কিশোরগঞ্জের ভৈরব

মাদকবিরোধী সামাজিক আন্দোলনে ভাটা

মাদকের বিস্তার রোধে সামাজিক অংশগ্রহণ কমে গেলে এর সরাসরি নেতিবাচক প্রভাব পড়ে সমাজকাঠামোতে।

  • ২০০২ থেকে ২০১০ সাল। দীর্ঘ আট বছরে ভৈরবে পাড়ায় পাড়ায় মাদকবিরোধী সামাজিক আন্দোলন গড়ে ওঠে।

  • মুখ থুবড়ে পড়ে কমিটিগুলো। নতুন করে আর পুনর্গঠন হয়নি।

কিশোরগঞ্জ জেলার মানচিত্র

২০০২ থেকে ২০১০ সাল। দীর্ঘ আট বছরে কিশোরগঞ্জের ভৈরবে পাড়ায় পাড়ায় মাদকবিরোধী সামাজিক আন্দোলন গড়ে ওঠে। ভৈরব মাদকমুক্ত করার সমন্বিত চেষ্টার অংশ হতে আন্দোলনের সূচনা। সামাজিক আন্দোলনের চাপে সে সময় মাদক বিক্রেতা ও সেবনকারীরা চাপে পড়ে।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ২০১০ সালের পর থেকে ধীরে ধীরে এ আন্দোলন ঝিমিয়ে পড়তে থাকে। মুখ থুবড়ে পড়ে কমিটিগুলো। নতুন করে আর পুনর্গঠন হয়নি। এতে মাদকের বিস্তার রোধে সামাজিক অংশগ্রহণ কমে যায়। এর সরাসরি নেতিবাচক প্রভাব পড়ে সমাজকাঠামোতে। এ পরিস্থিতি ভাবনায় ফেলে সমাজ সচেতন ব্যক্তিদের।

মো. শহীদুল্লাহ পৌর শহরের রফিকুল ইসলাম মহিলা কলেজের সমাজকর্ম বিভাগের বিভাগীয় প্রধান। ভৈরবের নানা সামাজিক কাজে তাঁর সক্রিয় অংশগ্রহণ রয়েছে। উদ্ভূত পরিস্থিতি সম্পর্কে শহীদুল্লাহ বলেন, চুরি, ছিনতাই, ধর্ষণসহ ভৈরবের সামাজিক অবক্ষয়ের স্পর্শকাতর প্রতিটি ঘটনার নেপথ্যে মাদক আগ্রাসনের ছাপ স্পষ্ট। অনেক পরিবার থেকে শান্তি বিদায় নিয়েছে এই মাদকের কারণে। তাঁর মতে, মাদক নির্মূল করতে হলে সামাজিক অংশগ্রহণ জরুরি।

সমাজ সচেতন ব্যক্তিদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ভৈরবকে এখন মাদকের ট্রানজিট পয়েন্ট ভাবা হয়। অনুকূল সড়ক, রেল ও নৌপথ থাকার কারণে মাদকের একাংশের চালান ভৈরব হয়ে সারা দেশে ছড়িয়ে পড়ে। প্রতিদিন ট্রেন ও সড়কপথে আশপাশের জেলা থেকে অগণিত মাদকাসক্ত ভৈরবে এসে মাদক সেবন করে ফিরে যান। এ আগ্রাসনের বিরুদ্ধে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর প্রতিরোধ খুব বেশি কার্যকর নয়।

এই বাস্তবতা বুঝতে পেরে ভৈরবের কিছু সমাজ সচেতন ব্যক্তি নিজ নিজ পাড়ায় সামাজিক প্রতিরোধ গড়ে তোলার চেষ্টা করেন। এ জন্য গঠন করা হয় সামাজিক প্রতিরোধ কমিটি। উদ্যোগটি দৃশ্যমান হয় ২০০০ সাল থেকে। বিশেষ গতি পায় ২০০২ সালে ‘অপারেশন ক্লিন হার্ট’ শুরুর পর। মাদকের বিরুদ্ধে সেনাবাহিনীর তৎপরতায় লোকজনের মধ্যে সে সময় সাহস জাগে। তখন প্রায় প্রতিটি পাড়ায় গড়ে ওঠে সামাজিক আন্দোলন। কমিটির লোকজনের কাজ ছিল মাদক ক্রেতা-বিক্রেতা চিহ্নিত, প্রতিরোধ ও গণসচেতনতা তৈরি করা।

সচেতনতা তৈরির পরিকল্পনা থেকে মাদকবিরোধী ক্রিকেট, ফুটবল টুর্নামেন্ট, নাটক, গান, কবিতা ও সভা–সমাবেশের আয়োজন করা হয়। মাদক ব্যবসা থেকে ফিরে আসা ব্যক্তিদের বিকল্প পেশার ব্যবস্থা ও আসক্ত ব্যক্তিদের চিকিৎসা করানো ছিল কমিটির কাজ। সবকিছু স্বাভাবিকভাবে এগোলেও ২০১০ সালের পর থেকে আন্দোলন ঝিমিয়ে পড়ে।

জসিম উদ্দিন মাদকবিরোধী সামাজিক আন্দোলনের একজন উল্লেখযোগ্য সংগঠক। কমিটির নিষ্ক্রিয়তার বিষয়ে তাঁর ভাষ্য, ভালো কাজে মানুষের আগ্রহ কমে যাচ্ছে। সংগঠকেরা কখনো কখনো নিজেদের আস্থার জায়গায় রাখতে পারছেন না। ফলে সংকট বড় হচ্ছে।

সক্রিয় কমিটিগুলো ধীরে ধীরে স্থবির হয়ে পড়ার কারণ অনুসন্ধান করতে গিয়ে জানা গেছে, এ আন্দোলন বেগবান হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে কিছু সমস্যার সম্মুখীন হতে হয় কমিটির সদস্যদের। বিশেষ করে নানা কৌশলে পাড়ার বিভিন্ন কমিটিতে মাদক ব্যবসায়ী বা আশ্রয়দাতারা অন্তর্ভুক্ত হয়ে পড়েন। এতে কোনো কোনো কমিটি প্রশ্নবিদ্ধ হয়। আবার কোথাও কোথাও কমিটির সদস্যদের বিরুদ্ধে মাদক ব্যবসায়ীরা জোটবদ্ধ হয়ে নানাভাবে হয়রানি করতে থাকেন।

কমিটির একাধিক সদস্যকে মিথ্যা ধর্ষণ ও খুনের মামলার আসামি হতে হয়। মাদক ব্যবসায়ীরা বিত্তবান ও প্রভাবশালী। আবার তাঁদের একটি অংশ এখন ক্ষমতাসীন দলের নেতা। এ অবস্থায় তাঁদের বিরুদ্ধে পেরে ওঠা সম্ভব হচ্ছে না। ফলে বিপদের আশঙ্কা ও সম্মান হারানোর ভয়ে প্রায় সবাই আন্দোলন থেকে নিজেদের সরিয়ে নিয়েছেন।

সামাজিক আন্দোলনের বৈরী পরিবেশে ব্যতিক্রম পৌর শহরের ৩ নম্বর ওয়ার্ড। ওই ওয়ার্ডের কাউন্সিলর মুমিনুল হকের নেতৃত্বে আন্দোলন এখনো চলমান। চলতি ১১ সেপ্টেম্বর ওয়ার্ডের পঞ্চবটি এলাকায় তাঁর নেতৃত্বে মাদকবিরোধী সভা হয়। সভা থেকে অর্ধশত মাদক ব্যবসায়ীর তালিকা করা হয়। একই সঙ্গে চিহ্নিত চার মাদক ব্যবসায়ীকে এলাকাছাড়া করা হয়।

মুমিনুল হক বলেন, ‘সামাজিক আন্দোলন ঝিমিয়ে পড়ায় সরাসরি আমরা এর নেতিবাচক প্রভাব দেখতে পাচ্ছি।’

ভৈরব থানার পরিদর্শক (তদন্ত) শাহ আলম মোল্লা। তিনি ওসির দায়িত্বে আছেন। তিনি বলেন, বড় কাজে মানুষের অংশগ্রহণ থাকলে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর জন্য সেটি করা সহজ হয়। ভৈরব মাদকমুক্ত করতে সামাজিক কমিটিগুলো সক্রিয় করার প্রয়োজন অনুভব করেন তিনি।