পিটিয়ে ১০ জনকে হত্যার পর ডুবিয়ে দেওয়া হয় ট্রলার

এই ট্রলার থেকে অর্ধগলিত ১০ জেলের লাশ উদ্ধার করা হয়। সম্প্রতি কক্সবাজার শহরের নাজিরারটেক উপকূলে
 প্রথম আলো ফাইল ছবি

কক্সবাজারে ডুবন্ত ট্রলারে অর্ধগলিত ১০ জনের লাশ উদ্ধারের ঘটনায় করা মামলায় গ্রেপ্তার আরেক আসামি কামাল হোসেন ওরফে বাইট্যা কামাল আদালতে ১৬৪ ধারায় জবানবন্দি দিয়েছেন। তিনি মামলার ১ নম্বর আসামি। কামাল হোসেন বলেছেন, ঘটনার সময় তিনি কক্সবাজার শহরে ছিলেন। তবে ট্রলারের মাঝিমাল্লাদের সঙ্গে তাঁর কয়েক দফার কথায় নিশ্চিত হয়েছেন ১০ জনের ট্রলারটি সাগরে ডাকাতি করতে নেমেছিল। ডাকাতির একপর্যায়ে কয়েকটি ট্রলারের জেলেরা ১০ জেলেকে ধরে প্রথমে গণপিটুনি দেন। এরপর গুম করার জন্য লাশগুলো বরফ রাখার কক্ষে আটকে রেখে ছোট ট্রলারটি (ডুবন্ত ট্রলার) সাগরে ডুবিয়ে দেওয়া হয়।

গতকাল সোমবার সন্ধ্যায় কামাল হোসেনের জবানবন্দি রেকর্ড করেন কক্সবাজার সিনিয়র জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আখতার জাবেদ। আগের দিন একই মামলার দুই আসামি (ট্রলারের মাঝি) আবু তৈয়ূব ও ফজল কাদের আদালতে ১৬৪ ধারায় জবানবন্দি দেন। তাঁরা বলেছেন, ঘটনাটি তাঁদের চোখের সামনে ঘটেছে, তবে তাঁরা জড়িত ছিলেন না। ওই দুই মাঝির জবানবন্দি রেকর্ড করেন কক্সবাজার সিনিয়র জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট শ্রীজ্ঞান তঞ্চঙ্গ্যা। ফজল ও তৈয়ূবের বাড়ি চট্টগ্রামের বাঁশখালী উপজেলার কুদুকখালী গ্রামে।

পুলিশের একটি সূত্র জানায়, জবানবন্দিতে কামাল হোসেন বলেছেন, তাঁর মাছ ধরার ট্রলারের ব্যবসা আছে। বর্তমানে একটি ভাসা জালের ট্রলার আছে। ৯ এপ্রিল সন্ধ্যায় তিনি জানতে পারেন সমুদ্রে তাঁর ভাই আনোয়ারের (মামলার পলাতক আসামি) ট্রলারে ডাকাতি হয়েছে। এরপর মাতারবাড়ীর আবদুল গফুর, সাগরে থাকা দুই ট্রলারের জেলে বেলাল ও আক্কাসের সঙ্গে মুঠোফোনে কথা বলে নিশ্চিত হন আনোয়ারের ট্রলারে ডাকাতি হয়েছে। ১০ এপ্রিল সকালে আক্কাসের সঙ্গে তাঁর দ্বিতীয় দফায় আরও ১৫ মিনিট কথা হয়। তখন আক্কাস ঘটনার বিস্তারিত তাঁকে তুলে ধরেন। আক্কাস তখন ঘটনাস্থলে ট্রলারে ছিলেন।

কামাল হোসেন জবানবন্দিতে বলেছেন, ৯ এপ্রিল দিবাগত রাত সাড়ে তিনটার দিকে আনোয়ারের ট্রলার সাগরে জাল ফেলে। হঠাৎ এই ট্রলারের (আনোয়ারের) পাশে ভেড়ে আরেকটি ছোট ট্রলার। তখন আনোয়ারের ট্রলারের জেলে ফোরকান টর্চলাইট মেরে কাছে ভেড়ার কারণ জানতে চান। কিছু বুঝতে না দিয়ে ছোট ট্রলারের (ডাকাতদের বোট) লোকজন দা, কিরিচ, রড ও বন্দুক নিয়ে আনোয়ারের ট্রলারে উঠে পড়ে এবং আনোয়ারের ট্রলারের জেলেদের এলোপাতাড়ি মারতে থাকে। একপর্যায়ে কায়সার ও জয়নাল মাঝি ছাড়া অবশিষ্ট জেলেদের জাল রাখার কক্ষে ঢুকিয়ে রাখে। এরপর ডাকাতেরা কায়সারকে (আনোয়ারের ট্রলারের চালক) ট্রলারের ইঞ্জিন চালু করতে বাধ্য করে। জয়নাল মাঝিকে ট্রলার চালাতে বাধ্য করে ডাকাতেরা।

ট্রলারটি পূর্ব-উত্তরে কিছু দূর যাওয়ার পর ডাকাতেরা জয়নাল ও কায়সারকে রেখে ট্রলারের অবশিষ্ট জেলেদের সাগরে ফেলে (নিক্ষেপ) দেয়। তারপর ডাকাতেরা আনোয়ারের ট্রলার অন্য একটি ট্রলারের সঙ্গে ভেড়াতে বলেন। তাতে দেরি হওয়ায় ওই ট্রলারটি দ্রুত সরে পড়ে। এতে ক্ষুব্ধ হয়ে ডাকাতেরা জয়নাল ও কায়সারকেও মারধর করে সাগরে নিক্ষেপ করে। এ সময় আনোয়ারের ট্রলারে ডাকাত ছাড়া অন্য কেউ ছিল না।

মামলার ১ নম্বর আসামি কামাল হোসেন ওরফে বাইট্যা কামাল

পুলিশের সূত্রটি প্রথম আলোকে আরও জানায়, জবানবন্দিতে মহেশখালীর মাতারবাড়ীর সাইরারডেইল এলাকার কামাল হোসেন বলেন, এরপর ডাকাতেরা আনোয়ারের ট্রলারের সঙ্গে তাদের (ডাকাতের) ছোট ট্রলারটি বেঁধে উত্তর-পূর্ব দিকে যাচ্ছিল। তখন সামনে পড়ে আফসার মাঝি ও বাবুল মাঝির দুই ট্রলার। দুই মাঝি আনোয়ারের ট্রলার চিনতে পেরে কাছে ভেড়ানোর চেষ্টা করে। তাতে বাধা দেয় ডাকাতেরা। সন্দেহ হলে আনোয়ারের ট্রলারের জেলে জয়নাল, কায়সার ও মালিক আনোয়ারকে নাম ধরে ডাকতে থাকেন। তাতেও সাড়াশব্দ না পেলে আফসার ও বাবুল মাঝির সন্দেহ হয়। এরপর বাবুল মাঝির ট্রলারটি ভেড়ানোর চেষ্টা করলে ডাকাতেরা গুলি ছুড়তে থাকে। উপায় না দেখে বাবুল মাঝি ও আফসার মাঝি বাঁশের মাথায় কাপড় বেঁধে ট্রলারে তুলে দেয়। এটি একধরনের বিপৎসংকেত।

বিপৎসংকেত দেখানোর ২০-৩০ মিনিটের মধ্যে ঘটনাস্থলে পৌঁছায় ১০-১২টি ট্রলার। ট্রলারগুলো ডাকাতের ট্রলারটি চারদিক থেকে ঘিরে ফেললে ডাকাতেরা এলোপাতাড়ি গুলি ছুড়তে থাকে। অবস্থা বেগতিক দেখে একপর্যায়ে ডাকাতেরা আনোয়ারের ট্রলারের বাঁধা নিজেদের ছোট ট্রলারটি রশি কেটে দিয়ে বিচ্ছিন্ন করে দেয়। এরপর আনোয়ারের ট্রলার নিয়ে ডাকাতের পালাতে থাকে। তখন অন্যান্য ট্রলারের জেলেরা ডাকাতদের ধাওয়া করে। একপর্যায়ে ডাকাতদের ট্রলারের জ্বালানি তেল শেষ হয়। চট্টগ্রামের বাঁশখালী ও কুতুবদিয়ার দুটি ট্রলার দুই পাশ থেকে ঘিরে ডাকাতের ট্রলারটি (আনোয়ারের) আটকায় এবং ডাকাতদের হাত–পা রশি দিয়ে বেঁধে ফেলে। এরপর বাঁশখালী ও কুতুবদিয়ার দুটি ট্রলারের সঙ্গে বাবুল মাঝি, আফসার মাঝি, আমান উল্লাহ ও আনোয়ারের ট্রলারের জেলেরা (সাগরে নিক্ষেপের পর অন্য ট্রলার কর্তৃক উদ্ধার) ডাকাতদের চারদিক ঘিরে ধরে বাঁশ, বরফ ভাঙার মুগুর, লাকড়ি দিয়ে গণপিটুনি দেন। এই পিটুনিতে ডাকাতদের মৃত্যু হয়।

এরপর আফসার মাঝি, বাবুল মাঝি, আমান উল্লাহ মাঝি, আনোয়ার মাঝি ও অন্যান্য ট্রলারের জেলেরা (অন্তত ৬০ জন) সাগরে ভাসমান ডাকাতদের ছোট ট্রলারটি খুঁজে নেন। তারপর ডাকাতের লাশগুলো ছোট ট্রলারের মাছ রাখার কক্ষে ঢুকিয়ে ঢাকনা দিয়ে মুখ বন্ধ করেন। তারপর লাশ গুম করার উদ্দেশ্যে ট্রলারটি সমুদ্রে ডুবিয়ে দেওয়া হয়।

গত ২৩ এপ্রিল বিকেলে শহরের নাজিরারটেক উপকূলে ডুবন্ত একটি মাছ ধরার ট্রলার থেকে ১০ জনের অর্ধগলিত লাশ উদ্ধার করে পুলিশ ও ফায়ার সার্ভিস। ২৫ এপ্রিল কক্সবাজার সদর মডেল থানায় এজাহারনামীয় চারজন (মহেশখালীর মাতারবাড়ীর বাইট্যা কামাল, করিম সিকদার, আনোয়ার হোসেন ও বাবুল মাঝি) এবং অজ্ঞাতনামা আরও ৫০ থেকে ৬০ জনকে আসামি করে মামলা করেন ডুবন্ত ট্রলারের মালিক ও মহেশখালীর হোয়ানক ইউনিয়নের বাসিন্দা নিহত সামশুল আলমের স্ত্রী রোকিয়া আকতার।

মামলার এজাহারে বলা হয়, আসামিদের চারটি ট্রলারের ৫০ থেকে ৬০ জন লোক মিলে সামশুলের ট্রলারটি জিম্মি করে পরবর্তী সময়ে সামশুলসহ অন্যদের গলায় রশি পেঁচিয়ে, হাত-পা রশি ও জাল দিয়ে বেঁধে মারধর করে মাছ রাখার হিমাগারে ভেতর আটকে রাখেন এবং ওপর থেকে ঢাকনায় পেরেক মেরে লাশ গুম করার উদ্দেশ্যে ট্রলারের তলা ফুটো করে দেন। এতে সেটি ডুবে যায়। সামশুলের সঙ্গে এজাহারনামীয় চার আসামির পূর্বশত্রুতা ছিল।

মামলা করার দিনই মাতারবাড়ী থেকে গ্রেপ্তার করা হয় কামাল হোসেন ও করিম সিকদারকে। কামাল মামলার ১ নম্বর এবং করিম সিকদার ৪ নম্বর আসামি। কামাল ও করিমকে পাঁচ দিনের রিমান্ড শেষে গতকাল সোমবার দুপুরে আদালতে হাজির করা হয়। এরপর কামাল জবানবন্দি দিলেও করিম তাতে রাজি হননি। তাঁকে পাঠানো হয় জেলা কারাগারে। মামলার গ্রেপ্তার অপর আসামি গিয়াস উদ্দিন মুনিরকে গত রোববার তিন দিনের রিমান্ডে নিয়েছে পুলিশ।

কক্সবাজার সদর মডেল থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মো. রফিকুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, হত্যা মামলায় এ পর্যন্ত পাঁচজনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। এর মধ্যে দুই আসামি ফজল ও তৈয়ূবের তিন দিন এবং কামাল হোসেন ও করিম সিকদারকে পাঁচ দিনের রিমান্ড শেষে কারাগারে পাঠানো হয়েছে। এর মধ্যে কামাল হোসেন, ফজল ও তৈয়ূব আদালতে ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছেন। কিন্তু তাঁরা কী বলেছেন, তিনি জানেন না।

এ মামলার অপর দুই আসামি আনোয়ার হোসেন ও বাবুল মাঝির বাড়ি মহেশখালীতে। ঘটনার পর থেকে দুজন আত্মগোপনে আছেন।