হামলার দুই দিন পর কারাগারের মূল ফটকে বিজিবি, এপিবিএন, আনসার ও পুলিশ সদস্য মোতায়েন করা হয়।
বিক্ষোভকারীরা ১৯ জুলাই শুক্রবার বিকেলে নরসিংদী জেলা কারাগারে হামলা চালান। কারাগারে ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগের পর অস্ত্রাগার থেকে লুটে নেওয়া হয় অস্ত্র। এতে পুরো কারাগার অরক্ষিত হয়ে পড়ে। সেই সুযোগে পালিয়ে যান ৮২৬ জন আসামি। কারাগারের ওই অরক্ষিত অবস্থা ছিল দুই দিন। ওই সময় কারাগার থেকে নানা জিনিসপত্র নিয়ে যান অনেকে।
দুই দিন পর নিরাপত্তা
নরসিংদী জেলা কারাগারে হামলা নিয়ে স্থানীয় অন্তত ১৫ প্রত্যক্ষদর্শীর সঙ্গে কথা হয় প্রথম আলোর দুই প্রতিবেদকের। তাঁরা বলেন, হামলার দিন বিক্ষোভকারীদের অবস্থান ছিল নরসিংদীর ভেলানগরের জেলখানার মোড়ে। মোড় থেকে ২৫ গজের মধ্যে কারাগারের মূল ফটক। আর পুলিশের অবস্থান ছিল স্টেডিয়ামের সামনের সড়কে। বিক্ষোভকারীদের সংখ্যা বেশি হওয়ায় পুলিশ তাঁদের ছত্রভঙ্গ করতে পারেনি।
প্রত্যক্ষদর্শীরা বলেন, হামলার পর দুই দিন পর্যন্ত অরক্ষিত ছিল কারাগার। সেই সময় কারাগারের গুদাম থেকে চাল, ডাল এমনকি বৈদ্যুতিক পাখা ও বাতিও খুলে নিয়ে যান অনেকে। রোববার কিছু কারারক্ষী কারাগার এলাকায় দায়িত্ব পালন করলেও নিরাপত্তা দেওয়ার জন্য তা পর্যাপ্ত ছিল না। পরে ২২ জুলাই সোমবার থেকে কারাগারের মূল ফটকে বিজিবি, এপিবিএন, আনসার ও পুলিশ সদস্য মোতায়েন
করা হয়।
হামলার পর দুই দিন কারাগার অরক্ষিত থাকা প্রসঙ্গে জেলা পুলিশ সুপার মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, তাঁদের আশঙ্কা ছিল জেলার আরও কিছু গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনায় হামলা হতে পারে। তাঁরা সেসব স্থাপনার সুরক্ষা দিতে ব্যস্ত ছিলেন। তা ছাড়া কারাগারে হামলার পরের দুই দিনও আন্দোলনকারীরা রাস্তায় ছিলেন। সে কারণে কারাগারের দিকে তাঁরা সেভাবে মনোযোগ দিতে পারেননি।
শার্ট খুলে অস্ত্র ঢেকে পালিয়ে যায় অনেকে
কারাগার এলাকার একটি বহুতল ভবনের নিরাপত্তাকর্মী নাম প্রকাশ না করার শর্তে প্রথম আলোকে বলেন, শুরুতে কয়েকজন বিক্ষোভকারী কারাগার লক্ষ্য করে ইটপাটকেল ছুড়তে থাকেন। কয়েক মিনিটের মধ্যে শত শত লোক তাঁদের সঙ্গে যুক্ত হন। এর কিছুক্ষণ পর কারাগারের ভেতরে আগুন জ্বলতে দেখা যায়। এরপর আসামিরা ব্যাগ হাতে বেরিয়ে বিভিন্ন দিকে চলে যান। তিনি বলেন, তিনি অনেককে গায়ের শার্ট খুলে অস্ত্র ঢেকে পালিয়ে যেতে দেখেছেন।
এদিকে নাম প্রকাশ না করার শর্তে প্রশাসনের একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা প্রথম আলোকে বলেন, কারাগারে এত বড় হামলার ঘটনা ঘটলেও কারারক্ষীরা প্রতিহত করার চেষ্টা করেননি।
উদ্ধার হয়নি ৪০ অস্ত্র
কারাগারের অস্ত্রাগার থেকে লুট হওয়া ৮৫টি অস্ত্রের মধ্য থেকে ৪৫টি অস্ত্র উদ্ধার করেছে নরসিংদী জেলা পুলিশ। বাকি ৪০টি অস্ত্র এখনো উদ্ধার হয়নি। নরসিংদী জেলা পুলিশ সুপার মোহাম্মদ মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, তাঁরা ২০টি রাইফেল, ১০টি শটগানসহ ৪৫টি অস্ত্র ও ১ হাজার ৯১টি গুলি উদ্ধার করেছেন।
স্থানীয় প্রশাসনের একটি সূত্র বলছে, কারাগারের অস্ত্রের মধ্যে প্রায় ১৫ অস্ত্র পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। কারাগারের ভেতরে অস্ত্র পোড়ানোর একটি ছবিও তাঁদের হাতে এসেছে। বিষয়টি নিয়ে তদন্ত চলছে।
জেলা প্রশাসন ও পুলিশ সূত্র জানায়, পলাতক আসামিদের মধ্যে গত শুক্রবার বিকেল পর্যন্ত ৪৮১ জন আদালতে আত্মসমর্পণ করেছেন।
পলাতক আসামিদের মধ্যে ছিলেন ৯ জঙ্গি
কারাগার সূত্র জানায়, পালিয়ে যাওয়া আসামিদের মধ্যে নয়জন ছিলেন দুটি নিষিদ্ধ ঘোষিত জঙ্গি সংগঠনের সদস্য। তাঁদের মধ্যে দুজন ছিলেন নারী। তাঁরা জেএমবির সদস্য। তাঁরা ঢাকার একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী ছিলেন। বাকি সাতজন আনসার উল্লাহ বাংলা টিমের সদস্য। তাঁদের বিরুদ্ধে সন্ত্রাসবিরোধী আইনে মামলা রয়েছে।
পুলিশ সূত্র জানায়, পালিয়ে যাওয়া জঙ্গিদের মধ্য থেকে চারজনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। গ্রেপ্তার হওয়া ও আত্মসমর্পণ করা আসামিদের গাজীপুর ও কিশোরগঞ্জের কারাগারে রাখা হয়েছে।
কারাগারের কাছে ছয় মাইক্রোবাস
পুলিশের একটি সূত্র জানায়, ঘটনার দিন কারাগারের কাছে ছয়টি মাইক্রোবাস অপেক্ষা করতে দেখা গেছে। হামলার পর আসামিরা কারাগার থেকে বের হওয়ার পর মাইক্রোবাসগুলো আর দেখা যায়নি। গাড়িগুলো কোথা থেকে এসেছিল, পরে কোনদিকে গেছে, সেগুলো যাচাই-বাছাই করে দেখা হচ্ছে।
নরসিংদী জেলা ডিবির ওসি খোকন চন্দ্র সরকার বলেন, বিষয়টি তাঁরা তদন্ত করে দেখছেন।
‘এটা পরিকল্পিত হামলা’
হামলার ধরন, অস্ত্র ও আসামি লুটের এই ঘটনাকে পরিকল্পিত বলে মনে করেন নরসিংদী জেলা প্রশাসক বদিউল আলম। গতকাল শনিবার তিনি প্রথম আলোকে বলেন, পূর্বপরিকল্পনা ছাড়া এভাবে কারাগারে হামলা করে অস্ত্র লুট ও আসামি ছিনিয়ে নেওয়া সম্ভব নয়। তিনি বলেন, কারাগার দ্রুত ঠিক করে আসামি রাখার ব্যবস্থা করা হচ্ছে। ইতিমধ্যে বিদ্যুৎ, পানি ও গ্যাসের সরবরাহ নিশ্চিত করা হয়েছে। বন্দী রাখার ওয়ার্ড পরিষ্কার করা হয়েছে। নতুন করে ৩২টি সিসি ক্যামেরা স্থাপন করা হয়েছে।