মাগুরা

অর্ধেক বই পায়নি শিশুরা

তৃতীয় থেকে পঞ্চম শ্রেণির শিক্ষার্থীরা বাংলা, গণিত ও বিজ্ঞান—এই তিন বিষয়ের বই এখনো পায়নি।

ফাইল ছবি
ফাইল ছবি

মাহাদী হাসান এবার চতুর্থ শ্রেণিতে উঠেছে। মাগুরা পৌর এলাকার একটি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ছাত্র সে। নতুন বছরের বই উৎসবে ছয়টি বইয়ের মধ্যে কেবল তিনটি বই পেয়েছেন সে। বাকি তিনটি বই এক মাসেও দেওয়া হয়নি। তাঁর সহপাঠীরা কেউই এই তিনটি বই এখনো পায়নি। ক্লাসে সব বিষয় পড়ানো হলেও বাড়িতে ফিরে বই না পাওয়া তিনটি বিষয়ের পড়াশোনা করতে পারছে না তারা।

মাহাদী গত মঙ্গলবার প্রথম আলোকে বলে, ‘অঙ্ক, বাংলা ও বিজ্ঞান বই না পাওয়ায় স্কুলে স্যাররা পড়ালেও বাড়িতে সেই পড়া পড়তে পারছি না। প্রায় দিনই স্যারদের বলি, বই কবে দেবেন। তাঁরা বলেন, “কাল-পরশু পেয়ে যাবে।”’

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, কেবল চতুর্থ শ্রেণির শিক্ষার্থীরাই নয়, চতুর্থ ও পঞ্চম শ্রেণির কোনো শিক্ষার্থীর হাতেও বাংলা, গণিত ও বিজ্ঞান—এই তিন বই এখনো পৌঁছায়নি। মাগুরার চার উপজেলার মধ্যে মাগুরা সদর, শ্রীপুর ও মহম্মদপুর—এই তিন উপজেলার চিত্র এটি। তৃতীয় থেকে পঞ্চম শ্রেণির শিক্ষার্থীরা কেবল ইংরেজি, বাংলাদেশ ও বিশ্ব পরিচয় এবং ধর্ম বই নিয়ে শ্রেণিকক্ষে যাচ্ছে। অপর উপজেলা শালিখার প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলোতে তৃতীয় থেকে পঞ্চম শ্রেণির শিক্ষার্থীরা আরও একটি করে বই কম পেয়েছে। তারা বাংলা ও গণিত বই পেলেও ইংরেজি, বিজ্ঞান, বাংলাদেশ ও বিশ্ব পরিচয় এবং ধর্ম বই এখনো পায়নি।

সব বই ঠিক কবে আসবে, সেটা নিশ্চিত করে বলতে পারছি না। আমরা শিক্ষকদের বলেছি পুরোনো বই দিয়ে পাঠদান অব্যাহত রাখতে।
এ এস এম সিরাজুদ্দোহা, জেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তা, মাগুরা

জেলা প্রাথমিক শিক্ষা অফিস সূত্রে জানা গেছে, জেলায় ৫০৩টি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় রয়েছে। এর বাইরে প্রাথমিক শিক্ষা চালু রয়েছে এমন বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা শতাধিক। এসব প্রতিষ্ঠানের প্রাক্‌প্রাথমিক, প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণির সব বই শিক্ষার্থীদের মধ্যে বিতরণ করা হয়েছে। তবে তৃতীয়, চতুর্থ ও পঞ্চম শ্রেণির ছয়টি বইয়ের মধ্যে তিনটি পেয়েছে শিক্ষার্থীরা। জেলায় ২০২৩ সালে সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে তৃতীয় শ্রেণিতে বইয়ের চাহিদা ছিল ১ লাখ ২৩ হাজার ৯৯৬টি। সেখানে বই পাওয়া গেছে ৫৮ হাজার ৬৪৮টি। ৬৫ হাজারের বেশি বই এখনো আসেনি। একইভাবে চতুর্থ শ্রেণিতে চাহিদা ছিল ১ লাখ ২৪ হাজার ৮০টি বই, পাওয়া গেছে ৫৯ হাজার ১৭টি, বাকি রয়েছে ৬৫ হাজার বই। আর পঞ্চম শ্রেণিতে চাহিদা ১ লাখ ১২ হাজার ৩৩২টি বই, পাওয়া গেছে ৫৩ হাজার ৪২৬টি, ৫৯ হাজার বই এখনো মাগুরায় পৌঁছেনি।

অভিভাবকেরা বলছেন, বছরের শুরুতে শিশুদের মধ্যে উদ্যম থাকে। তবে এবার বই না পাওয়ায় শিশুদের সেই উদ্যমে ভাটা পড়েছে। মাগুরা পৌর এলাকার বাসিন্দা রাবেয়া খাতুন বলেন, ‘আমার ছেলে ক্লাস ফাইভে পড়ে। ওদের বাংলা, অঙ্ক ও বিজ্ঞান বই দেওয়া হয়নি। এগুলো তো কঠিন বিষয়। বাড়িতে পড়তে বললে ছেলে বইয়ের দোহাই দিয়ে পড়তে বসতে চায় না। বছরের শুরুতে এটা ওদের জন্য একটা ধাক্কা। স্কুল থেকেও বলতে পারে না, বাকি বইগুলো কবে দেবে। প্রায় প্রতিদিন বই চাই, কিন্তু শিক্ষকরাও হতাশ মনে হলো।’

শিক্ষকেরা অবশ্য বলছেন, নতুন বই না আসায় সাময়িক কিছু সমস্যা হলেও পুরাতন বই সংগ্রহ করে তা দিয়ে কাজ চালিয়ে নিচ্ছেন। সদর উপজেলার আঠারখাদা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক রায় কৃষ্ণা রানী বলেন, ‘বই সংকট তো সাময়িক। আমরা যখন জানতে পারলাম, সব বই একসঙ্গে শিক্ষার্থীরা পাচ্ছে না, ঠিক তখন থেকেই পুরোনো বই সংগ্রহ করে রেখেছি। সেই বই দিয়েই আমরা পাঠদান করছি। তবে শিক্ষার্থীরা নতুন বই চাইছে। আমরা ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে তা জানিয়েছি। তাঁরাও বলেছেন খুব শিগগিরই বইয়ের সংকট কেটে যাবে।’

এ ব্যাপারে জানতে চাইলে মাগুরা জেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তা এ এস এম সিরাজুদ্দোহা গতকাল বুধবার প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমি মঙ্গলবারও প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরে কথা বলেছি। আমাদের জানানো হয়েছে, শিগগিরই সব বই চলে আসবে। তবে ঠিক কবে আসবে, সেটা নিশ্চিত করে বলতে পারছি না। আমরা শিক্ষকদের বলেছি পুরোনো বই দিয়ে পাঠদান অব্যাহত রাখতে।’

নতুন বইয়ের সংকট রয়েছে মাধ্যমিক স্তরেও। জেলা শিক্ষা অফিস সূত্রে জানা গেছে, জেলায় নিম্নমাধ্যমিক, মাধ্যমিক, মাদ্রাসা ও কারিগরি মিলিয়ে ৩২৩টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শিক্ষার্থী রয়েছে ১ লাখ ২২ হাজার। এর মধ্যে ১১৫টি মাদ্রাসার নবম শ্রেণির শিক্ষার্থীরা এখন পর্যন্ত একটি বইও পায়নি। দাখিল পরীক্ষা সামনে হওয়ায় পুরাতন বই সংগ্রহ করাও শিক্ষার্থীদের জন্য কঠিন চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে।

জেলা শিক্ষা কর্মকর্তা মো. আলমগীর কবির বলেন, ‘জেলায় মাধ্যমিক স্তরে মোট চাহিদার ৮৬ ভাগ বই আমরা শিক্ষার্থীদের দিতে পেরেছি। তবে মাদ্রাসার নবম শ্রেণির কোনো বই না আসায় একটু সংকট সৃষ্টি হয়েছে। তা ছাড়া অন্য শ্রেণির একটি-দুটি বই বাকি আছে। তবে আমরা কথা বলেছি, আশা করি দ্রুতই সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে।’