যশোরের ভবদহ অঞ্চলের নদী, পানি ব্যবস্থাপনা, প্রাণ-প্রকৃতি, জীববৈচিত্র্য ও জনপদকে মহাবিপর্যয়ের হাত থেকে রক্ষার দাবি জানিয়েছে ভবদহ পানিনিষ্কাশন সংগ্রাম কমিটি। এ জন্য দ্রুত বিল কপালিয়ায় জোয়ারাধার (টাইডল রিভার ম্যানেজমেন্ট-টিআরএম) চালু এবং উজানে মাথাভাঙ্গা নদীর সঙ্গে ভৈরব নদের পুনঃসংযোগ এবং নদী হত্যা ও দুর্নীতিবাজদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণের দাবি জানানো হয়েছে।
পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা বরাবর দেওয়া এক স্মারকলিপিতে এসব দাবি জানানো হয়। আজ রোববার দুপুরে যশোর জেলা প্রশাসকের মাধ্যমে এ স্মারকলিপি দেওয়া হয়। দুপুর সাড়ে ১২টায় জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ আবরাউল হাছান মজুমদার স্মারকলিপি গ্রহণ করেন।
স্মারকলিপিতে বলা হয়, বিগত সরকারের প্রত্যক্ষ পৃষ্ঠপোষকতায় পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়, পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো), স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের সাবেক প্রতিমন্ত্রী, ঠিকাদার ও ঘেরমালিক সিন্ডিকেটের ষড়যন্ত্রে ভবদহ স্লুইসগেট থেকে ৬০ কিলোমিটার নদী হত্যা করা হয়েছে। ফলে যশোর ক্যান্টনমেন্ট থেকে খুলনার বটিয়াঘাটার বারোয়াড়িয়া মোহনা পর্যন্ত যশোর-খুলনা-সাতক্ষীরা জেলাধীন নদী অববাহিকার ১০০ কিলোমিটার জনপদের চার শতাধিক গ্রাম, হাটবাজার, রাস্তাঘাট, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, মসজিদ-মন্দির, বাড়িঘর, আবাদ ফসল স্থায়ী জলাবদ্ধতার শিকার হতে চলেছে। পরিতাপের বিষয় সাবেক প্রধানমন্ত্রীর কাছে স্মারকলিপির মাধ্যমে অনুরোধ জানানো হলেও তিনি সিন্ডিকেটের পক্ষ নিয়ে এই জনপদকে মহাবিপর্যয়কর পরিস্থিতির মধ্যে ফেলে দিয়েছেন।
স্মারকলিপিতে বলা হয়, গত বছরের ২৬ মে ভবদহ পানিনিষ্কাশন সংগ্রাম কমিটির নেতারা অভয়নগরের ভবদহ ২১-ভেন্ট স্লুইসগেট থেকে বটিয়াঘাটার বারোআড়িয়া এলাকায় চারটি নদীর মোহনা (গ্যারাইল, ভদ্রা, হাবরখালী ও জিরাবুনিয়া) পর্যন্ত পরিদর্শন করেন। তখন মোহনা থেকে যশোর সদর পর্যন্ত প্রায় ১০০ কিলোমিটার নদী অববাহিকার জনপদে মহাবিপর্যয়ের আশঙ্কার চিত্র উঠে আসে। পরিদর্শনকালে নদীগুলোর গভীরতা ও প্রশস্ততা মাপা হয়। এ সময় দেখা যায়, বারোআড়িয়া চারটি নদীর মোহনায় ভাটির সময় ধু ধু চর জেগে ওঠে। অথচ সাত বছর আগে ওই মোহনায় নদীর গভীরতা ছিল প্রায় ২০০ ফুট। ভবদহ স্লুইসগেট থেকে মোহনা পর্যন্ত নদীগর্ভে ৫টি সরকারি আবাসন প্রকল্প, ২৪ থেকে ২৫টি ইটভাটাসহ নানা ধরনের স্থাপনা সরকারি নীতিমালা লঙ্ঘন করে স্থাপন করা হয়েছে।
বিগত সরকারের ‘নদী বাঁচলে দেশ বাঁচবে’ এই ঘোষণা এই জনপদের মানুষের কাছে তামাশায় রূপান্তরিত করেছে। বর্তমান পরিস্থিতি আরও ভয়াবহ। এখন ভবদহ স্লুইসগেট উপচিয়ে পানি ভেতরে ঢুকছে। বিল, কৃষিজমি, বসতবাড়িসহ বিস্তীর্ণ এলাকা প্লাবিত হচ্ছে। জনগণের মতামত উপেক্ষা করে সিন্ডিকেটের স্বার্থে গৃহীত পাউবোর চলমান সেচ প্রকল্প যে ব্যর্থ, তা প্রমাণ হয়েছে।
স্মারকলিপিতে বলা হয়, ১৯৯৮ সালে তৎকালীন সরকারের পানিসম্পদ মন্ত্রীর উপস্থিতিতে সরকার আয়োজিত এক কনভেনশনে নীতিগতভাবে পর্যায়ক্রমে বিলগুলোতে টিআরএম প্রকল্প বাস্তবায়নের সিদ্ধান্ত হয়। সে অনুযায়ী ২০০২ সালে বিল কেদারিয়ায় এবং পরে বিল হিসেবে ২০০৬ সালে বিল খুকশিয়ায় টিআরএমের সফলতায় স্রোতের ভরবেগ বৃদ্ধি পাওয়ায় দ্রুত নদীগর্ভের পলি কেটে কাট পয়েন্ট থেকে নদী ২৫ থেকে ৩০ ফুট গভীর এবং মোহনা সচল হয়েছিল। পরে নির্ধারিত বিল কপালিয়ায় টিআরএম কার্যকর করতে গেলে সরকারি দলের একাংশের সশস্ত্র আক্রমণে ২০১২ সালে তৎকালীন জাতীয় সংসদের হুইপ ও পাউবোর কর্মকর্তারা আহত হন এবং সরকারি গাড়ি পুড়িয়ে দেওয়া হয়। সরকার তাঁদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা না নিয়ে টিআরএম প্রকল্প বাতিল করে দেয়। পুনরায় নিরঙ্কুশ জনমতের ভিত্তিতে ২০১৭ সালের ১৬ মার্চ জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ে পানিসম্পদমন্ত্রীসহ ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা, নির্বাচিত জনপ্রতিনিধি ও ভবদহ পানিনিষ্কাশন সংগ্রাম কমিটির প্রতিনিধিদের উপস্থিতিতে একটি জাতীয় কর্মশালা হয়। আইডব্লিউএমের জরিপ ও জনমত যাচাই করে প্রস্তাবিত বিল কপালিয়া ও পর্যায়ক্রমে অন্যান্য বিলে বিলে টিআরএম প্রকল্প গ্রহণ করা হয়। কিন্তু ২০১৮ সালের ১২ সেপ্টেম্বর পানিসম্পদ মন্ত্রণালয় ওই প্রকল্প বাতিল করে নতুন প্রকল্প প্রণয়নের নির্দেশ দেয়। হঠাৎ পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের সচিব ভবদহ গেটে এসে টিআরএম হবে না এবং ওই বিলগুলোকে জলাভূমি হিসেবে ঘোষণা দেন। তিনি ডেল্টা প্ল্যান-২১০০–এর অজুহাত উত্থাপন করেন। প্রকৃত সত্য হলো ভবদহ এলাকা কখনোই জলাভূমি বা জলাশয় ছিল না। এমন তথ্য রাষ্ট্রীয় নথিপত্রেও দেখা যায় না। বরং ডেল্টা প্ল্যান-২১০০–এ ভবদহ এলাকার জলাবদ্ধতা নিরসনে সুনির্দিষ্ট সুপারিশ রয়েছে।
স্মারকলিপিতে বলা হয়, চুয়াডাঙ্গার দর্শনায় নদীর উজানে মাথাভাঙ্গা নদীর সঙ্গে ভৈরব নদের পুনঃসংযোগ প্রকল্প প্রক্রিয়াধীন। এটি বাস্তবায়ন হলে দক্ষিণ-পশ্চিম অঞ্চলের নদীসমূহে নাব্যতার ক্ষেত্রে এক ঐতিহাসিক ও সুদূরপ্রসারী প্রভাব পড়বে। ভৈরব নদ অববাহিকার নদীসমূহের পুনর্জাগরণ ঘটবে। জলাবদ্ধতা, লবণাক্ততা, নদীতে পলি ভরাটের সমস্যা, ভবদহ অঞ্চলের মুক্তেশ্বরী-হরি-টেকা-গ্যাংরাইল, কপোতাক্ষ-বেতনা-হরিহর-ভদ্রাসহ সব নদী ও খাল সচল হবে। সুন্দরবনের মিঠাপানির সংকট সমাধান হবে।
স্মারকলিপিতে ভবদহ অঞ্চলের নদী, পানি ব্যবস্থাপনা, প্রাণ-প্রকৃতি, জীববৈচিত্র্য ও জনপদকে রক্ষার জন্য দ্রুত বিল কপালিয়ায় এবং পর্যায়ক্রমে অন্য বিলগুলোতে টিআরএম চালু এবং উজানে মাথাভাঙ্গা-ভৈরব নদ সংযোগের প্রস্তাবিত প্রকল্প বাস্তবায়ন; পানিসম্পদ মন্ত্রাণালয়ের সাবেক সচিব কবির বিন আনোয়ার, পাউবোর দুর্নীতিগ্রস্ত কর্মকর্তা ও সাবেক স্থানীয় সরকারের প্রতিমন্ত্রী সহযোগে সিন্ডিকেটের বিচার, সরকারকে মিথ্যা তথ্য প্রদান, জনপদের দুঃখ-দুর্দশা, নদী হত্যা ও সরকারি নীতিমালা লঙ্ঘনের সঙ্গে জড়িত সংশ্লিষ্ট চক্রকে চিহ্নিত করে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ; আমডাঙ্গা খাল দ্রুত সংস্কার; নদী সীমানা নির্ধারণ, নদী তট আইন বাস্তবায়ন, অবৈধভাবে নদীগর্ভে নির্মিত ইটভাটা, আবাসন প্রকল্প প্রতিষ্ঠার সঙ্গে সংশ্লিষ্টদের বিচার ও সব অবৈধ দখলদার উচ্ছেদ করতে হবে। সব খাল উন্মুক্ত এবং ভারত থেকে আসা ৫৪টি নদীর পানির ন্যায্য হিস্যা আদায় ও দেশের অভ্যন্তরে সব নদী-খাল সংষ্কার, নদী সম্পদ উদ্ধার, অবৈধ দখলদার উচ্ছেদের দাবি জানানো হয়।
স্মারকলিপি প্রদানকালে উপস্থিত ছিলেন ভবদহ পানিনিষ্কাশন সংগ্রাম কমিটির প্রধান উপদেষ্টা ইকবাল কবির জাহিদ, আহ্বায়ক রনজিৎ বাওয়ালী, যুগ্ম আহ্বায়ক বীর মুক্তিযোদ্ধা গাজী আব্দুল হামিদ, সদস্য অনিল বিশ্বাস, জিল্লুর রহমান, তসলিম-উর-রহমান, শিবপদ বিশ্বাস, রাজু আহমেদ, হাচিনুর রহমান, নাজিমুদ্দিন, শাহজান আলী, আমিনুর রহমান, পলাশ বিশ্বাস, শেখর বিশ্বাস, সিরাজুল ইসলাম প্রমুখ।