কেটে ফেলা একটি সেগুনগাছের গোড়ায় লাগানো এক টুকরা কাগজে লেখা ‘আমার মৃত্যুর জন্য অপরিকল্পিত উন্নয়ন দায়ী।’ আরেকটি গাছের গোড়ায় কোপ দেওয়া হয়েছে। সেই গাছের গোড়ায় লাগানো কাগজে লেখা রয়েছে, ‘গাছেরও আছে প্রাণ, এ কথা কেন বারবার ভুলে যান।’
রাজশাহীতে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার নির্মাণের জন্য গাছ কাটার প্রতিবাদে আয়োজিত ‘শোকসভায়’ গিয়ে দেখা গেল এই চিত্র। আজ শুক্রবার বেলা ১১টায় নগরের রাজারহাতা এলাকায় এই ‘শোকসভার’ আয়োজন করে রাজশাহী পরিবেশ আন্দোলন ঐক্য পরিষদ।
সভায় বক্তারা বলেন, গাছ কেটে, পরিবেশ ধ্বংস করে কোনো উন্নয়ন নয়। পরিবেশ ধ্বংসকারী উন্নয়ন মানুষের কোনো কাজে আসে না। তাঁরা রাজশাহী জেলা পরিষদের চেয়ারম্যানকে এই গাছ কাটার জন্য প্রতিশ্রুতি ভঙ্গকারী, গাছ হত্যাকারী ও পাখি হত্যাকারী বলে অভিযুক্ত করেন। এ জন্য তাঁরা তাঁকে রাজশাহীসহ দেশবাসীর কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করে বাকি একটি গাছেও হাত না দেওয়া আহ্বান জানান। তাঁরা বলেন, এই শহর কারও একার নয়। সবার সঙ্গে আলোচনা করে উন্নয়ন করতে হবে। এ শোক গাছের জন্য প্রকৃতি ও প্রতিবেশের জন্য।
কর্মসূচিতে অংশগ্রহণকারীরা আজ বেলা ১১টায় কালো কাপড় হাতে নিয়ে রাজারহাতা এলাকায় কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার নির্মাণের জন্য নির্ধারিত স্থানের পাশে দাঁড়িয়ে যান। তাঁদের হাতে একটি করে লিফলেট ধরা ছিল। এসবে লেখা ছিল, ‘গাছ-পাখি-মানুষের সহাবস্থান চাই’, ‘বৃক্ষ হত্যায় আমরা শোকাহত, বৃক্ষ ও প্রাণবৈচিত্র্য সুরক্ষা করেই উন্নয়ন হোক’, ‘আমি গাছ হত্যার বিচার চাই’, ‘রাজশাহীর উন্নয়নে বৃক্ষ হত্যা বন্ধ কর’ ইত্যাদি।
কর্মসূচিতে রাষ্ট্র সংস্কার আন্দোলনের রাজশাহী বিভাগীয় সমন্বয়ক মাহমুদ জামাল কাদেরী বলেন, ‘তীব্র তাপপ্রবাহের মধ্যে গাছ কেটে উন্নয়ন করছি, এতে মানুষের কী উপকার হবে? পরিবেশবিরোধী উন্নয়ন টেকসই হয় না, মানুষেরও কাজে আসে না। পরিবেশ-প্রকৃতি ধ্বংসের ফল কখনো ভালো হয় না। ঋণ করে ঘি খাওয়ার উন্নয়ন আমরা চাই না।’
সভায় রাজশাহী পরিবেশ আন্দোলন ঐক্য পরিষদের আহ্বায়ক মাহাবুব টুংকু বলেন, গাছগুলো শহীদ মিনারে নকশায় এনে সবুজ ঘাসের গালিচা রাখার জন্য তাঁরা জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান বীর মুক্তিযোদ্ধা মীর ইকবালকে অনুরোধ জানিয়েছিলেন। তিনি কথা দিয়েছিলেন। কিন্তু গতকাল বৃহস্পতিবার সকাল থেকে গাছ কাটা শুরু করা হয়। তাঁরা একটু দেরিতে খবর পেয়ে এসে দেখেন ইতিমধ্যে তিনটা শতবর্ষী গাছ কেটে ফেলা হয়েছে। একটি গাছের ডালপালা ছেঁটে ফেলা হয়েছে। আরও একটির গোড়ায় কোপ দেওয়া হয়েছে।
মাহাবুব টুংকু বলেন, ‘আজকের এই শোকসভা গাছের জন্য, পরিবেশের জন্য। এই রকম একটি গাছ তৈরি করতে মানুষের পুরোটা জীবন লেগে যায়। উন্নয়নের ডামাডোলে গাছের জীবন রক্ষা পায় না। একদিন রাজশাহী শহর শতবর্ষী বৃক্ষ শূন্য হয়ে যাবে। গাছ দেখতে আমাদের অন্য কোথাও যেতে হবে।’
বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা বারসিক এর আঞ্চলিক সমন্বয়কারী শহিদুল ইসলাম বলেন, ‘এই শহর কারও একার নয় যে যা খুশি তাই করবেন। শহর সবার। সবার মতামত নিয়ে উন্নয়ন করতে হবে।’
সবুজ গালিচার বদলে গাছ কেটে শহীদ মিনার চত্বরে টাইলস বসানোর প্রসঙ্গ টেনে রাজশাহী পরিবেশ আন্দোলন ঐক্য পরিষদের সদস্যসচিব নাজমুল হোসেন বলেন, সারা পৃথিবীতে পার্ক সব সময় পরিবেশবান্ধব হয়। সেখানে ৩০ শতাংশ কংক্রিট আর ৭০ শতাংশ ইকো-ফ্রেন্ডলি করা হয়। আর এখানে ঘাস বাদ দিয়ে টাইলস লাগানো হবে। তিনি বলেন, ‘রাজশাহীকে গ্রিনসিটি বলা হয়। আপনারা গাছ কেটে গ্রিনসিটির কী নমুনা দেখাচ্ছেন।’
জাতীয় আদিবাসী পরিষদের নেতা সুবাস চন্দ্র হেমব্রম বলেন, প্রতিদিন এই শহরের তাপমাত্রা বেড়ে যাচ্ছে। নদীর নাব্যতা কমে যাচ্ছে। ভূগর্ভস্থ পানির স্তর নিচে নেমে যাচ্ছে। গাছ পরিবেশ সুরক্ষা দেয় আর পানির স্তর ধরে রাখতেও ভূমি রাখে। সেই গাছকে হত্যা করা হয়েছে। তিনি এই হত্যাকণ্ডের তীব্র নিন্দা জানিয়ে দাবি করেন।
শোকসভাটি সঞ্চালনা করে ইয়ূথ অ্যাকশন ফর সোশ্যাল চেঞ্জ–ইয়্যাসের সভাপতি শামীউল আলীম।
গাছ কেটে শহীদ মিনার নির্মাণের সিদ্ধান্তের কথা জানতে পেরে বেশ কয়েক দিন ধরেই প্রতিবাদ করে আসছিল রাজশাহী পরিবেশ আন্দোলন ঐক্য পরিষদ। গত ২২ মে সংগঠনটির নেতা-কর্মীরা শহীদ মিনার নির্মাণের নির্ধারিত স্থানে সমাবেশ করেন। এরপর ২৫ মে তাঁরা জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান বীর মুক্তিযোদ্ধা মীর ইকবালের সঙ্গেও দেখা করেন। গাছ না কাটার দাবিতে স্মারকলিপি দেন। সংগঠনের সদস্যদের দাবি, সেদিন চেয়ারম্যান গাছ রেখেই নকশা বদলে শহীদ মিনার নির্মাণের কথা বলেছিলেন।
৬ জুন জেলা পরিষদ পাঁচটি বড় বড় গাছ বিক্রির দরপত্র আহ্বান করে। দরপত্রে ১ লাখ ৭১ হাজার টাকায় গাছগুলো ‘মেসার্স মেঘনা এন্টারপ্রাইজ’ নামের একটি প্রতিষ্ঠান কিনে নেয়। বৃহস্পতিবার সকাল থেকে গাছের ক্রেতা নগরের সাগরপাড়া এলাকার বাসিন্দা মো. সুমন শ্রমিকদের নিয়ে গাছ কাটা শুরু করেন।