পশুর হাট দুটি বন্ধ রাখার জন্যই অর্ধকোটির বেশি টাকায় ইজারা নেন তাঁরা

পশুর হাট ইজারা নিয়ে এভাবেই ফেলে রাখা হয়েছে। সম্প্রতি রাজশাহী পবা উপেজলার দামকুড়া পশুহাটে
ছবি: প্রথম আলো

রাজশাহীর দামকুড়া ও মহিষালবাড়ী পশুহাট দুটি এখন শুধু কাগজে-কলমে আছে। বাস্তবে ‘মৃত’। কারণ, হাট দুটি প্রতিবছর ইজারা দেওয়া হলেও বেচাকেনার জন্য কোনো গরু–মহিষ তুলতে দেওয়া হয় না। স্থানীয় লোকজন বলছেন, রাজশাহী নগরের একটি হাটকে জমজমাট করতে উপজেলা পর্যায়ের হাট দুটি ইজারা নিয়েও বন্ধ রাখা হচ্ছে। এভাবে হাট দুটি ‘মেরে ফেলে’ পশু কেনাবেচায় একক আধিপত্য ধরে রাখা হচ্ছে।

দামকুড়া হাটটির অবস্থান পবা উপজেলায়। মহিষালবাড়ী হাটটি গোদাগাড়ী পৌরসভার মধ্যে পড়েছে। ১৪৩০ সনের জন্য দামকুড়া পশুহাটটি ৩৭ লাখ টাকা আর মহিষালবাড়ি হাটটি ২৬ লাখ টাকায় ইজারা নিয়েছেন রাজশাহী নগরের বাসিন্দা রেজাউনুর রহমান। তিনি রাজশাহী মহানগরের বোয়ালিয়া থানা (পূর্ব) আওয়ামী লীগের সভাপতি আতিকুর রহমানের ছেলে। এক যুগের বেশি সময় ধরে তাঁরা একই সঙ্গে রাজশাহী নগরের সিটি হাটেরও ইজারাদার।

স্থানীয় লোকজনের ভাষ্য অনুযায়ী, তিন দশক আগে বাংলা ১৪০১ সনে দামকুড়া হাটের ইজারা মূল্য উঠেছিল ২ কোটি ৪ লাখ ৭৮৬ টাকা পর্যন্ত। এক সময় মহিষালবাড়ী হাটও পৌনে ২ কোটি টাকায় ইজারা দেওয়া হয়েছে। এখন সেই হাট শুধুই পড়ে থাকে। গরু-মহিষ ওঠে না।

স্থানীয় লোকজনের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ২০০১ সালে বিএনপি সরকার ক্ষমতায় আসার পরে দামকুড়া হাট থেকে ১০ কিলোমিটার ও মহিষালবাড়ী হাট থেকে প্রায় ৩৫ কিলোমিটার দূরে রাজশাহী নগরে সিটিহাট নামের একটি পশুহাট চালু করা হয়। মহিষালবাড়ী হাট ও দামকুড়াহাট সপ্তাহে রোববার ও বুধবার বসত। সিটি হাটটিও সপ্তাহের একই দিনে বসানো শুরু হয়। একপর্যায়ে প্রভাব খাটিয়ে দামকুড়া হাটে গরু-মহিষ তোলা বন্ধ করে দেওয়া হয়। তখন পবা উপজেলার বিন্দারামপুর গ্রামের খবির উদ্দিন নামের এক ব্যক্তি আদালতে মামলা করেন। এরপর থেকেই হাট ইজারা নিয়ে ফেলে রাখা শুরু হয়, যা এখনো অব্যাহত রয়েছে। এভাবে ফেলে রাখতে রাখতে এক সময় এমনিতেই এই দুটি হাট আর চলবে না বলে মনে করছেন স্থানীয় লোকজন।

মহিষালবাড়ী হাট মানে কী, বিখ্যাত হাট! সিটি হাট করার পর তারা আমাদের ব্রেইনে (বুদ্ধিতে) মেরে দিয়েছে।
ওয়েজ উদ্দিন বিশ্বাস, মেয়র, গোদাগাড়ী পৌরসভা

খবির উদ্দিন প্রথম আলোকে বলেন, দামকুড়া থেকে এই হাট উঠে যাওয়ার পরে এলাকা যেন অন্ধকার হয়ে গেছে। হাটের দুই দিনে দামকুড়া এলাকায় দূরদূরান্ত থেকে হাজার হাজার মানুষ আসতেন। তাঁদের থাকা-খাওয়া আর ব্যবসার ওপর শত শত মানুষ জীবিকা নির্ভর করতেন। কিছু না হলেও দুস্থ নারীরা দুডালি করে গোবর কুড়িয়ে নুন্দা (জ্বালানি) তৈরি করে বিক্রি করতেন। হাট চলে যাওয়ার পরে অনেক মানুষ এলাকা ছেড়ে গেছেন।

রাজশাহীর সিটি হাট

এ রকম জোর করে একটা হাট বন্ধ করে দেওয়ার ব্যাপারে আদালতে মামলা করেছিলেন উল্লেখ করে খবির উদ্দিন বলেন, তারপর বাধ্য হয়ে হাট বসতে দিয়েছিলেন। কিন্তু ১০ থেকে ১২টা হাট হওয়ার পরে তাঁরা বুদ্ধি করে হাট ইজারা নিলেন। কিন্তু বেচাকেনা দামকুড়া থেকে ১০ কিলোমিটার দূরে সিটি হাটেই করতে লাগল। দামকুড়া হাটে কোনো ব্যবসায়ীকে গরু-মহিষ তুলতে দেন না। ইজারা নেওয়া হাট তাঁরা ফেলে রেখেও যদি সরকারকে রাজস্ব দেন, তাহলে আর কারও কিছু বলার নেই।

খবির উদ্দিন বলেন, এই ইজারাদারেরা এই অঞ্চলে গরু-মহিষের ব্যবসার ওপর একক কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করার জন্য এই কাজ করেছেন। একইভাবে পরে মহিষালবাড়ী হাটও বন্ধ করে দেওয়া হয়। এভাবে পড়ে থাকতে থাকতে একসময় এই হাট আর চলবে না।

গত ২৬ মে (শুক্রবার) দামকুড়া হাটে গিয়ে দেখা যায়, বিশাল হাটের জায়গাটা এখন বিরান পড়ে রয়েছে। দুটি বড় হাটচালার পাশ দিয়ে ঘাস গজিয়ে উঠেছে। হাটের শৌচাগারের পাশ দিয়ে জঙ্গল হয়েছে। তবে হাটের মাঠে প্রচুর কাঠের গুঁড়ি পড়ে রয়েছে। স্থানীয় কাঠ ব্যবসায়ীরা এখান কাঠ রেখে ব্যবসা করেন। বেশির ভাগ অংশজুড়ে সড়কের এক ঠিকাদারের নির্মাণসামগ্রী ও যন্ত্রপাতি ফেলে রেখেছেন। একপাশে স্থানীয় লোকজন ইটের খোয়া দিয়ে রিং তৈরি করার জন্য ব্যবহার করেন। সেখানে স্থানীয় মাহলে সম্প্রদায়ের কয়েকজন নারী বসেছিলেন। তাঁদের মধ্যে বয়স্ক নারী লুসিয়া মুর্মু (৫৫) নিজের ভাষায় বললেন, ‘নডে মিটেন আডি ড্যাংরা লাটু হাট তেহে হানা।’ যার অর্থ হচ্ছে, এখানে বড় গরুহাট ছিল।

হাট এভাবে ইজারা নিয়ে ফেলে রাখার ব্যাপারে জানতে চাইলে আওয়ামী লীগ নেতা আতিকুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, তাঁরা সিটি হাটটা ভালোভাবে চালানোর জন্য এই উদ্যোগ নিয়েছেন। সিটি হাটের এই বছরের ইজারা মূল্য ৩ কোটি ৫০ লাখ টাকা। ওই দুটি হাট চললে সিটি হাটের ক্ষতি হবে। একই দিনে হাট। একটা বিশৃঙ্খলা হতে পারে। এটা এড়ানোর জন্য তাঁরা হাট দুটি টাকা দিয়ে ইজারা নিয়ে ফেলে রাখেন। আর কোনো উদ্দেশ্যে নেই। মহিষালবাড়ী হাটে ছাগল বেচাকেনা হয়।

১৪৩০ সনের পবা উপজেলা হাটবাজার ইজারা বিজ্ঞপ্তির ১২টি হাটের মধ্যে প্রথমেই রয়েছে দামকুড়া পশুহাট। উপজেলার মধ্যে এই হাটের ইজারা মূল্য সবচেয়ে বেশি। তবে উপজেলার ১২টি হাটের মধ্যে বিলনেপালপাড়া হাট বসে না বলে ইজারা দেওয়া হয় না উল্লেখ করা হয়েছে। না বসলেও দামকুড়া হাট ঠিকই ইজারা দেওয়া হয়।

এ ব্যাপারে জানতে চাইলে পবা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) লসমী চাকমা প্রথম আলোকে বলেন, প্রতিযোগিতামূলক দরপত্রের মাধ্যমে দামকুড়া পশুহাট ইজারা দেওয়া হয়। প্রতি তিন বছরের গড় ইজারা মূল্যের সঙ্গে আর ৬ শতাংশ যোগ করে প্রতিবছর ডাক দেওয়া হয়। সেই মূল্যেই ইজারাদারেরা প্রতিযোগিতা করেই হাটটি ইজারা নেন। এখন ইজারা নিয়ে হাট ফেলে রাখেন কি না, সেটা তাঁদের দেখার বিষয় নয়।

আজ থেকে ১৫ বছর আগে মহিষালবাড়ী হাটের ডাক পৌনে ২ কোটি টাকা পর্যন্ত উঠেছিল বলে জানালেন গোদাগাড়ী পৌরসভার তৎকালীন ভারপ্রাপ্ত মেয়র ওয়েজ উদ্দিন বিশ্বাস। তিনি এখন গোদাগাড়ী পৌরসভার মেয়র। ওয়েজ উদ্দিন বলেন, ‘মহিষালবাড়ী হাট মানে কী, বিখ্যাত হাট! সিটি হাট করার পর তারা আমাদের ব্রেইনে (বুদ্ধিতে) মেরে দিয়েছে। এই অঞ্চলের অর্থনীতিকে শেষ করে দিয়েছে। আমি বিভিন্নভাবে চেষ্টা করেও এই হাট আর আর লাগতে পারেননি।’