গাজীপুরের শ্রীপুরের কেওয়া পশ্চিম খণ্ড সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে প্রতিটি শ্রেণিকক্ষের সামনে বারান্দা, সিঁড়ি, মেঝে ও আশপাশ এভাবেই রাঙিয়ে তোলা হয়েছে। সম্প্রতি তোলা ছবি
গাজীপুরের শ্রীপুরের কেওয়া পশ্চিম খণ্ড সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে প্রতিটি শ্রেণিকক্ষের সামনে বারান্দা, সিঁড়ি, মেঝে ও আশপাশ এভাবেই রাঙিয়ে তোলা হয়েছে। সম্প্রতি তোলা ছবি

বর্ণিল এক প্রাথমিক বিদ্যালয়

বিদ্যালয়টির ছাদ ও দেয়ালে আঁকা হয়েছে বাংলাদেশের রূপ। শিক্ষার্থীদের বিনা মূল্যে সরবরাহ করা হয় শিক্ষা উপকরণ।

সবুজ ঘাসের গালিচা বিছানো খেলার মাঠ। শ্রেণিকক্ষের বারান্দায় নানান ফুলের গাছ। প্রতিটি শ্রেণিকক্ষের ভেতরে ও বাইরে দেয়াল, বারান্দা, ছাদ, জানালাসহ সর্বত্র বর্ণিল আলপনা। সমৃদ্ধ গ্রন্থাগার, বিনা মূল্যে শিক্ষা উপকরণ, কিশোরী স্বাস্থ্য পরামর্শ, সাজানো অফিস—কী নেই স্কুলটিতে! জরাজীর্ণ ভবন, অপরিচ্ছন্ন পরিবেশের চিরাচরিত ধারণার বাইরে এটি একটি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের চিত্র।

বিদ্যালয়টির নাম কেওয়া পশ্চিমখণ্ড সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়। ১৯৭৩ সালে গাজীপুরের শ্রীপুর পৌরসভার ৯ নম্বর ওয়ার্ডে প্রতিষ্ঠিত এ বিদ্যালয়ে মোট শিক্ষার্থী এখন ৭০২ জন। এ বছর বিদ্যালয়টির প্রধান শিক্ষক ফরিদা ইয়াসমিন গাজীপুর জেলার শ্রেষ্ঠ শিক্ষক হিসেবে নির্বাচিত হয়েছেন। একই সঙ্গে বিদ্যালয়ের ম্যানেজিং কমিটির সভাপতি কামরুল ইসলাম হয়েছেন জেলার শ্রেষ্ঠ সভাপতি।

সরেজমিনে দেখা যায়, পৌর এলাকার কড়ইতলা বাজার থেকে কিছুটা উত্তর দিকে সড়ক–লাগোয়া বিশাল স্কুল ফটক। ভেতরে প্রবেশ করতেই দেখা মেলে সবুজ ঘাসের গালিচার মতো বিস্তৃত মাঠ। মাঠের দক্ষিণ পাশে একতলাবিশিষ্ট ভবন, শহীদ মিনার। পশ্চিমে আধা পাকা একটি পুরোনো ভবন।

উত্তর পাশে দোতলা ভবন। এসব ভবনেই চলে শিক্ষার্থীদের পাঠদান। দ্বিতল ভবনটির বারান্দায় প্রবেশ করতেই চোখে পড়ে এর দেয়ালের বিচিত্র রূপ। এ যেন বাংলাদেশের প্রতিচ্ছবি। দেয়ালজুড়েই বিভিন্ন রঙে আঁকা হয়েছে গাছপালা, পশুপাখি, পাঠ্যবইয়ের অলংকরণ। কোথাও আবার স্থান পেয়েছে দেশের বিশিষ্ট লেখক, কবি-সাহিত্যিকদের ছবি।

শ্রেণিকক্ষের ভেতরেও দেয়ালজুড়ে নানা রঙের ছোঁয়া। ছাদ ও দেয়ালে আঁকা হয়েছে বাংলাদেশের প্রাকৃতিক রূপ। কোনো কোনো শ্রেণিকক্ষের ছাদে সুকৌশলে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে সৌরজগৎকে। এমন নানা বর্ণিল চিত্র প্রতিটি শ্রেণিকক্ষের। বিদ্যালয়টির কার্যালয় কক্ষটি নান্দনিকভাবে সাজানো হয়েছে।

শিক্ষকেরা বলেন, পুষ্টির প্রয়োজনে শিক্ষার্থীদের প্রতিদিন ডিম খাওয়ানো হয়। এ ছাড়া তাঁদের নিত্যপ্রয়োজনীয় খাতা, কলম, স্কুল ব্যাগ বিদ্যালয় থেকেই বিনা মূল্যে সরবরাহ করা হয়। বর্ষায় শিক্ষার্থীদের প্রত্যেককে দেওয়া হয় ছাতা। শীতে বিনা মূল্যে কম্বল বিতরণ করা হয়। প্রতি মাসে পঞ্চম শ্রেণির ছাত্রীদের কিশোরী স্বাস্থ্যসেবা ও বয়ঃসন্ধিকালীন পরামর্শ দেওয়া হয়। একজন চিকিৎসক তাদের কাউন্সেলিং করেন। প্রত্যেক কিশোরীকে বিনা মূল্যে দেওয়া হয় বয়ঃসন্ধিকালীন সুরক্ষার বিভিন্ন উপকরণ।

কামরুল ইসলাম পেশায় ব্যবসায়ী। বিদ্যানুরাগী হিসেবে পরিচিত এই ব্যক্তি ২০২০ সালে বিদ্যালয়টির পরিচালনা পর্ষদের সভাপতির দায়িত্ব নেন। এরপরই বিদ্যালয়টিতে লাগে পরিবর্তনের ছোঁয়া। ওই সময় থেকে আনুষ্ঠানিক পরীক্ষা হয়নি। শুধু বার্ষিক পরীক্ষা হচ্ছে। এসব পরীক্ষায় শিক্ষার্থীরা ভালো ফল করছে। বাড়ছে শিক্ষার্থীর সংখ্যা। ২০১৯ সালে ওই বিদ্যালয়ে ৪৩০ জন শিক্ষার্থী ছিল। বর্তমানে এই সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ৭০২ জনে। উপস্থিতি প্রায় শতভাগ।

কেওয়া পশ্চিমখণ্ড গ্রামের বাসিন্দা ইসরাফিল হোসেন বলেন, কামরুল ইসলাম শিক্ষাবান্ধব মানুষ। নিজের সামগ্রিক আয় থেকে তিনি দীর্ঘদিন ধরে বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে সহযোগিতা করেন। এই স্কুলের সভাপতির দায়িত্ব নেওয়ার পর সেখানে হাত খুলে খরচ করছেন।

এ বিষয়ে কামরুল ইসলাম বলেন, ‘সরকারি প্রাথমিকের শিক্ষাব্যবস্থা নিয়ে মানুষের মধ্যে ইতিবাচক ধারণার সৃষ্টির জন্য আমি স্কুলটির পাশে এসে দাঁড়িয়েছি। শিক্ষার্থীরা এখন অপেক্ষায় থাকে কখন স্কুলে যাবে। তাদের জন্য আনন্দময় পাঠদানের পরিবেশ সৃষ্টি করা হয়েছে।’

বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক ফরিদা ইয়াসমিন বলেন, তাঁর স্কুলে শিক্ষার্থীর ঝরে পড়ার হার প্রায় শূন্যের কোঠায় চলে এসেছে। শিক্ষার্থীরা আগ্রহ নিয়ে প্রতিদিন স্কুলে আসে। তাদের আনন্দের মধ্য দিয়ে শিক্ষাদানের ব্যবস্থা করেছেন স্কুলটির পরিচালনা পর্ষদের সভাপতি কামরুল ইসলাম। শিক্ষার্থীদের স্কুলমুখী করার জন্য তিনি নিজ অর্থায়নে শ্রেণিকক্ষ, বারান্দা ও অফিসকক্ষ সুন্দর করে সাজিয়েছেন। নিজের খরচে শিক্ষার্থীদের জন্য খাবারের আয়োজন করেন। শিক্ষার্থীদের জন্য স্কুল ব্যাগসহ বিভিন্ন শিক্ষা উপকরণ দিচ্ছেন নিজ খরচেই। এসবের ফলে শিক্ষার্থীরা স্কুলে আসতে বেশি আগ্রহ বোধ করে।

বিদ্যালয়ের এমন পরিবেশ দারুণ উপভোগ করছে শিক্ষার্থীরা। চতুর্থ শ্রেণির শিক্ষার্থী সারা মণি বলে, স্কুলের রঙিন পরিবেশ তাঁর ভীষণ ভালো লাগে। প্রতিদিন স্কুলে আসার অপেক্ষায় থাকে সে। একই ভাষ্য পঞ্চম শ্রেণির শিক্ষার্থী ঊর্মি আক্তারের। সে জানায়, স্কুলটিতে সবকিছু বিনা টাকায় পাচ্ছে সে। কোনো কিছু কিনতে হচ্ছে না। স্কুল থেকে খাবার পাওয়ায় টিফিন খরচও লাগে না তার।

বিষয়টিকে উৎসাহদায়ক হিসেবে উল্লেখ করেছেন শ্রীপুর উপজেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তা ফাতেমা নাসরিন। প্রথম আলোকে তিনি বলেন, স্কুলটির বিশেষ ব্যবস্থাপনা শিক্ষার্থী সহায়ক। অন্যান্য স্কুলও এভাবে শিক্ষার্থীদের স্কুলমুখী করতে উদ্যোগ নিতে পারে।