কক্সবাজারের প্রতিবেশ সংকটাপন্ন প্যাঁচারদ্বীপ সৈকতে প্যারাবন উজাড় ও দখল করে কিংশুক ফার্মস লিমিটেডের বেড়িবাঁধ নির্মাণের কাজ বন্ধ হয়নি। সরানো হয়নি প্যারাবন দখল করে নির্মিত দুটি ইটের সীমানাপ্রাচীরও। উল্টো রোহিঙ্গা শ্রমিক দিয়ে দিন ও রাতে দখল করে রাখা প্যারাবনের ভেতরে কেওড়া, বাইনসহ বিভিন্ন গাছ কেটে ফেলা হচ্ছে। এতে পাখির আবাসস্থল নষ্ট হওয়ার পাশাপাশি ধ্বংস হচ্ছে সামুদ্রিক প্রাণী, জীববৈচিত্র্য।
গত ২৫ ফেব্রুয়ারি প্রথম আলোতে ‘কক্সবাজারের প্যাঁচারদ্বীপ, প্যারাবন দখল করে চলছে রিসোর্ট বানানোর কাজ’ নামে প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়।
কিংশুকের ওই কাজের সবকিছু দেখভাল করেন প্রতিষ্ঠানটির ব্যবস্থাপক মশিউর লিটন। প্রকাশ্যে প্যারাবন উজাড় করে বেড়িবাঁধ ও পাকা দেয়াল তৈরির বিষয়ে প্রশ্ন করা হলে তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ব্যক্তিমালিকানাধীন জমিতে অবকাঠামো নির্মাণ করলে সমস্যা কোথায়? প্রশাসন তো বাধা দিচ্ছে না। এ বিষয়ে সাংবাদিকেরা অন্যায়ভাবে লেখালেখি করছেন বলেও দাবি করেন তিনি।
কার কাছ থেকে ওই জমি কিনেছেন জানতে চাইলে মশিউর লিটন বলেন, ‘জমির কাগজপত্র নিয়ে দেখা করতে বলেছেন রামুর ইউএনও (উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা)। কাগজপত্র দেখাতে হলে তাঁকেই দেখাব।’
প্রতিবেশ সংকটাপন্ন এলাকায় প্যারাবনে রিসোর্ট বা মৎস্য খামার নির্মাণের আগে পরিবেশ অধিদপ্তর ও কক্সবাজার উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের অনুমোদন নিতে হয়। তাঁরা অনুমতি নিয়েছেন কি না জানতে চাইলে মুঠোফোন সংযোগ কেটে দেন মশিউর লিটন।
এ বিষয়ে রামু উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) ফাহমিদা মুস্তফা প্রথম আলোকে বলেন, ‘গত পরশু ওই এলাকায় গিয়েছিলাম। ওই জমিতে বাঁধ দিয়ে মৎস্যখামার করা হবে বলে কিংশুকের কর্মীরা জানিয়েছেন। জমির কাগজপত্র নিয়ে কিংশুকের ম্যানেজারকে আসতে বলেছি। তা ছাড়া জমিটির (প্যারাবন) মালিকানা আসলে কাদের—এর সঠিক তথ্য অনুসন্ধান করে প্রতিবেদন দিতে স্থানীয় ভূমি অফিসের তহসিলদারকে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। প্রতিবেদন দেখে আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’
২০-২২ বছর আগে সরকারিভাবে এ প্যারাবন সৃজন করা হয়। এ প্যারাবন দখল ও উজাড় করে ঢাকার কিংশুক গ্রুপের রিসোর্ট ও মৎস্য খামার তৈরির ঘটনায় উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন কক্সবাজারের চারটি পরিবেশবিষয়ক বেসরকারি সংগঠনের নেতারা।
৩ মার্চ কক্সবাজারে শুরু হচ্ছে তিন দিনব্যাপী পরিবেশকর্মীদের সম্মেলন। ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন এলাকার শতাধিক কর্মী এতে অংশ নেবেন। প্যারাবন দখলের বিরুদ্ধে আন্দোলনের কর্মসূচি নেওয়া হবে জানিয়ে বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন (বাপা) কক্সবাজার জেলা শাখার সভাপতি ফজলুল কাদের চৌধুরী প্রথম আলোকে বলেন, ঢাকার কিংশুক কর্তৃপক্ষ এ বনে রিসোর্ট ও মৎস্য খামার নির্মাণের জন্য ছোট-বড় কয়েক হাজার কেওড়া-বাইনসহ বিভিন্ন প্রজাতির গাছ কেটে ফেলেছে। খননযন্ত্র (এক্সকাভেটর) দিয়ে ১০-১২ ফুট উঁচু, ৭০০-৮০০ ফুট দৈর্ঘ্যের বেড়িবাঁধ এবং দখল করা অংশের বাইরে (উত্তর ও দক্ষিণে) ৫০০-৬০০ ফুট দৈর্ঘ্যের দুটি পাকা সীমানাদেয়াল তোলা হয়েছে। মাসখানেক ধরে প্যারাবন দখলের মহোৎসব চললেও রহস্যজনক কারণে বন বিভাগ বা উপজেলা ভূমি প্রশাসন নীরব ভূমিকা পালন করছে।
প্যারাবন দখলের ঘটনায় রাজনৈতিক প্রতিপক্ষরা তাঁর নাম প্রচার করছেন বলে দাবি করেন ৯ নম্বর ওয়ার্ডের সাবেক ইউপি সদস্য কামাল হোসেন। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমি এসবের মধ্যে নেই। ঢাকার কিংশুক কর্তৃপক্ষ প্যারাবনের পূর্বদিকে স্থানীয় ব্যক্তিমালিকানাধীন কিছু জমি কিনেছেন বলে শুনেছি। কিন্তু কী কারণে প্যারাবন নিধন হচ্ছে, তা কিংশুক কর্তৃপক্ষ ভালো বলতে পারবে।’
প্যারাবনের পূর্ব পাশে খোলা জায়গায় টাঙানো সাইনবোর্ডে লেখা কিংশুক ফার্মস লিমিটেড, রেডিয়েন্ট ফার্মাসিউটিক্যালসের একটি সহযোগী প্রতিষ্ঠান। মৌজা: প্যাঁচারদ্বীপ (হিমছড়ি), জেএল ৩১, রামু, কক্সবাজার। সাইনবোর্ডের পশ্চিম পাশে প্যারাবনের কাছে তৈরি হয়েছে একটি টিনের ঘর।
মঙ্গলবার বিকেলে ঘটনাস্থলে গিয়ে দেখা গেছে, কয়েকজন প্যারাবনের ভেতরে গাছ কাটছেন। সাংবাদিকের উপস্থিতি টের পেয়ে তাঁরা পশ্চিম দিকের ঝাউবাগানের ভেতরে আত্মগোপন করেন। নাম প্রকাশ না করার শর্তে স্থানীয় একজন বাসিন্দা বলেন, কিংশুক কর্তৃপক্ষ আগে খননযন্ত্র দিয়ে ৬০০ ফুট দৈর্ঘ্যের বেড়িবাঁধ নির্মাণ করেছে। পত্রিকায় খবর প্রকাশের পর প্যারাবনের ভেতর থেকে খননযন্ত্রটি সরিয়ে ফেলা হয়েছে। কিন্তু গাছ নিধন বন্ধ হয়নি।
প্যারাবন উজাড়ের ওই অংশ পড়েছে রামু উপজেলার খুনিয়াপালং ইউনিয়নের ৯ নম্বর ওয়ার্ডের হিমছড়ি এলাকায়। ওই ওয়ার্ডের বর্তমান ইউনিয়ন পরিষদ (ইউপি) সদস্য শফিকুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, পরিবেশ ভারসাম্য রক্ষার স্বার্থে প্যারাবনের ভেতরে তৈরি বাঁধ ও পাকা দেয়াল উচ্ছেদ চান এলাকাবাসী।
প্যারাবন দখলের বিরুদ্ধে আন্দোলনে নামার প্রস্তুতি নেওয়ার কথা জানিয়ে পরিবেশবিষয়ক স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন এনভায়রনমেন্ট পিপলের প্রধান নির্বাহী রাশেদুল মজিদ প্রথম আলোকে বলেন, গভীর সমুদ্র থেকে মা কচ্ছপের ডিম পাড়ার নির্জন এলাকা প্যাঁচারদ্বীপ সৈকতের প্যারাবন। দখলকৃত প্যারাবনে গতকালও জোয়ারের পানি ঢুকেছে। সেখানে এখনো ২০-২৫ ফুট উঁচু কেওড়া ও বাইনগাছ রয়েছে। অথচ ব্যক্তিমালিকানাধীন জমি দাবি করে কিংশুক কর্তৃপক্ষ বিশাল প্যারাবন দখল ও গাছপালা উজাড় করছে। এতে পাখির আবাসস্থল নষ্টের পাশাপাশি সামুদ্রিক প্রাণী ও জীববৈচিত্র্য ধ্বংস হচ্ছে। ডিম পাড়ার পরিবেশ হারাচ্ছে সামুদ্রিক মা কচ্ছপ।
এ বিষয়ে কথা বলতে হিমছড়ি বন বিট কর্মকর্তা কামরুজ্জামানের মুঠোফোনে একাধিকবার কল করা হলেও তিনি ধরেননি। তবে কক্সবাজার উত্তর বন বিভাগের সদর বন রেঞ্জ কর্মকর্তা সুমির রঞ্জন সাহা প্রথম আলোকে বলেন, এ বিষয়ে তাঁর করার কিছু নেই। দখল করা প্যারাবনের জায়গাটি খাস খতিয়ানের। ব্যবস্থা নিলে উপজেলা প্রশাসন নিতে পারে।