মা আর নানির অন্ধের যষ্টি ছিলেন সাগর রহমান (২০)। পরিবারের সচ্ছলতা ফেরাতে ও মানসিক ভারসাম্যহীন মায়ের চিকিৎসার টাকা জোগাড় করতে ঢাকায় একটি ইন্টারনেট সেবাদাতা প্রতিষ্ঠানে কাজ নিয়েছিলেন। মাকে চিকিৎসা করাতে মাস তিনেক আগে নিয়েও এসেছিলেন ঢাকায়। এরই মধ্যে ৫ আগস্ট সরকার পতনের দিন বিকেলে ঢাকার মেরুল বাড্ডা থানার সামনে গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা যান। এতে মা সখিনা আক্তারের চিকিৎসা নেওয়ার বিষয়টি অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে।
সাগর পঞ্চগড় সদর উপজেলার চাকলাহাট ইউনিয়নের কিত্তিনিয়া পাড়া এলাকার রবিউল ইসলামের ছেলে। ২০২২ সালে স্থানীয় একটি মাধ্যমিক বিদ্যালয় থেকে এসএসসি পাস করে অভাবের কারণে ঢাকায় পাড়ি দেন। ইন্টারনেট সেবাদাতা প্রতিষ্ঠানে কাজ নিয়ে মেরুল বাড্ডায় মামার সঙ্গে থাকতেন ভাড়াবাড়িতে। সেখান থেকেই ৫ আগস্ট বিকেলে মিছিলে গিয়ে গুলিবিদ্ধ হন। পরে রাত ১১টার দিকে মুগদা হাসপাতালে সাগরের লাশ খুঁজে পান স্বজনেরা। পরদিন ৬ আগস্ট সাগরের লাশ গ্রামের বাড়িতে এনে দাফন করা হয়।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, সাগরের বয়স যখন মাত্র ১০ মাস, ঠিক তখনই তাঁর বাবা-মায়ের ছাড়াছাড়ি হয়। উপায়ান্তর না পেয়ে মা সখিনা আক্তার ১০ মাসের শিশু সাগরকে নিয়ে ফিরে আসেন দিনমজুর বাবা-মায়ের বাড়িতে। কিছুদিন পরই মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে অসুস্থ পড়েন সখিনা আক্তার। অসুস্থ মা ও নানা-নানির কষ্টের সংসারে বড় হন। চার বছর আগে নানা সপিজ উদ্দিনের মৃত্যুর পর নানির সঙ্গে মানুষের বাড়িতে কাজ করতেন সাগর। এরপর এসএসসি পাস করে ঢাকায় চলে যান।
গত বুধবার বিকেলে সদর উপজেলা কিত্তিনিয়া পাড়া এলাকায় সাগরের নানির বাড়িতে গিয়ে দেখা যায়, টিনের বেড়ার একটি ঘর। সেখানেই নানি ও মায়ের সঙ্গে থাকতেন সাগর। স্বজন ও প্রতিবেশীরা জানালেন, একমাত্র অবলম্বন সাগরকে হারানোর শোকে কাঁদতে কাঁদতে ভেঙে পড়েছেন তাঁর মা ও নানি।
বাড়ির উঠানে দাঁড়িয়ে ডুকরে কেঁদে ওঠেন নানি হালিমা খাতুন। বলেন, ‘মানুষের বাড়িত কাজ করে কত কষ্ট করে ছুয়াডাক (ছেলেটাকে) মানসি (মানুষ) করনু। এ্যালা কনেক কামাই (আয়) করিবা শিখিছে। পাগলি মাওডার চিকিৎসা করিবা চাহিল। সেইডাও করিবা পারিল নাই। হামার মা-বেটির সাগরটায় আশা-ভরসা ছিল। কলিজার টুকরাডাক হারায় ফেলাইচু। মোর সব শেষ হয়া গেইছে।’
এ সময় সাগরের মা সখিনা আক্তার ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে ছিলেন নানি হালিমা খাতুনের দিকে। মানসিক ভারসাম্যহীন হলেও ছেলে হারানোর শোকে যেন বাকরুদ্ধ তিনি।
সাগরের মামাতো ভাই সজিব রহমান বলেন, ঘটনার দিন সাগরসহ একসঙ্গেই বের হয়েছিলেন। বিকেলে সরকারের পতনের পর মেরুল বাড্ডা থানার সামনে হাজার হাজার মানুষ জড়ো হয়েছিলেন। সেখানে তাঁরাও ছিলেন। পরে জানতে পারেন সাগরের শরীরে গুলি লেগেছে। অনেক খুঁজেও তাঁকে পাননি। পরে মুগদা হাসপাতালে রাত ১১টার দিকে লাশ পান। তিনি বলেন, ‘সাগরের ইচ্ছা ছিল বিদেশে গিয়ে কাজ করে মায়ের চিকিৎসা করাবে। কিন্তু হলো না। ওই দিন সাগরের বাঁ পাঁজরের নিচে ও বাঁ হাত গুলিতে ঝাঁজরা হয়ে গিয়েছিল।’
চাকলাহাট ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান রবিউল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, বাবা-মায়ের ছাড়াছাড়ি হওয়ার পর থেকে সাগর ও তাঁর মা নানির কাছে থাকতেন। অনেক কষ্টের সংসার তাঁদের। সাগরের মা মানসিক রোগী। ছেলেটা বড় হয়ে মা-নানির দেখাশোনা শুরু করেছিলেন। এর মধ্যেই মারা যাওয়ায় তাঁরা বিপদে পড়ে গেছেন।