শরীয়তপুর জেলা শহরের ধানুকা মনসা বাড়ির প্রবেশমুখেই দুর্গা ও কালীমন্দির। এর সামনেই ৮৯ শতক জমিতে একটি পুকুর ছিল। মনসা বাড়ি ও এর আশপাশে বসবাসরত হিন্দু সম্প্রদায়ের মানুষ পূজা–পার্বণে পুকুরটি ব্যবহার করতেন। দুর্গাপূজা শেষে দশমীর রাতে পুকুরটিতে প্রতিমা বিসর্জন দেওয়া হতো।
এখন আর সেই পুকুর নেই। কোথায় দুর্গা প্রতিমা বিসর্জন দেওয়া হবে, সেই চিন্তা মন্দির কমিটির। স্থানীয় লতিফ ঢালী নামের এক ব্যক্তির নেতৃত্বে পুকুরটি বালু দিয়ে ভরাট করে দখলের চেষ্টা করা হয়েছিল। এ নিয়ে গত ৯ সেপ্টেম্বর ‘মন্দিরের পুকুর বালু দিয়ে ভরাট’ শিরোনামে প্রথম আলোতে একটি সংবাদ প্রকাশিত হয়। এরপর স্থানীয় প্রশাসন সাইনবোর্ড ঝুলিয়ে পুকুরটি মন্দির কর্তৃপক্ষকে বুঝিয়ে দিলেও খনন করার উদ্যোগ নেওয়া হয়নি। বালু অপসারণ করে আবার পুকুরটি খনন করা হবে কি না, তা–ও জানে না মন্দির কর্তৃপক্ষ।
জেলা প্রশাসন ও ধানুকা মনসা বাড়ি মন্দির সূত্রে জানা যায়, পাঁচ শতাধিক বছর আগে ধানুকায় ১৫ একর জমির ওপর জমিদার ময়ূর ভট্টের বাড়ি ছিল। ওই বাড়িতে প্রাচীন কালের মনসামন্দির, কালীমন্দির, দুর্গামন্দির, টোলঘর ও পাঠশালার অবকাঠামো রয়েছে। কালের বিবর্তনে ময়ূর ভট্টের বাড়ির অধিকাংশ এখন মানুষের দখলে চলে গেছে। ময়ূর ভট্টের বংশের শ্যামা চরণ চক্রবর্তী মন্দিরগুলোসহ বাড়িটির কিছু অংশ আগলে রাখার চেষ্টা করেছিলেন। গত জানুয়ারি মাসে শ্যামা চরণ মারা যান। বর্তমানে ময়ূর ভট্টের বাড়িটি ধানুকা মনসা বাড়ি নামে পরিচিত। বাড়িটির ৮০ নম্বর ধানুকা মৌজার আরএস ও এসএ ১০৭৬ নম্বর দাগের ৮৯ শতক জমির ওপর একটি পুকুর ছিল। পুকুরটি ব্রহ্মোত্তর শ্যামা ঠাকুরানী গোসাইর দিঘি নামে দেবোত্তর সম্পত্তি। সর্বশেষ বিআরএস জরিপে ১১৭৭ নম্বর দাগে পুকুরটি ভিপি সম্পত্তি হিসেবে সরকারের ১/১ খতিয়ানে তালিকাভুক্ত করা হয়। পুকুরটি মনসা বাড়ির পূজা-অর্চনা ও বিভিন্ন প্রতিমা বিসর্জনের কাজে ব্যবহার করা হতো।
ধানুকা এলাকার বাসিন্দা আবদুল লতিফ ঢালী কিছু জাল কাগজ প্রস্তুত করে পুকুরের ওই সম্পত্তি ২০১৫ সালে তাঁর নামে নামজারি (মিউটেশন) করে নেন। এরপর আবার তিনি ২০১৭ সালে ওই একই সম্পত্তি আবার নামজারি করেন। অথচ সম্পত্তিটি দেবোত্তর। সর্বশেষ বিআরএস জরিপে তা ভিপি সম্পত্তি হিসেবে তালিকাভুক্ত হয়েছে।
এ ঘটনায় মনসা বাড়ি মন্দির কমিটির সভাপতি সমির কিশোর দে নামজারি বাতিলের আবেদন করেন। সেই আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে আবদুল লতিফ ঢালীর নামে করা নামজারি বাতিল করেন অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (রাজস্ব) সাইফুদ্দিন গিয়াস। এরপর জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে ওই জমি মন্দির কর্তৃপক্ষকে বুঝিয়ে দেওয়া হয়। তবে ভরাট করা পুকুরটি থেকে বালু অপসারণের কোনো উদ্যোগ নেয়নি জেলা প্রশাসন। যারা অবৈধভাবে বালু ভরাট করেছেন, তাঁদের বিরুদ্ধে কোনো আইনগত পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে অভিযুক্ত আবদুল লতিফ ঢালী কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি। নড়িয়ার ভোজেশ্বর এলাকা থেকে মনসা বাড়ির দুর্গাপূজা দেখতে এসেছিলেন বিপ্লব ঘোষ। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘প্রধান সড়ক থেকে পুকুরের পাড় দিয়ে মন্দিরের দিকে যেতে হয়। মন্দিরে প্রবেশের পথে ও মন্দিরের সামনে পুকুরটির বেশ নান্দনিক ও প্রাকৃতিক পরিবেশ দর্শনার্থীদের মুগ্ধ করত। কিন্তু এ বছর পুকুরটি নেই। মন্দির চত্বর খাঁ খাঁ করছে। ভাবতেই কষ্ট লাগছে। প্রশাসনের চোখের সামনে পুকুরটি ভরাট হয়ে গেল, তারা কিছুই করতে পারল না।’
ধানুকা মনসা বাড়ি মন্দির কমিটির সাধারণ সম্পাদক গোবিন্দ চক্রবর্তী প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমরা কোথায় প্রতিমা বিসর্জন দেব, তা ভেবেই কূল পাচ্ছি না। দখলদারেরা নানাভাবে আমাদের ভয় দেখানোর চেষ্টা করছেন। আমরা সব সময় আতঙ্কে থাকি, তাঁরা আবার কখন জমিটি দখলের চেষ্টা করেন।’
ধানুকা মনসা বাড়ি মন্দির কমিটির সভাপতি সমির কিশোর দে প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমরা হিন্দুরা নানা কারণে অসহায় অবস্থার মধ্যে থাকি। এখন প্রশাসন আমাদের পাশে না থাকলে কোথায় যাব? আমাদের মন্দিরের ব্যবহৃত পুকুরটি নেই। জেলা প্রশাসন থেকে বলা হয়েছিল, পুকুর থেকে বালু অপসারণ করে দেওয়া হবে।’
অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (রাজস্ব) সাইফুদ্দিন গিয়াস প্রথম আলোকে বলেন, মনসা বাড়ি মন্দিরটি প্রাচীন। একটি চক্র জালিয়াতির মাধ্যমে মন্দিরের একটি পুকুর দখলের চেষ্টা করেছিল। তাঁরা দখল বন্ধ করেছেন। ভরাট হওয়া পুকুরটি আবার খনন করার উদ্যোগ জেলা প্রশাসন থেকে নেওয়া হবে। তবে এ মুহূর্তে চাইলে মন্দির কর্তৃপক্ষ বালু অপসারণ করে পুকুরটি খনন করতে পারে। পরবর্তী সময়ে কোনো প্রকল্পের আওতায় তাঁদের সহায়তা করা হবে।