ছেলে হত্যার বর্ণনা দিয়ে কেঁদে ওঠেন উবায়দুল হকের মা। গত মঙ্গলবার তোলা
ছেলে হত্যার বর্ণনা দিয়ে কেঁদে ওঠেন উবায়দুল হকের মা। গত মঙ্গলবার তোলা

‘আমার পুতরে অত আঘাত কইর‍্যা যারা মারছে, তারার বিচার চাই’

শরীরজুড়ে হাতুড়ির আঘাত। কোথাও কোথাও থেঁতলে গেছে। ভেঙে দেওয়া হয়েছে হাত; তাতে আবার থেঁতলানো আঙুল। ধারালো দায়ের কোপে কেটে গেছে পায়ের গোড়ালি। মাথায় হাতুড়ির আঘাতে দেবে গেছে কিছু অংশ। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন চলার সময় এমন হামলার শিকার হন উবায়দুল হক (২৮) নামের এক তরুণ। টানা আট দিন ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের আইসিইউতে চিকিৎসা নেওয়ার পর গত ১২ আগস্ট তাঁর মৃত্যু হয়। হাসপাতালের দেওয়া মৃত্যুসনদ থেকে এসব তথ্য জানা গেছে।

উবায়দুলের গ্রামের বাড়ি ময়মনসিংহের ঈশ্বরগঞ্জ উপজেলার দত্তগ্রামে। অভাবের সংসার চালাতে ১২ বছর ধরে রাজধানী ঢাকায় বিভিন্ন কাজ করতেন। সর্বশেষ একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের গাড়িচালক ছিলেন। সেই সঙ্গে তেজগাঁও শিল্পাঞ্চল ২৪ নম্বর ওয়ার্ড যুবদলের জ্যেষ্ঠ সহসভাপতি হিসেবে দায়িত্ব পালন করছিলেন। আর স্ত্রী জাহেরা খাতুনকে নিয়ে থাকতেন উত্তর বেগুনবাড়ি এলাকার একটি ভাড়া বাসায়।

স্বজনেরা জানিয়েছেন, গত ৪ আগস্ট বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে যোগ দিতে সকালে বাসা থেকে বের হন উবায়দুল। আন্দোলন শেষে দুটি মোটরসাইকেলে কয়েকজন মিলে পল্টনে বিএনপির দলীয় কার্যালয় এলাকায় যান তাঁরা। সেখান থেকে ফেরার পথে ওই দিন বিকেলে পল্টন এলাকার নাইটিঙ্গেল মোড়ে (স্কাউট ভবনের সামনে) হামলার শিকার হন তাঁরা।

পরে স্থানীয় লোকজন উবায়দুলকে উদ্ধার করে কাকরাইলের একটি হাসপাতালে ভর্তি করেন। সেদিন ভোররাতেই এ খবর পায় তাঁর পরিবার। পরদিন ৫ আগস্ট ভোরে ওই হাসপাতাল থেকে ঢাকা মেডিকেলে স্থানান্তর করা হয়। কিন্তু সেদিন আন্দোলনকারীদের কারণে রাস্তার অবস্থা ভালো ছিল না। পরে বাধ্য হয়ে উবায়দুলকে বাসায় নিয়ে গেলে সন্ধ্যার দিকে অবস্থা আরও খারাপ হয়। পরে রাতেই ঢাকা মেডিকেলে নিয়ে ভর্তি করা হয়। সেখানে আইসিইউতে নেওয়ার পর মৃত্যুর আগ পর্যন্ত আর তাঁর জ্ঞান ফেরেনি।

গত ১৩ আগস্ট বিএনপির কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের সামনে ও উত্তর বেগুনবাড়ি এলাকায় দুই দফা জানাজা শেষ লাশ বাড়িতে নেওয়া হয়। ১৪ আগস্ট সকালে নিজ বাড়ির কাছের একটি কবরস্থানে দাফন করা হয় উবায়দুলকে।

গত ৪ আগস্ট বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে যোগ দিতে সকালে বাসা থেকে বের হন উবায়দুল। আন্দোলন শেষে দুটি মোটরসাইকেলে কয়েকজন মিলে পল্টনে বিএনপির দলীয় কার্যালয় এলাকায় যান তাঁরা। সেখান থেকে ফেরার পথে ওই দিন বিকেলে পল্টন এলাকার নাইটিঙ্গেল মোড়ে (স্কাউট ভবনের সামনে) হামলার শিকার হন তাঁরা।

গত মঙ্গলবার দুপুরে উবায়দুলের গ্রামের বাড়িতে যান এই প্রতিবেদক। কড়া নাড়ার পর জীর্ণ ঘর থেকে বেরিয়ে আসেন তাঁর মা মরিয়ম বেগম। আক্ষেপ নিয়ে তিনি বলেন, আন্দোলনে কত মায়ের বুক খালি হচ্ছে, এ নিয়ে টেনশনে ছেলেকে বাইরে যেতে বারবার নিষেধ করেন তিনি। হঠাৎ মরিয়ম বেগম আহাজারি করে উঠলেন। তিনি বলেন, ‘শিকল দিয়ে আঘাত কইর‌্যা আমার বাবারে ফালছে। হাতুড়ি দিয়ে পিডাইছে, আমার বাবারে শেষ কইর‌্যা দিছে। বাবা আমার কত শক্তিশালী ছিল। বাবার চোখসহ সব নষ্ট করে দিচ্ছিল। কত আঘাত ছিল আমার বাবার শরীরে। আমার বাবার উঠে দাঁড়ানোর অবস্থা ছিল না।’

মরিয়ম বেগম বলেন, ‘এই পুতই (ছেলে) আছিন আমার সম্বল। আমার পুতরে অত আঘাত কইর‌্যা যারা মারছে, আমার বুক খালি করছে, আমি সরকারের কাছে তারার বিচার চাই।’

এই পুতই (ছেলে) আছিন আমার সম্বল। আমার পুতরে অত আঘাত কইর‌্যা যারা মারছে, আমার বুক খালি করছে, আমি সরকারের কাছে তারার বিচার চাই।
উবায়দুলের মা মরিয়ম বেগম

দুই বছর আগে বিয়ে করেন উবায়দুল। তাঁর স্ত্রী জাহেরা খাতুন বর্তমানে দুই মাসের অন্তঃসত্ত্বা। মুঠোফোনে কথা হয় তাঁর সঙ্গে। জাহেরা বলেন, বাইরে মিছিল হচ্ছে শুনে দ্রুত বাসা থেকে বের হয়ে যান উবায়দুল। জাহেদা নিষেধ করেছিলেন; কিন্তু শোনেননি উবায়দুল।

জাহেরা বলেন, ‘স্বামী মারা যাওয়ার পর শ্বশুরবাড়ির লোকজন বাড়িতে থাকতে দিল না। জামায়াতে ইসলামী ৩০ আগস্ট আমাদের পরিবারকে দুই লাখ টাকা অনুদান দেয়। এর মধ্যে এক লাখ টাকা আমার ও বাকি এক লাখ টাকা শাশুড়ির হাতে দেয়। টাকা আমার হাতে কেন দেওয়া হলো, এ কারণে পরদিন আমার পরিবারকে খবর পাঠিয়ে আমাকে পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছে। আমাকে স্বামীর কোনো স্মৃতি আনতে দেওয়া হয়নি।’

স্বামী মারা যাওয়ার পর শ্বশুরবাড়ির লোকজন বাড়িতে থাকতে দিল না। জামায়াতে ইসলামী ৩০ আগস্ট আমাদের পরিবারকে দুই লাখ টাকা অনুদান দেয়। এর মধ্যে এক লাখ টাকা আমার ও বাকি এক লাখ টাকা শাশুড়ির হাতে দেয়। টাকা আমার হাতে কেন দেওয়া হলো, এ কারণে পরদিন আমার পরিবারকে খবর পাঠিয়ে আমাকে পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছে। আমাকে স্বামীর কোনো স্মৃতি আনতে দেওয়া হয়নি।
জাহেরা খাতুন, উবায়দুলের স্ত্রী

জাহেরা খাতুনের ভাই রুহুল আমিন বলেন, ‘বোন অন্তসত্ত্বা। সেই সন্তানের কী হবে?’
এমন অভিযোগের ব্যাপারে উবায়দুলের পরিবারের ভাষ্য, ‘জাহেরার বাবার বাড়ির লোকজন এসে জোর করে তাঁকে নিয়ে গেছে। তাঁরা জাহেরাকে পাঠাতে চাননি। এর সঙ্গে টাকার কোনো সম্পর্ক নেই।’

যুবদল নেতা উবাদুল হক হত্যার ঘটনায় বড় ভাই এমদাদুল হক বাদী হয়ে গত ২০ আগস্ট পল্টন মডেল থানায় একটি হত্যা মামলা করেছেন। ওই মামলায় স্থানীয় যুবলীগ, ছাত্রলীগ নেতাসহ ২৫ জনের নাম উল্লেখ করে অজ্ঞাতপরিচয় আরও ২৫ জনকে আসামি করা হয়।