গ্যাস ও জ্বালানি–সংকটে বিদ্যুতের উৎপাদন কমায় বুধবার থেকে ময়মনসিংহ অঞ্চলের ছয় জেলায় লোডশেডিং বেড়েছে। জেলা ও উপজেলা শহরে পরিস্থিতি কিছুটা ভালো থাকলেও গ্রামের গ্রাহকেরা চরম ভোগান্তিতে পড়েছেন। কোথাও কোথাও দিনরাত মিলে ১০ থেকে ২০ বার লোডশেডিং হচ্ছে। রেশনিং পদ্ধতিতে লোডশেডিং করে পরিস্থিতি মোকাবিলার চেষ্টা করছে বিদ্যুৎ বিভাগ।
বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড (পিডিবি) ও পল্লী বিদ্যুৎ সমিতি সূত্রে জানা গেছে, দুটি সংস্থার আওতায় ময়মনসিংহ অঞ্চলের ময়মনসিংহ, শেরপুর, জামালপুর, নেত্রকোনা, কিশোরগঞ্জ ও টাঙ্গাইল জেলায় তাদের গ্রাহক আছেন অন্তত ৫০ লাখ। এর মধ্যে পিডিবির গ্রাহক প্রায় ১৩ লাখ। বাকি ৩৭ লাখ পল্লী বিদ্যুতের। এসব গ্রাহকের জন্য পিক আওয়ারে চাহিদা ১ হাজার ৫৫০ মেগাওয়াট, অফ-পিকে ১ হাজার ৩৫০ মেগাওয়াট। বিপরীতে স্বাভাবিক সময়ে পিক আওয়ারে ১ হাজার ৫০ থেকে ১ হাজার ১৫০ ও অফ-পিকে ৮৫০ থেকে ১ হাজার ৫০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ পাওয়া যায়। যদিও শীত-গ্রীষ্ম ভেদে চাহিদা ওঠানামা করে।
গতকাল বৃহস্পতিবার দুপুর ১২টা পর্যন্ত ময়মনসিংহ অঞ্চলের ছয় জেলায় বিদ্যুতের চাহিদা ছিল ১ হাজার ১১৮ মেগাওয়াট। কিন্তু জ্বালানি–সংকটের কারণে মিলছে ৮৭৬ মেগাওয়াট। ফলে ২৪২ মেগাওয়াট লোডশেডিং করতে হচ্ছে বলে জানিয়েছেন পাওয়ার গ্রিড কোম্পানি অব বাংলাদেশের (পিজিসিবি) ময়মনসিংহের নির্বাহী প্রকৌশলী মো. মাসুদুল হক। তিনি বলেন, গ্যাস–সংকটে উৎপাদন কমায় বুধবার থেকে লোডশেডিং বেড়েছে।
ময়মনসিংহের ঈশ্বরগঞ্জ উপজেলায় পল্লী বিদ্যুৎ সমিতির মোট গ্রাহক ১ লাখ ৪ হাজার। পল্লী বিদ্যুতের ঈশ্বরগঞ্জ জোনাল কার্যালয়ের উপমহাব্যবস্থাপক (ডিজিএম) অনিতা বর্ধন বলেন, বুধবার থেকে লোডশেডিং বেড়েছে। বুধবার পিক আওয়ারে ১৮ মেগাওয়াট চাহিদার বিপরীতে সাড়ে ৮ মেগাওয়াট এবং অফ-পিকে ১৩ মেগাওয়াটের মধ্যে সাড়ে ৮ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ পাওয়া যাচ্ছিল। গতকাল দেড়টার দিকেও একই অবস্থা ছিল।
ঈশ্বরগঞ্জ সদর ইউনিয়নের জয়পুর গ্রামের গৃহবধূ বিলকিস বেগম বলেন, গতকাল সকাল থেকে বেলা দুইটা পর্যন্ত চারবার বিদ্যুৎ গেছে। লোডশেডিংয়ের কারণে সন্তানদের নিয়ে কষ্টে আছেন। ঈশ্বরগঞ্জ চৌকি আদালতের সামনে আইনজীবীর সহকারী হিসেবে কাজ করেন মো. মুস্তাকীম। তিনি বলেন, গতকাল সকাল ৯টা থেকে বেলা ২টা পর্যন্ত অন্তত চারবার বিদ্যুৎ গেছে। প্রতিবার আধা ঘণ্টা থেকে এক ঘণ্টা বিদ্যুৎ থাকে না। দেড়টায় বিদ্যুৎ আসার ৫ মিনিটের মধ্যে আবার চলে গেছে। এতে কাজ করতে সমস্যায় পড়তে হচ্ছে।
ঈশ্বরগঞ্জে পিডিবির গ্রাহক আছেন সাড়ে ১৮ হাজার। পিডিবির ঈশ্বরগঞ্জের আবাসিক প্রকৌশলী ইমতিয়াজ মামুন বলেন, বুধবার ৬ দশমিক ৮ মেগাওয়াটের চাহিদার বিপরীতে সাড়ে তিন থেকে চার মেগাওয়াট পাওয়া গেছে। তিনি বলেন, বিদ্যুৎ উৎপাদন কম হওয়ায় লোডশেডিং বেড়েছে।
পিডিবির ময়মনসিংহের প্রধান প্রকৌশলী মো. এমদাদুল হক বলেন, রেশনিং পদ্ধতিতে বিভিন্ন জায়গায় লোডশেডিং করে পরিস্থিতি মোকাবিলা করতে হচ্ছে।
পিডিবি ও পল্লী বিদ্যুৎ সূত্র জানায়, ময়মনসিংহ অঞ্চলের ছয় জেলার ৫০ লাখ গ্রাহকের জন্য পিক আওয়ারে দেড় হাজার এবং অফ-পিকে ১ হাজার ৩৫০ মেগাওয়াট বিদ্যুতের চাহিদা থাকে। বিপরীতে স্বাভাবিক সময়ে পিক আওয়ারে ১ হাজার ৫০ থেকে ১ হাজার ১৫০ এবং অফ-পিকে ৮৫০ থেকে ১ হাজার ৫০ মেগাওয়াট পাওয়া যায়। যদিও গ্যাস ও জ্বালানি–সংকটের কারণে এখন সেটিও পাওয়া যাচ্ছে না। এলাকাভেদে পিডিবির প্রায় ১৩ লাখ গ্রাহকের জন্য পিক আওয়ারে ৫৫০ মেগাওয়াট ও অফ-পিকে ৪৮০ মেগাওয়াট চাহিদা আছে। অন্যদিকে পল্লী বিদ্যুতের ৩৭ লাখ গ্রাহকের জন্য পিক আওয়ারে ১ হাজার এবং অফ-পিকে ৮৭০ মেগাওয়াট চাহিদা আছে। বিপরীতে চার ভাগের এক ভাগ বিদ্যুৎ কম পাওয়া যাচ্ছে।
পিজিসিবির ময়মনসিংহের নির্বাহী প্রকৌশলী মো. মাসুদুল হক প্রথম আলোকে বলেন, সাধারণত স্থানীয় বিদ্যুৎকেন্দ্র থেকে ১৬৫ থেকে ২৩৫ এবং জাতীয় গ্রিড থেকে ৮০০ থেকে ৯০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ পাওয়া যায়। এর মাধ্যমে চাহিদা পূরণ করা হয়। এর বেশি চাহিদা থাকলে বাকি সময় লোডশেডিং রাখতে হয়। গুরুত্ব বিবেচনায় লোড ম্যানেজমেন্ট কমিটির সিদ্ধান্ত অনুযায়ী, বর্তমানে পাওয়া বিদ্যুতের ৬০ শতাংশ পিডিবি ও ৪০ শতাংশ পল্লী বিদ্যুৎ সমিতিকে সরবরাহ করা হয়।
পিজিসিবি সূত্রে জানা গেছে, ময়মনসিংহ শহরের চরকালীবাড়ি এলাকায় রুরাল পাওয়ার কোম্পানি লিমিটেড (আরপিসিএল) নামের ২১০ মেগাওয়াট ক্ষমতার একটি বিদ্যুৎকেন্দ্র আছে। গ্যাসনির্ভর বিদ্যুৎকেন্দ্রটি বর্তমানে গ্যাস–সংকটে আছে। এখানে বর্তমানে পিক ও অফ-পিকে ১০ থেকে ২০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদিত হচ্ছে।
জামালপুরে ইউনাইটেড পাওয়ার প্ল্যান্টের দুটি উৎপাদন কেন্দ্রের একটিতে ১২০ মেগাওয়াট ও অন্যটিতে ২০০ মেগাওয়াট উৎপাদন ক্ষমতা থাকলেও দুটি বিদ্যুৎকেন্দ্র থেকে ১০০ থেকে ২০০ মেগাওয়াট উৎপাদন করা হয়। কিন্তু জ্বালানি–সংকটের কারণে সেটিও উৎপাদন করতে পারছে না। জামালপুরে সিকদার গ্রুপের ১০০ মেগাওয়াট ক্ষমতার একটি বিদ্যুৎকেন্দ্র থাকলেও তিন বছর ধরে সেটি বন্ধ। সাধারণ সময়ে স্থানীয় বিদ্যুৎকেন্দ্র থেকে ১৬৫ থেকে ২৩৫ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ মিললেও গতকাল ১৪০ থেকে ১৫০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ পাওয়া গেছে।
পিজিসিবির ময়মনসিংহের নির্বাহী প্রকৌশলী মাসুদুল হক বলেন, স্থানীয়ভাবে চাহিদার ৬০ শতাংশ বিদ্যুৎ উৎপাদন করা গেলে জাতীয়ভাবেও বেশি পাওয়া যেত। কিন্তু স্থানীয়ভাবে বিদ্যুৎ উৎপাদন কম থাকায় লো-ভোল্টেজসহ লোডশেডিং সমস্যা হচ্ছে। তবে গাজীপুরের শ্রীপুরের বরমী এলাকায় ১৫০ মেগাওয়াটের একটি বিদ্যুৎকেন্দ্র হচ্ছে। সেটির বিদ্যুৎ এই গ্রিডে এলে অনেকটা সুফল মিলবে। বিদ্যুৎ উৎপাদন বাড়াতে সংশ্লিষ্ট দপ্তরে চিঠি পাঠানো হচ্ছে।