গ্রামে গিয়ে দেখা যায়, শিশুরা তাদের নিজ নিজ বাড়ি থেকে চাল-ডাল-আলু যে যার মতো পেরেছে নিয়ে এসে মনিরুজ্জামানের খামারের টংঘরে জমা করেছে। গ্রামের গীতা রানি, দেবরানী, সুমিত্রা রানী, শ্যামলী, রীতা ও দিপালী তা দিয়ে রান্না শুরু করেছেন। মনিরুজ্জামান তার সঙ্গে মুরগির মাংস যোগ করেছেন। তাঁর দুজন শ্রমিক আবদুল খালেক ও লিটন আলী সেই মাংস কাটছেন। তবে তাঁরা এই কাজের জন্য কোনো পারিশ্রমিক নেবেন না। তাঁরা অনুষ্ঠানে এসেছেন। একইভাবে নারীরাও রান্নার কাজ করছেন।
বেলা দুইটার দিকে গ্রামের শিশুরা জয়চাঁদ মণ্ডলের বাড়িতে গিয়ে তাঁর গলায় গাঁদা ফুলের চার-পাঁচটা মালা পরিয়ে দিল। তারপর তাঁর গয়ে ফুলের পাপড়ি ছিটাতে ছিটাতে তাঁকে নিয়ে একটি মাঠে আসে। সেই মাঠে সদ্য ধান কাটা হয়েছে। এক পাশে কাটা ধান স্তূপ করে রাখা হয়েছে। সেখানেই জয়চাঁদ মণ্ডলকে চেয়ারে বসিয়ে শিশুরা তাঁকে ঘিরে মাটিতে বসে পড়ে। জয়চাঁদ মণ্ডলের বাবা খুব গরিব ছিলেন। পঞ্চম শ্রেণির পর আর পড়াশোনা হয়নি। তিনি পাঁচ মেয়ে ও তিন ছেলের বাবা। ছোট ছেলে শুধু ইন্টারমিডিয়েট পর্যন্ত পড়েছেন। আর কারও বেশি পড়াশোনা হয়নি। তবে তিনি একজন সুখী মানুষ বলে জানালেন। তাঁর কোনো সমস্যা নেই।
মাঠে বসেই শিশুরা তাঁর গল্প শুনতে চাইল। এর আনুষ্ঠানিকতা শুরু করে দিলেন কৃষক মনিরুজ্জামান নিজেই। তিনি তাদের মুক্তিযুদ্ধ, স্বাধীন দেশ, পতাকার বিষয়টি পরিষ্কার করে বুঝিয়ে বললেন। বীর মুক্তিযোদ্ধা জয়চাঁদ মণ্ডল তাঁর গল্প শুরু করলেন। তিনি ৭ নম্বর সেক্টরের একজন যোদ্ধা ছিলেন। মা-বাবাকে না জানিয়ে পালিয়ে যুদ্ধে গিয়েছিলেন। ভারতের লালগোলায় গিয়ে প্রশিক্ষণ নেন। তারপর দেশে এসে যুদ্ধে অংশ নেন। তিনি বলেন, তাঁদের শিলিগুড়িতে উচ্চতর প্রশিক্ষণের জন্য পাঠানোর কথা ছিল; কিন্তু ওই সময় সেখানে প্রচুর ঠান্ডার কারণে তাঁদের পাঠানো হয়নি। অবশেষে তাঁরা থ্রি নট থ্রি রাইফেল দিয়েই যুদ্ধ করেছেন। যুদ্ধের একটি স্মৃতির কথা মনে করে তিনি বলেন, পাকিস্তানি সেনারা রাজশাহীর গোদাগাড়ীর একটি স্কুলে বিভিন্ন এলাকা থেকে মেয়েদের ধরে এনে তালা দিয়ে রেখেছিল। তাঁরা খবর পেয়ে সেই স্কুল পাকিস্তানি সেনাদের কাছ থেকে দখলে নিয়ে তালা খুলে মেয়েদের উদ্ধার করেন। দেশ স্বাধীন হওয়ার পরে সেই গ্রামের মেয়েরা তাঁদের খাসি জবাই করে খাইয়েছিলেন।
জয়চাঁদ বলেন, ‘দেশ স্বাধীন হওয়ার পরে যখন বাড়িতে ফিরে আসি তখন মা-বাবা আমাকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে লাগলেন। আমি বললাম, দেশ স্বাধীন হয়েছে, আমি ফিরে এসেছি। এখন কেন কাঁদছ? মা বললেন, “না বলে গিছিলি কেন বাবা!”’
জয়চাঁদ শিশুদের বলেন, ‘লেখাপড়া শিখতে হবে। ভালো মানুষ হতে হবে। বড়দের সম্মান করতে হবে। দেশকে ভালোবাসতে হবে।’ তাঁর কথা শুনে প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করে গ্রামের অষ্টম শ্রেণির শিক্ষার্থী তৃষা বালা, লিপি রানি ও নূপুর বালা। তারা তিনজনই তাদের জয়চাঁদ দাদুকে আশীর্বাদ জানিয়ে বলল, দাদু যেন তাদের মাঝে আরও অনেক দিন সুস্থভাবে বেঁচে থাকেন। তাহলে তারা একজন মুক্তিযোদ্ধাকে আরও অনেক দিন দেখতে পাবে।
আলোচনা শেষে শিশুদের মধ্যে সাতটি ইভেন্টের ক্রীড়া প্রতিযোগিতা অনুষ্ঠিত হয়। জয়চাঁদ তাদের হাতে পুরস্কার হিসেবে খাতা ও কলম তুলে দেন। বিকেল সাড়ে পাঁচটায় বীর মুক্তিযোদ্ধা জয়চাঁদকে সঙ্গে নিয়ে শিশুরা তাদের প্রীতিভোজে অংশ নেয়। পুরো সময় জুড়ে জয়চাঁদ শিশুদের নিয়ে ভীষণ খুশি ছিলেন।