সারা বছরই টুকটাক কেনাকাটা চলে। তবে হাটের সেই চেহারা বদলে যায় কোরবানির ঈদের দিন দুপুরের পর থেকে। ঈদের পরের দিন পর্যন্ত একেবারেই ভিন্ন চেহারা পেয়ে যায় স্থানটি। নানা রকম উঠতি-পড়তির ভেতর দিয়ে সময় গেলেও চামড়া বেচাকেনায় ঐতিহ্যের ধারাবাহিকতা এখনো টিকে আছে হাটটিতে।
দেড় শতাধিক বছর আগে মৌলভীবাজার সদর উপজেলার চাঁদনীঘাট ইউনিয়নের মনু নদের পাড়ে গড়ে উঠেছে বালিকান্দি বাজার। এ হাটে শুরু থেকেই পশুর চামড়া কেনাবেচা হতো। সেই থেকে হাটটি চামড়া বাজারের পরিচিতি পেয়েছে। কোরবানির ঈদকে ঘিরে যত রকম উৎসব-আয়োজন, বালিকান্দি চামড়া বাজারে চামড়া বেচাকেনা তারই একটি।
গতকাল সোমবার পবিত্র ঈদুল আজহার দিনের সকালটা কেটেছে হালকা ও ভারী বর্ষণের ভেতর দিয়ে। সকাল থেকেই লাগাতার, থেমে থেমে ঝমঝমিয়ে বৃষ্টি ঝরেছে। বৃষ্টি কিছুটা থেমেছে দুপুরের দিকে। আর দুপুরের পর থেকেই একটু একটু করে বালিকান্দি চামড়ার বাজারও জমে উঠতে থাকে। বিকেলে বালিকান্দি বাজারে যাওয়ার পথে মৌলভীবাজার শহরতলি চাঁদনীঘাট মনু সেতুর কাছে দেখা যায়, অনেক মানুষের ভিড়।
সড়কের দুই পাশে ফুটপাতে, বালিকান্দি-চাঁদনীঘাট সড়কের দুই ধারে মানুষের জটলা। কারও হাতে, কারও সামনে ছোট ছোট ব্যাগ। এসব ব্যাগ, পোঁটলা হচ্ছে মাংসের। দরিদ্র নারী-পুরুষ বিভিন্ন গ্রাম এবং মৌলভীবাজার শহরের বাসাবাড়ি ঘুরে টুকরা-টাকরা গরুর মাংস জড়ো করেছেন। নিজেদের জন্য কিছুটা রেখে বাকিটুকু বিক্রির জন্য নিয়ে এসেছেন। এক-দুজন করে মাংস নিয়ে আসছেন, আর তাঁকে ক্রেতারা জেঁকে ধরছেন। ভিড় বুঝে বিক্রেতারাও মাংসের আনুমানিক ওজন অনুযায়ী দেড় থেকে চার হাজার টাকা পর্যন্ত দাম চাইছেন। ক্রেতার অনেকে অর্ধেক, অর্ধেকের নিচে দাম বলছেন। দরদাম ঠিক হলে টাকা দিয়ে ব্যাগ নিয়ে যাচ্ছেন। এই ক্রেতারা হচ্ছেন যাঁরা কোরবানি দেননি, আবার কারও কাছ থেকে মাংস পাওয়ার সুযোগ নেই, সামাজিক কারণেও কারও কাছে চাইতে পারেন না তাঁরা। অনেকে ছোটখাটো চাকরি করেন। দায়িত্ব পালন করে বাড়ি ফিরছেন। তাঁদের সংসার আছে। সংসারে শিশুসহ সদস্যরা আছেন। অন্তত ঈদ উপলক্ষে দুয়েক বেলা মাংসের ব্যবস্থা করতে এই টুকরা-টাকরা মাংসের হাটে তাঁরাই ভিড় করেন। বছর কয়েক ধরে এই এক বেলা টুকরা মাংসের হাট বসতে দেখা গেছে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন ক্রেতা গতকাল সন্ধ্যায় প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমি রাজনগর থাকি আইছি (থেকে আসছি)। আগে কোরবানি দিতাম। গরিব মানুষ, কোরবানি দিছি না। তুরা (অল্প) মাংস কিনতাম আইছি।’
চাঁদনীঘাট সেতু থেকে বালিকান্দি বাজারের কাছে দেখা গেল আরেক চেহারা। চামড়ার স্থায়ী, অস্থায়ী আড়তগুলোতে তখন অন্য উৎসব। প্রায় আধা কিলোমিটারজুড়ে ততক্ষণে মানুষের ব্যস্ততা বেড়ে গেছে। কয়েক শ মানুষ নানাভাবে তৎপর। ট্রাক, পিকআপ ভ্যান, রিকশা ভ্যান, ব্যাটারিচালিত রিকশা, হাতব্যাগসহ বিভিন্ন মাধ্যমে বালিকান্দি বাজারে চামড়া নিয়ে আসছেন বিক্রেতারা। বিভিন্ন স্থান থেকে চামড়া সংগ্রহ করে নিয়ে এসেছেন। সন্ধ্যা ঘনিয়ে এসেছে, কিন্তু তখনো চামড়ার মূল স্রোত এসে বাজারে ঢোকেনি। তাতেও বাজার চঞ্চল হয়ে উঠেছে। কেউ ট্রাক থেকে চামড়া নামাচ্ছেন, কেউ ছোটবড় চামড়া বাছাই করছেন। কেউ চামড়া থেকে মাংস আলাদা করছেন। এই কাজ যাঁরা করেন, তাঁদের অনেকেই এ কাজে দক্ষ এবং তাঁরা মৌসুমি শ্রমিক। এই এক দিনে বাড়তি কিছু নগদ টাকা আয়রোজগার করেন। রাত বাড়লে শুরু হয় চামড়ায় লবণ লাগানোর কাজ। তখন রাত আর দিন বলে কিছু থাকে না। রাতদিন একাকার হয়ে যায়। লবণ লাগিয়ে স্তূপ করে রাখা হবে চামড়া।
স্থানীয় লোকজন জানিয়েছেন, এখানে কেউ চামড়া পরিষ্কার করেন। কেউ চামড়ায় লবণ লাগানোর কাজ করেন। তাঁদের কাজের ধরন ও মাত্রা অনুযায়ী মজুরি নির্ধারণ করা আছে। কিছু লোক চামড়া পরিষ্কার করেন, কিন্তু টাকা নেন না। তাঁরা চামড়া থেকে মাংস বের করে সেই মাংস বিক্রি করেন। কেউ নিজেদের জন্যও চামড়া থেকে মাংস সংগ্রহ করেন। এই এক দিন (কোরবানির ঈদের দিন) বাজারের চা-স্টলসহ প্রায় অন্য সব দোকানও সারা রাত খোলা থাকে। অনেকে বসে বসে আড্ডা দেন।
ব্যবসায়ী ও স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, ব্রিটিশ আমলে বালিকান্দি বাজার প্রতিষ্ঠার শুরু থেকেই এখানে চামড়া ব্যবসা চলছে। সারা বছরই বিভিন্ন এলাকা থেকে ফড়িয়া ও ছোট ব্যবসায়ীরা এখানে চামড়া নিয়ে আসেন। তবে কোরবানির ঈদেই চামড়ার বড় বাজার বসে। বাজারে পাঁচ থেকে ছয়জন স্থায়ী ব্যবসায়ী আছেন। যাঁরা সারা বছরই চামড়া বেচাকেনা করেন। এ ছাড়া ঈদের সময় আরও প্রায় অর্ধশত মৌসুমি ব্যবসায়ী সক্রিয় হন। যাঁরা কয়েক শ চামড়া কিনে প্রক্রিয়াজাত করেন। পরে বড় ব্যবসায়ী বা ঢাকার ব্যবসায়ীর কাছে বিক্রি করেন। তবে ঢাকা ও নাটোরের অনেক আড়তদার এবং ট্যানারিমালিক নানা অজুহাতে এখানকার ব্যবসায়ীদের পাওনা টাকা আটকে দেওয়ায় ২০১৪ সালের পর থেকে বাজারটি অনেকটা জৌলুশ হারিয়েছে। পুঁজি হারিয়ে অনেকে ব্যবসা ছেড়ে দিয়েছেন। তবে এবার ব্যবসা কিছুটা ভালো হতে পারে বলে অনেকে মনে করছেন। এবার বড় গরুর চামড়া ৩০০ থেকে সাড়ে ৪০০ টাকা এবং ছোট গরুর ২০০ থেকে ২৫০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে।
চাঁদনীঘাট ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) সদস্য ও বালিকান্দি চামড়া ব্যবসায়ী সমিতির সভাপতি মো. শওকত বলেন, ‘আমরা সব সময় চামড়া বেচাকেনা করি। ১৫০ থেকে ২০০ বছর ধরে আমরার বাপ-দাদাসহ সবাই চামড়া ব্যবসার সঙ্গে জড়িত। তবে ২০১৩ সাল থাকি (থেকে) কয় বছর আমরা মার খাইছি, অনেক লোকসান অইছে (হয়েছে)। চামড়ার দাম কমছে, লবণের দাম বাড়ছে। চামড়ার দাম পাইছি না অনেক সময়। দুই বছর কম দামে চামড়া বেচাবিক্রি অইছে, তবে টাকা পাই গেছি (পেয়েছি)। এবারও সরকারের মাধ্যমে ট্যানারিগুলো যে রেট দিছে, আমরা আশা করি, এ হিসাবে যদি টাকা পাই। তাইলে লাভবান হব।’