এতই কুয়াশা নেমেছে যে কুয়াশা ছাড়া আর কিছুই চোখে পড়ছে না। হালকা বৃষ্টি কণার মতো কুয়াশা। সড়ক, গাছপালা, গ্রাম—অগ্রহায়ণের অর্ধেক নাড়া, অর্ধেক ফসলে ভরা মাঠ কুয়াশায় ডুবে আছে। সড়ক ধরে আলো জ্বালিয়ে ধীরে ছুটছে ছোট-বড় গাড়ি। যত দূর চোখ যায়, শুধুই কুয়াশা।
গতকাল শনিবার মৌলভীবাজারের সারাটা সকাল এমনই কুয়াশায় জড়ানো ছিল। মৌলভীবাজার-শ্রীমঙ্গল সড়কে চলতে ১০০ হাত দূরের বস্তুও ঝাপসা লাগে। এর মধ্যে কাজের তাড়া খাওয়া মানুষ চাদর, মাফলারে ঘাড়-মাথা মুড়ে পথে বেরিয়েছেন। এ রকম কুয়াশা কেটে ভৈরবগঞ্জ বাজার পেরিয়ে বরুণা সড়ক ধরে এগিয়ে গেলে একসময় হঠাৎ যেন জেগে ওঠে একদল মানুষের চঞ্চলতায় মুখর ‘বরুণা ঘাটের বাজার’। এটি সকালবেলার পাইকারি মাছ বেচা-কেনার একটি হাট। মৌলভীবাজারের শ্রীমঙ্গল উপজেলার কালাপুর ইউনিয়নের হাইল হাওরপারে প্রায় চার দশক ধরে চলছে হাটটি।
তখন সকাল সাতটার কাছাকাছি। আশপাশের ঘরবাড়ি, সড়কের পাশের দোকানপাট, গাছপালা—কিছুই স্পষ্ট না, কুয়াশায় মোড়ানো। এর মধ্যে বরুণা ঘাটের বাজারে অনেক মানুষ। হাটের প্রায় পুরো অংশে বিশাল ডালপালা মেলা একটি বটগাছ দাঁড়িয়ে আছে, কুয়াশায় ভিজছে। বটগাছের নিচে ছোট ছোট দলে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে সবাই। কেউ দাঁড়িয়ে, কেউ বসে কথা বলছেন। বটগাছটি সারা হাটকে যেন আগলে আছে।
হাটটির বিভিন্ন দিকে মাছ পরিবহনের আগুল (ডোলা), প্লাস্টিকের ক্যারেট, ড্রাম রাখা। তখনো তেমন মাছ আসেনি। সবাই মাছের অপেক্ষা করছেন। হাইল হাওরের পারেই বরুণাঘাটের বাজার। হাওরের বিভিন্ন দিক থেকে মাছ নিয়ে আসেন মৎস্যজীবীরা। মাছশিকারিরা রাত জেগে হাওরের বিল, ডোবা থেকে এই মাছ ধরে থাকেন। গাঢ় কুয়াশায় বেলা যেন থমকে ছিল। এর মধ্যেই হঠাৎ করে চারদিক থেকে কাঁধের ভারে, সিএনজিচালিত অটোরিকশা ও টমটমে করে মাছ নিয়ে আসতে থাকেন বিক্রেতারা। সমস্ত স্থবিরতা ভেঙে ব্যস্ত হয়ে ওঠে হাটটি। একজন একজন করে মাছ নিয়ে আসেন আর তাঁকে ঘিরে ধরেন অন্যরা।
নিয়ম অনুযায়ী হাটে নিয়ে আসা মাছ নিলামে তোলা হয়। একজন উচ্চ গলায় দর হাঁকা শুরু করেন। যিনি শেষমেশ সর্বোচ্চ দাম বলেন, নিলামের ডাকের মাছ তাঁকেই দেওয়া হয়। একেকজন মাছ নিয়ে আসেন আর ছোট ছোট দলে এভাবে ডাক চলতে থাকে। ইদল আহমদ নামের একজন বলেন, ‘এখানে যা মাছ আসে, সব মাছ ডাকে ওঠে। সবচেয়ে বেশি যিনি দাম দেবেন, তিনিই ডাকের মাছ পাবেন।’
এভাবেই মাছ ডাকে তোলা হয়, ডাক চলতে থাকে। ডাক শেষ হলেই সর্বোচ্চ দরদাতা টাকা পরিশোধ করে মাছ নিয়ে সরে পড়েন। দিলওয়ার হোসেন পাঁচ হাজার টাকায় নিলাম ডাকে মিশ্র জাতের মাছ কিনেছেন। এই মাছের মধ্যে ছিল ছোট-বড় বোয়াল, শোল, কাতলা, কৈ, মেনা (ভেদা), খইশা ও ফলি (কাংলা) মাছ। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, তিনি এই মাছ শ্রীমঙ্গলের বাজারে নিয়ে বিক্রি করবেন।
বরুণাঘাটের বাজারে আসা মাছের মধ্যে ছিল হাইল হাওরের ছোট, মাঝারি ও বড় আকারের বোয়াল, রুই, কাতলা, পুঁটি, মলা, শোল, খইশা, কৈ, চ্যাং, মাগুর, গ্রাস কার্প ইত্যাদি। মাছপ্রেমীদের কাছে হাওরের মাছের আলাদা কদর। হাটে পাঙাশ, তেলাপিয়াসহ কিছু মাছ আছে চাষের। হাটে আসা প্রায় সব মাছই তাজা। এখানে একসঙ্গে কিনলেও প্রতিটি মাছের কম-বেশি আলাদা দাম আছে। এই মাছ নিয়ে মৌলভীবাজার, শ্রীমঙ্গল, কমলগঞ্জের মুন্সীবাজার, ভৈরবগঞ্জসহ আশপাশের বাজারে ছড়িয়ে পড়বেন খুচরা ক্রেতারা।
এই মাছ ব্যবসায়ীদের বড় অংশই বরুণা এলাকার। তাঁদের অনেকের একমাত্র পেশাও এটি। কিছু মাছ বরফ দিয়ে ড্রামে ভরে ঢাকাসহ নির্দিষ্ট স্থানে পাঠানো হয়। ড্রামে বরফ দিয়ে মাছ প্রক্রিয়াজাত করে রাখতে দেখা গেছে। ঝুমন আহমদ নামের এক তরুণ চ্যাং মাছের মতো দেখতে একটি সোনালি রঙের মাছ নিয়ে হাঁটছিলেন। তিনি মাছটিকে বাড়িতে কাচের পাত্রে সংরক্ষণ করবেন বলে জানিয়েছেন। এখানে সবাই যে ক্রেতা, সবাই বিক্রেতা—এমন না। অনেকেই আছেন দর্শক। আশপাশের লোক তাঁরা। মাছ কেনা-বেচা দেখতে এসেছেন। হাটের একমাত্র চা-স্টলটিতে তখন অনেক ভিড়। হাটে আসা অনেকেই সুযোগ মতো বসে সেখানে চা পান করছেন, পান চিবোচ্ছেন। সিগারেট ফুঁকছেন।
হাটের ব্যবস্থাপনার সঙ্গে যুক্ত মোবারক হোসাইন বলেন, এখানে মাছ বিক্রির জন্য যাঁরা আসেন, তাঁদের নির্দিষ্ট হারে টাকা জমা দিতে হয়। প্রতি ক্যারেট ১০ টাকা, প্রতি আগুল (ডোলা) ৫ টাকা এবং প্রতি ড্রাম ২০ টাকা।
মো. রফিক নামের এক বিক্রেতা বলেন, সব সময় বেচাবিক্রি একরকম হয় না। কম বেশি আছে। যে দিন বড় মাছ বেশি আসে, সে দিন টাকার পরিমাণ অনেক বেড়ে যায়। তবে গড়পরতা প্রতিদিন পাঁচ থেকে ছয় লাখ টাকার মাছ বিক্রি হয় এই হাটে।
স্থানীয় লোকজন জানান, বরুণা হাটের বাজারটি গড়ে উঠেছে হাইল হাওরের ওপর নির্ভরশীল স্থানীয় মৎস্যজীবীদের সুবিধার্থে। যাতে হাওরের মাছ একটি নির্দিষ্ট স্থানে সবাই বেচতে পারেন। ক্রেতারাও একটা নির্দিষ্ট সময়ে এসে এই জায়গা থেকে মাছ কিনতে পারেন। হাটটি গড়ে উঠেছে প্রায় ৪০ বছর হয়ে গেছে। প্রতিদিন সকাল সাতটা থেকে সাড়ে সাতটার দিকে হাটটি জমতে শুরু করে। গরমের দিনে আরও সকালে হাট শুরু হয়। তারপর দুই থেকে তিন ঘণ্টা হাটটি জমজমাট থাকে। কেনা-বেচা চলে। সকাল সাড়ে ৯টা থেকে ১০টার দিকে কেনা-বেচার মাছ শেষ হয়ে গেলে একসময় হাটে আর কেউ থাকেন না। অটোরিকশা, টমটমে করে মাছ নিয়ে ক্রেতারা যাঁর যাঁর গন্তব্যের দিকে ছুটতে থাকেন। জনশূন্য হাটে বটগাছটি একলা পাহারায় দাঁড়িয়ে থাকে।