মাসখানেক ধরে ভারী বৃষ্টিপাত হচ্ছে সিলেটে। বৃষ্টির সময় মাটিধস নামাতে টিলায় টিলায় সরু নালা কেটে রাখা হয়। টানা বৃষ্টিতে নরম হয়ে আসা মাটি সেই নালা বেয়ে নেমে আসে টিলার পাদদেশে। আবার অনেক স্থানে কেটে রাখা হয় টিলা। কেটে রাখা তেমনি একটি টিলায় ধস নামে গতকাল সোমবার। সিলেট নগরের চামেলীবাগে সেই টিলাধসে শিশুসহ এক পরিবারের তিনজন নিহত হয়েছেন।
মূলত টিলা কেটে সমতলভূমি বানাতে স্থানীয় বাসিন্দারা ঝুঁকিপূর্ণ এই কৌশলের আশ্রয় নেন। এলাকাবাসীর অভিযোগ, স্থানীয় ওয়ার্ড কাউন্সিলর ও যুবলীগের এক নেতা চামেলীবাগের টিলাটি কাটাচ্ছিলেন। গতকাল সকালে সেই টিলায় ধস নামলে এক পরিবারের ৯ সদস্যের চারজন মাটিচাপা পড়েন। তখন তাঁরা ঘুমিয়ে ছিলেন। স্থানীয় লোকজনের চেষ্টায় একজনকে তাৎক্ষণিক উদ্ধার করা গেলেও সাড়ে ছয় ঘণ্টা পর স্বামী–স্ত্রী ও তাঁদের দুই বছরের সন্তানের মরদেহ উদ্ধার করেন সেনাবাহিনীর সদস্যরা।
গতকাল চামেলীবাগের টিলা ধসে মৃত্যুর খবর জানাজানি হলে নগরের অন্য টিলাগুলো কাটার বিষয়টি নতুন করে আলোচনায় আসে। এর পরই নগরের বড়গুল, কারিপাড়া, হাওলাদারপাড়া, ব্রাহ্মণশাসন, দুসকি, ডলিয়া ও মেজরটিলা এলাকার ১১টি টিলায় সরেজমিনে যান প্রথম আলোর এই দুই প্রতিবেদক। তাঁরা পাঁচটি টিলায় এমন নালা খুঁড়ে রাখার দৃশ্য দেখতে পান। অন্যগুলোতে নালা কাটা না থাকলেও ওপর থেকে নিচ পর্যন্ত টিলা কেটে রাখতে দেখা গেছে।
যাঁরা টিলা কাটছেন, তাঁদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে কি না,Ñএমন প্রশ্নের জবাবে পরিবেশ অধিদপ্তর সিলেটের বিভাগীয় কার্যালয়ের পরিচালক এ কে এম রফিকুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, যাঁদের বিরুদ্ধেই টিলা কাটার অভিযোগ ওঠে, দ্রুত ব্যবস্থা নেওয়া হয়।
স্ত্রী-সন্তানকে নিয়ে ঘুমিয়ে ছিলেন আগা করিম উদ্দিন (৩৪); কিন্তু সে ঘুম আর ভাঙল না। ঘুমের মধ্যেই টিলার মাটি ঘরের ওপর ধসে পড়ে স্ত্রী-সন্তানসহ তিনজনই মারা যান।
নিহত করিম উদ্দিন নগরের একটি ট্রাভেল এজেন্সিতে কাজ করতেন। করিমের সঙ্গে তাঁর স্ত্রী শাম্মী আক্তার (২৬) ও দুই বছরের ছেলে তানিমেরও মৃত্যু হয়। মাটিচাপা পড়ার প্রায় সাড়ে ছয় ঘণ্টা পর বেলা দেড়টার দিকে মৃত অবস্থায় তাঁদের উদ্ধার করা হয়।
সন্তান, পুত্রবধূ ও নাতিকে হারিয়ে শোকগ্রস্ত ইয়াছমিন বেগম (৫৫) বলেন, ‘আমার পুতে রোজা রাখছিল। সাহ্রি খাইছে, ইফতার করতে পারছে না আমার পুতে। এর আগেই আল্লাই তারে লইয়া গেলগি।’
ইয়াছমিন বেগম বলেন, তিনি বড় ছেলের দুই নাতিকে নিয়ে বাইরে বের হয়েছিলেন। সকাল সাতটার দিকে হঠাৎ শোঁ শোঁ শব্দ পান। এ সময় তিনি ঘরে ঘুমিয়ে থাকা সবাইকে ডাকতে গেলে ঘরের ওপর টিলার মাটি ধসে পড়ে। তখন বড় ছেলের স্ত্রী অক্ষত অবস্থায় ঘর থেকে ছোট শিশুকে নিয়ে বেরিয়ে আসতে পারলেও বড় ছেলে, ছোট ছেলে ও তাঁর স্ত্রী-সন্তান মাটির নিচে চাপা পড়েন। আশপাশের বাসিন্দারা এগিয়ে গিয়ে বড় ছেলেকে উদ্ধার করেন। পরে সেনাবাহিনীর সদস্যরা এসে তাঁর ছোট ছেলে, তাঁর স্ত্রী ও নাতিকে মৃত অবস্থায় উদ্ধার করে।
বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন (বাপা) জানিয়েছে, সিলেট নগর ও জেলায় গত এক দশকে টিলাধসে ৪০ জন মারা গেছেন। এর মধ্যে ২০২২ সালে জৈন্তাপুরে এক পরিবারের চারজন মারা যান।
চামেলীবাগের যে টিলাটি গতকাল ধসে পড়েছে, সেটি বেশ কিছুদিন ধরে দফায় দফায় কাটা হচ্ছিল বলে জানান স্থানীয় লোকজন। সরেজমিনে ওই টিলার একাংশ কেটে ফেলার অস্তিত্ব পাওয়া গেছে।
টিলার পাশের একাধিক বাসিন্দার অভিযোগ, স্থানীয় ৩৫ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর ও জেলা যুবলীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক জাহাঙ্গীর আলমের মদদে টিলাটি কাটা হচ্ছে। কাউন্সিলরের পৃষ্ঠপোষকতায় শতাধিক পরিবার ওই টিলার উপরে ও নিচে ঘর বানিয়ে ঝুঁকি নিয়ে বসবাস করছে। গত কয়েক দিনের বৃষ্টিতে টিলার মাটি নরম হয়ে এসেছিল। এ অবস্থায় গতকাল সকালে ভারী বৃষ্টিপাতে সেটি ধস পড়ে।
তবে টিলা কাটার পেছনে নিজের কোনো সম্পৃক্ততা নেই বলে দাবি করেছেন কাউন্সিলর জাহাঙ্গীর আলম। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘এটা মিথ্যা তথ্য। এ টিলার সঙ্গে আমার কোনো ধরনের সম্পৃক্ততা নেই।’
বাপা সিলেটের সাধারণ সম্পাদক আবদুল করিম চৌধুরী (কিম) বলেন, সিলেটের পাহাড়-টিলা রক্ষায় জনপ্রতিনিধি, প্রশাসন ও পরিবেশ অধিদপ্তর সম্পূর্ণরূপে ব্যর্থ। দায়িত্বশীলদের অনেকেই পাহাড়-টিলা রক্ষার গুরুত্ব অনুধাবন করেন না। তাই কোনোভাবেই টিলা কাটা থামানো যাচ্ছে না।
গতকাল দুপুরে কারিপাড়া এলাকায় গিয়ে দেখা গেছে, মূল সড়ক লাগোয়া রাস্তার পাশে একটি সুউচ্চ টিলা। বাঁশ ও লাঠি পুঁতে কয়েকটি ত্রিপল আর বস্তা সাঁটিয়ে বেড়া তৈরি করে টিলাটি ঢেকে দেওয়ার চেষ্টা করা হয়েছে। তবে ঢাকা অংশের ওপরে সদ্য কাটা টিলার লাল মাটি বেরিয়ে আছে। টিলা ঘিরে থাকা ত্রিপল উল্টিয়ে ভেতরে গিয়ে দেখা গেছে টিলার কিছু অংশ এমনভাবে কেটে রাখা হয়েছে, যাতে বৃষ্টি হলে মাটি ক্ষয়ে ধীরে ধীরে টিলার শ্রেণি পরিবর্তিত হয়ে সমতলভূমিতে রূপ নেয়।
পরিবেশকর্মীরা জানান, নগরের ব্রাহ্মণশাসন, দুসকি, হাওলাদারপাড়া, মেজরটিলা, খাদিমনগর, মালনীছড়া, বালুচর, চন্দসটিলাসহ অন্তত ৩০টি স্থানে টিলার পাদদেশে ঝুঁকি নিয়ে অন্তত ১০ হাজার পরিবার বসবাস করছে। এর বাইরে বিয়ানীবাজার, গোলাপগঞ্জ, জৈন্তাপুর ও ফেঞ্চুগঞ্জ উপজেলায়ও টিলার ঢালু ও পাদদেশে অসংখ্য বসতি আছে।
জানতে চাইলে সিলেটের জেলা প্রশাসক শেখ রাসেল হাসান প্রথম আলোকে বলেন, গত ২৮ মে থেকে সিলেটে টানা ভারী বৃষ্টিপাত শুরু হওয়ার পর টিলার পাদদেশে ঝুঁকিপূর্ণভাবে বসবাস না করার জন্য স্থানীয় প্রশাসন মাইকিংয়ের পাশাপাশি সতর্কতামূলক প্রচারণা চালিয়েছে। এটা অব্যাহত আছে। পাশাপাশি ঝুঁকিপূর্ণ টিলার পাদদেশে লাল নিশানও টাঙানো হচ্ছে।