দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে নওগাঁর ছয়টি সংসদীয় আসনে নৌকার ‘মাঝি’ হতে ৪৪ জন আওয়ামী লীগের মনোনয়ন ফরম কিনেছেন। প্রতিটি আসনে গড়ে সাতটি করে ফরম বিক্রি হয়েছে। এর মধ্যে বর্তমান মন্ত্রী, সংসদ সদস্যের সঙ্গে সাবেক আমলা, বাবা-ছেলেও আছেন।
কোথাও কোথাও বর্তমান সংসদ সদস্যের বিরুদ্ধে একজোট হয়েছেন তৃণমূলের নেতারা। এত মনোনয়নপ্রত্যাশীর ভিড়ে কোন ছয় ব্যক্তি নৌকার ‘মাঝি’ হচ্ছেন, তা নিয়ে জল্পনাকল্পনা চলছে। শেষ মুহূর্তে দলীয় টিকিট নিশ্চিত করতে জোর তৎপরতা চালাচ্ছেন মনোনয়নপ্রত্যাশী নেতারা।
দলীয় সূত্রে জানা গেছে, কাল বৃহস্পতিবার থেকে দলীয় প্রার্থী বাছাই শুরু করবে আওয়ামী লীগের সংসদীয় মনোনয়ন বোর্ড। বেলা ১১টায় তেজগাঁওয়ে ঢাকা জেলা আওয়ামী লীগের কার্যালয়ে অনুষ্ঠেয় ওই সভায় সভাপতিত্ব করবেন দলের সভাপতি ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। ওই সভায় ৩০০ আসনের প্রার্থী চূড়ান্ত করা হবে। প্রথম দিন রাজশাহী, রংপুর ও খুলনা বিভাগের সংসদীয় আসনগুলোর মনোনয়ন চূড়ান্ত করা হবে।
নওগাঁ-১ (নিয়ামতপুর-পোরশা-সাপাহার) আসনে টানা তিনবার সংসদ সদস্য হয়েছেন জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও খাদ্যমন্ত্রী সাধন চন্দ্র মজুমদার। দীর্ঘদিন ধরে কেউ তাঁর শক্ত প্রতিদ্বন্দ্বী না থাকলেও দলের তিন নেতা তাঁর বিরুদ্ধে জোট বেঁধেছেন। ইতিমধ্যে মনোনয়ন পাওয়ার আশায় তাঁরা তৎপরতা চালাচ্ছেন। মনোনয়ন ফরম জমা দেওয়া ওই তিন নেতা হলেন নিয়ামতপুর উপজেলা আওয়ামী লীগের সাবেক সহসভাপতি খালেকুজ্জামান, সাবেক সদস্য রেজাউল ইসলাম ও জেলা বঙ্গবন্ধু আওয়ামী আইনজীবী পরিষদের সদস্য ও পোরশা উপজেলা আওয়ামী লীগের সাবেক আইনবিষয়ক সম্পাদক মকবুল হোসেন।
একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে সাধন চন্দ্র মজুমদার সংসদ সদস্য নির্বাচিত হওয়ার পর আধিপত্য বিস্তার নিয়ে স্থানীয় আওয়ামী লীগের মধ্যে বিভেদ সৃষ্টি হয়। খাদ্যমন্ত্রীর একক আধিপত্যের কারণে দলে কোণঠাসা হয়ে পড়া নেতা-কর্মীরা এবার নতুন মুখ দেখতে চান। তৃণমূলের নেতা-কর্মীরা বলছেন, দীর্ঘদিন ধরে মনোনয়নপ্রত্যাশী খালেকুজ্জামান, রেজাউল ইসলাম ও মকবুল হোসেন খাদ্যমন্ত্রীর বিরোধী পক্ষের নেতৃত্ব দিচ্ছেন। তাঁরা তিনজনই দলীয় মনোনয়ন ফরম জমা দিয়েছেন। তিনজনের মধ্যে যিনি মনোনয়ন পাবেন, তাঁর পক্ষে সবাই কাজ করবেন। তবে খাদ্যমন্ত্রী আবার মনোনয়ন পেলে তাঁদের মধ্যে একজন ‘বিদ্রোহী’ প্রার্থী হতে পারেন।
নওগাঁ-২ (পত্নীতলা-ধামুইরহাট) আসনের টানা তিনবারের সংসদ সদস্য শহীদুজ্জামান সরকার এবারও দলীয় মনোনয়ন চান। এবার তিনি ছাড়াও আরও পাঁচজন নৌকার প্রার্থী হতে চান। তাঁদের মধ্যে অন্তত দুজন প্রভাবশালী নেতা আছেন। শহীদুজ্জামান ছাড়া মনোনয়ন ফরম জমা দেওয়া নেতারা হলেন পত্নীতলা উপজেলা আওয়ামী লীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক আমিনুল হক, জেলা আওয়ামী লীগের সাবেক সদস্য আকতারুল ইসলাম, বর্তমান কমিটির সহসভাপতি আইয়ুব হোসেন, মুক্তিযোদ্ধা সংসদ সন্তান কমান্ডের কেন্দ্রীয় যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহমুদ রেজা মেহেদী ও জেলা তাঁতী লীগের সহসভাপতি ওবাইদুল ইসলাম।
দলীয় সূত্র জানায়, এবার শহীদুজ্জামান সরকারের পক্ষে নৌকার ‘টিকিট’ পাওয়া সহজ হবে না। আসনের দুই উপজেলাতেই দলে তাঁর বিরুদ্ধে বিরোধী বলয় তৈরি হয়েছে। এর নেতৃত্বে আছেন আওয়ামী লীগ নেতা আকতারুল ও আমিনুল হক। গত সংসদ নির্বাচনে আকতারুল ও আমিনুল হকের মনোনয়ন পাওয়ার জোর গুঞ্জন ছিল। দলে বিভেদের কারণে এবার নতুন কেউ মনোনয়ন পেতে পারেন।
নওগাঁ-৩ (মহাদেবপুর ও বদলগাছী) আসনের সংসদ সদস্য ছলিম উদ্দিন তরফদার ২০১৪ সালে আওয়ামী লীগের ‘বিদ্রোহী’ প্রার্থী হিসেবে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। পরে দল থেকে তাঁকে বহিষ্কার করা হলেও ২০১৮ সালে তাঁকে দলে ফিরিয়ে এনে মনোয়নন দেওয়া হয়। মহাদেবপুর উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি ও জেলা আওয়ামী লীগের সদস্য ছলিম উদ্দিন তরফদার এবারও দলীয় মনোনয়নপ্রত্যাশী। তিনি ছাড়াও এবার তাঁর আসনে নৌকার ‘মাঝি’ হতে চান ছয়জন। এর মধ্যে দুজন সরকারের সাবেক সচিব।
মনোনয়নপ্রত্যাশীরা হলেন জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের সাবেক সচিব এনামুল কবির এবং পরিসংখ্যান ও তথ্য ব্যবস্থাপনা বিভাগের সাবেক জ্যেষ্ঠ সচিব সৌরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী। সাবেক সংসদ সদস্য প্রয়াত আকরাম হোসেন চৌধুরীর স্ত্রী মাহফুজা আকরাম ও বদলগাছী উপজেলা আওয়ামী লীগের উপদেষ্টামণ্ডলীর সদস্য মাহবুবুল হক মান্নাফ। প্রয়াত আকরাম হোসেন চৌধুরীকে হারিয়ে ২০১৪ সালে সংসদ সদস্য হয়েছিলেন ছলিম উদ্দিন তরফদার। আসন্ন নির্বাচনে জেলা আওয়ামী লীগের সদস্য ও সাবেক সচিব সৌরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তীকে ছলিম উদ্দিন তরফদারের শক্ত প্রতিদ্বন্দ্বী মনে করছেন স্থানীয় নেতা-কর্মীরা। এ ছাড়া আরেক সচিব এনামুল কবিরেরও মনোনয়ন পাওয়ার সম্ভাবনা আছে।
নওগাঁ-৪ (মান্দা) আসনে দলীয় মনোনয়ন ফরম জমা দিয়েছেন সংসদ সদস্য ও সাবেক মন্ত্রী ইমাজ উদ্দিন প্রামাণিক। একই আসনে নির্বাচন করতে দলীয় মনোনয়ন ফরম কিনেছেন তাঁর ছেলে শাফায়াত জামিল। নেতা-কর্মীদের ভাষ্য, সংসদ সদস্য ইমাজ উদ্দিন প্রামাণিকের বয়স এখন ৮৪। বয়সের কারণে তিনি মনোনয়ন না-ও পেতে পারেন। নিজেদের মধ্যে মনোনয়ন ধরে রাখতে কৌশল হিসেবে বাবা-ছেলে মনোনয়ন ফরম নিয়েছেন। জেলার সবচেয়ে বেশি মনোনয়নপ্রত্যাশী এ আসনে। বাবা-ছেলেসহ এবার মোট ১২ জন নেতা এ আসনে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন চেয়েছেন।
ওই দুজন ছাড়া জেলা আওয়ামী লীগের সংস্কৃতিবিষয়ক সম্পাদক ব্রহানী সুলতান গামা, জেলা আওয়ামী লীগের আইন সম্পাদক আবদুল্লাহেল বাকী, মান্দা উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি নাজিম উদ্দিন মণ্ডল, সাধারণ সম্পাদক নাহিদ মোর্শেদ, সদস্য আবদুল মান্নান, আবদুল লতিফ শেখ, উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান এমদাদুল হক মোল্লা, আওয়ামী লীগের নেতা সুলতান রায়হান, আফজাল হোসেন ও আবুল কালাম আজাদ মনোনয়ন চেয়েছেন।
আওয়ামী লীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক প্রয়াত আব্দুল জলিলের ছেলে নিজাম উদ্দিন জলিল নওগাঁ-৫ (সদর) আসনের সংসদ সদস্য। তিনি ছাড়াও জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি ও সাবেক সংসদ সদস্য আবদুল মালেক, জেলা আওয়ামী লীগের সহসভাপতি ও সদর উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান রফিকুল ইসলাম, সাবেক সংসদ সদস্য ও জেলা আওয়ামী লীগের সহসভাপতি শাহীন মনোয়ারা হক, নওগাঁ পৌর আওয়ামী লীগের সভাপতি দেওয়ান ছেকার আহমেদ ও জেলা যুবলীগের সভাপতি খোদাদদ খান এ আসনে মনোনয়ন চেয়েছেন।
২০১৮ সালে নিজাম উদ্দিন জলিল প্রথমবারের মতো সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। এরপর আধিপত্য বিস্তার নিয়ে দলে বিভেদ সৃষ্টি হয়। বর্তমানে সংসদ সদস্যবিরোধী একটি শক্তিশালী বলয় তৈরি হয়েছে। জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি আবদুল মালেককে নিজাম উদ্দিন জলিলের শক্তিশালী প্রতিদ্বন্দ্বী মনে করছেন তৃণমূলের নেতা-কর্মীরা।
২০২০ সালে নওগাঁ-৬ (রানীনগর-আত্রাই) আসনের সংসদ সদস্য ইসরাফিল আলমের মৃত্যুর পর উপনির্বাচনে নৌকার প্রার্থী হিসেবে সংসদ সদস্য হন রানীনগর উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি আনোয়ার হোসেন। এবারও তিনি দলীয় মনোনয়ন চেয়েছেন। পাশাপাশি জেলা আওয়ামী লীগের সহসভাপতি ও প্রয়াত ইসরাফিল আলমের স্ত্রী সুলতানা পারভীন, জেলা আওয়ামী লীগের ত্রাণ ও সমাজকল্যাণবিষয়ক সম্পাদক ওমর ফারুক, রাজশাহী মহানগর আওয়ামী লীগের সহসভাপতি নওশের আলী, রানীনগর উপজেলা আওয়ামী লীগের সহসভাপতি জি এম মাসুদ রানা ও ইউনুছ আলী প্রামাণিক, আত্রাই উপজেলা আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক নাহিদ ইসলাম, আওয়ামী লীগ নেতা আবদুল আরিফ, জাহেদুল হক ও মতিউর রহমান মনোনয়ন চেয়েছেন।
এবার ‘মনোনয়নযুদ্ধে’ সুলতানা পারভীন ও ওমর ফারুককে সংসদ সদস্য আনোয়ার হোসেনের শক্ত প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে মনে করছেন নেতা-কর্মীরা।