কোটা আন্দোলনকারীদের ওপর ছাত্রলীগের হামলার বিচারের দাবিতে উপাচার্যের বাসভবনের সামনে শিক্ষার্থীদের অবস্থান। সোমবার রাত সোয়া ৯টার দিকে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে
কোটা আন্দোলনকারীদের ওপর ছাত্রলীগের হামলার বিচারের দাবিতে উপাচার্যের বাসভবনের সামনে শিক্ষার্থীদের অবস্থান। সোমবার রাত সোয়া ৯টার দিকে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে

সন্ধ্যায় ছাত্রলীগের হামলা দিয়ে শুরু, ভোরে জলকামান নিয়ে পুলিশের ধাওয়া

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে গতকাল সোমবার সন্ধ্যায় আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদের ওপর হামলা করেন বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীরা। পরে দুই পক্ষের মধ্যে পাল্টাপাল্টি ধাওয়ার ঘটনা ঘটে। গভীর রাতে উপচার্যের বাসভবন চত্বরে শিক্ষার্থীদের ওপর পেট্রলবোমা ও দেশি অস্ত্র নিয়ে হামলা এবং মারধর করা হয়। পরে পুলিশ এসে কাঁদানে গ্যাসের সেল ও ছররা গুলি ছোড়ে। এ ঘটনায় শতাধিক শিক্ষার্থী আহত হয়েছেন।

এ ছাড়া ঘটনাস্থলে উপস্থিত চার-পাঁচজন শিক্ষক ও সাতজন সাংবাদিক আহত হন। চোখে ছররা গুলি লেগে গুরুতর আহত হয়েছেন এক শিক্ষক। আহত ব্যক্তিদের মধ্যে বেশির ভাগই বিশ্ববিদ্যালয়ের চিকিৎসাকেন্দ্রে চিকিৎসা নিয়েছেন। আর গুরুতর আহত ব্যক্তিদের সাভারের বিভিন্ন বেসরকারি হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে।

হামলা হয় যেভাবে
প্রত্যক্ষদর্শী কয়েকজন জানান, গতকাল সন্ধ্যায় কোটা সংস্কার আন্দোলনকারীদের বিক্ষোভ মিছিলে প্রথম দফায় ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীরা হামলা চালান। এর প্রতিবাদে আন্দোলনকারীরা রাত পৌনে নয়টার দিকে উপাচার্য নূরুল আলমের বাসভবনের সামনে বিক্ষোভ শুরু করেন। সাড়ে ১০টার দিকে উপাচার্যসহ প্রশাসনের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা আন্দোলনকারীদের সঙ্গে কথা বলেন। তবে আন্দোলনকারীরা তাঁদের বিক্ষোভ চালিয়ে যান। একপর্যায়ে রাত ১২টার দিকে আন্দোলনকারীদের ওপর ছাত্রলীগের নেতা-কর্মী ও বহিরাগত সন্ত্রাসীরা মিলে আবার হামলা করতে পারে এমন খবরে উপাচার্যের বাসভবন চত্বরে (সীমানাপ্রাচীরের মধ্যে) অবস্থান নেনআন্দোলনকারীরা।

উপাচার্যের বাসভব চত্বরে আশ্রয় নেওয়ার ১০ মিনিট পর বাসভবনের সামনে বহিরাগত সন্ত্রাসীসহ শাখা ছাত্রলীগের দেড় শতাধিক নেতা-কর্মী উপস্থিত হন। তাঁরা উপাচার্যের বাসভবনের প্রাচীরের মূল ফটকের ওপাশ থেকে আন্দোলনকারীদের লক্ষ্য করে কাচের বোতল ও ইটপাটকেল ছুড়তে থাকেন।

ছাত্রলীগের হামলা, নিশ্চুপ পুলিশ
রাত সোয়া ১২টার দিকে ঘটনাস্থলে আসে পুলিশ। ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীরা উপাচার্যের বাসভবনের প্রধান ফটক ছেড়ে পাশে মাঠে অবস্থান নেন। অন্যদিকে বাসভবনের প্রধান ফটকের সামনে পুলিশ অবস্থান নেয়। আন্দোলনকারীরা বাসভবন চত্বরে ছিলেন। রাত পৌনে দুইটার দিকে পুলিশের সামনে ফটক ভেঙে বাসভবনের ভেতরে প্রবেশ করেন হামলাকারীরা। এ সময় বেশ কয়েকটি পেট্রলবোমা ছুড়ে বাসভবনের প্রধান ফটকের লাইটসহ বিভিন্ন লাইট ভাঙচুর করেন তাঁরা। এরপর আন্দোলনকারীদের মারধর করেন ছাত্রলীগের নেতা–কর্মীরা। এ সময় উপাচার্য বাসভবনেই ছিলেন। হামলাকারীরা পুলিশের উপস্থিতিতে আন্দোলনকারীদের ওপর হামলা চালালেও পুলিশ তাদের বাধা দেয়নি বলে অভিযোগ উঠেছে। তবে পরে হামলাকারীদের কয়েকজনকে সরিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করেন পুলিশ সদস্যরা।

হামলায় আহত শিক্ষার্থীদের হাসপাতালে নেওয়া হয়

ফেসবুক লাইভে বাঁচার আকুতি
রাত সোয়া দুইটার দিকে উপাচার্যের বাসভবন চত্বরে আশ্রয় নেওয়া একজন শিক্ষার্থী ফেসবুক লাইভে গিয়ে ঘটনার বিবরণ দিয়ে ক্যাম্পাসে অবস্থানরত অন্যান্য শিক্ষার্থী ও আশপাশের মানুষের সহযোগিতা চান। ভিডিওতে ওই শিক্ষার্থীর আশপাশে আহত শিক্ষার্থীদের আর্তনাদ করতে দেখা যায়। তাঁদের উদ্ধারে আকুতি জানিয়ে কান্নাকাটি করতে দেখা যায়।

ছাত্রলীগের নেতা–কর্মীদের ধাওয়া
আন্দোলনকারীদের ওপর হামলার পর বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন হল থেকে সাধারণ শিক্ষার্থীরা বিক্ষোভ মিছিল নিয়ে উপাচার্য বাসভবনের সামনে আসেন। এ সময় তাঁরা ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীদের ধাওয়া দেন। তখন তাঁরা বিশ্ববিদ্যালয়ের আমবাগান ফটক দিয়ে পালিয়ে যান। পরে সেখানে অবস্থানরত পুলিশের ওপর চড়াও হন বিক্ষুব্ধ শিক্ষার্থীরা। বেশ কয়েকজন পুলিশ সদস্যকে পিটুনি দেন তাঁরা। বিক্ষুব্ধ শিক্ষার্থীদের ছত্রভঙ্গ করতে উপাচার্যের বাসভবন চত্বরে কাঁদানে গ্যাসের ১০-১৫টি সেল ছোড়ে পুলিশ। এ ছাড়া শিক্ষার্থীদের লাঠিপেটা করা হয়। শিক্ষার্থীরা ছত্রভঙ্গ হয়ে ক্যাম্পাসের বিভিন্ন স্থানে অবস্থান নেন।

সাংবাদিকদের প্রতি মারমুখী ছাত্রলীগ-পুলিশ
হামলার শুরু থেকেই সাংবাদিকদের ওপর মারমুখী ছিলেন ছাত্রলীগের নেতা–কর্মীরা। হামলাকারীরা উপাচার্যের বাসভবনের ভেতরে ঢোকার আগে ইটপাটকেল ও কাচের বোতল ছুড়ে ধাওয়া দেন সাংবাদিকদের। পরে সাংবাদিকেরা সেখান থেকে সরে যান। এ ছাড়া হামলা চলাকালে শাখা ছাত্রলীগের নেতা–কর্মীরা ধারালো অস্ত্র নিয়ে একাধিকবার সাংবাদিকদের দিকে তেড়ে যান এবং অশ্লীল ভাষায় গালিগালাজ করেন। হামলায় আহত হয়েছেন বণিক বার্তার জাবি প্রতিনিধি মেহদি মামুন, দৈনিক বাংলায় কর্মরত আবদুর রহমান সার্জিল, বাংলাদেশ টুডের জোবায়ের আহমেদ, সময়ের আলোর কর্মরত মুশফিকুর রিজওয়ান, বিডিনিউজ২৪ডটকমের হাসিবুর রহমান, দৈনিক জনকণ্ঠের ওয়াজহেতুল ইসলাম ও একটি অনলাইন পোর্টালের সাকিব আহমেদ।

ইটপাটকেল ও পুলিশের কাঁদানে গ্যাসের সেলে সেখানে চার-পাঁচজন শিক্ষক আহত হয়েছেন। আমি মাথায় আঘাত পেয়েছি।
অধ্যাপক মাফরুহি সাত্তার, ফার্মেসি বিভাগ

ছররা গুলিতে শিক্ষক আহত
উপাচার্যের বাসভবন চত্বরে পুলিশের ছররা গুলিতে আহত হয়েছেন ইতিহাস বিভাগের অধ্যাপক লুৎফুল এলাহী। তাঁর শরীর ও ডান চোখে ছররা গুলি লেগেছে। তাঁকে সাভারের বেসরকারি এনাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে। হাসপাতালের চক্ষু বিভাগের প্রধান মোতাহার হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, ওই শিক্ষকের শরীরে ও ডান চোখে ছররা গুলি লেগেছে। তাঁকে উন্নত চিকিৎসার জন্য ঢাকার জাতীয় চক্ষুবিজ্ঞান ইনস্টিটিউটে নেওয়ার পরামর্শ দেওয়া হয়েছে।

ফার্মেসি বিভাগের অধ্যাপক মাফরুহি সাত্তার জানান, ‘উপাচার্যের বাসার সামনের বারান্দায় আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীরা অবস্থান নিয়েছিলেন। হামলা থেকে রক্ষা পেতে তাঁরা চেয়ার দিয়ে ঢাল তৈরি করেছিলেন। যখন তাঁদের ওপর হামলা হয়, তখন পুলিশের কয়েকজন সদস্য হামলাকারীদের ধাওয়া দেন। ইটপাটকেল ও পুলিশের কাঁদানে গ্যাসের সেলে সেখানে চার-পাঁচজন শিক্ষক আহত হয়েছেন। আমি মাথায় আঘাত পেয়েছি।’  

জলকামান নিয়ে শিক্ষার্থীদের ধাওয়া
রাত সাড়ে তিনটার দিকে ঘটনাস্থলে পুলিশ একটি জলকামান নিয়ে আসে। আজ ভোর চারটার দিকে পুলিশ জলকামান নিয়ে শিক্ষার্থীদের ধাওয়া দেয়। এ সময় পুলিশ শিক্ষার্থীদের লক্ষ্য করে কাঁদানে গ্যাসের সেল ও ছররা গুলি ছুড়তে থাকে। বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় চিকিৎসাকেন্দ্রের সামনে শিক্ষার্থীদেরর লক্ষ্য করে পুলিশ টিয়ার শেলও ছোড়ে।

এদিকে রাত পৌনে চারটার দিকে ঘটনাস্থলে উপস্থিত হন ঢাকা জেলার পুলিশ সুপার মো. আসাদুজ্জামান। এ সময় তিনি সাংবাদিকদের বিভিন্ন প্রশ্নের উত্তর দেন। তিনি বলেন, শিক্ষার্থীদের দুটি পক্ষ উপাচার্যের বাসভবনের সামনে অবস্থান নিয়েছেন জানতে পেরে উপাচার্যের সঙ্গে কথা বলে পুলিশ। এরপর আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি স্বাভাবিক রাখতে ক্যাম্পাসে প্রবেশ করেন তাঁরা। উভয় পক্ষের সঙ্গে কথা বলে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রাখার চেষ্টা করা হয়। পরে পরিস্থিতি অস্বাভাবিক হলে শিক্ষার্থীদের সরিয়ে দিতে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেওয়া হয়। শিক্ষার্থীদের হামলায় পুলিশের বেশ কয়েকজন সদস্য আহত হয়েছেন।