কিশোরগঞ্জের ঐতিহাসিক পাগলা মসজিদের দানবাক্স তিন মাস পরপর খোলা হয়। কয়েক বছর ধরে প্রতিবার নগদ টাকা পাওয়া যাচ্ছে কোটির ওপরে। সঙ্গে থাকছে বৈদেশিক মুদ্রা, সোনার গয়না, হীরা। মসজিদ কমিটির মাধ্যমে এই টাকা ব্যয় করা হয়। তবে নির্ধারিত বেশ কয়েকটি খাতে ব্যয় করেও জমা হয়েছে বিপুল অঙ্কের টাকা, যা দিয়ে আধুনিক ইসলামি কমপ্লেক্স নির্মাণের প্রকল্প নিয়েছে মসজিদ কমিটি।
৯৭ দিন পর সর্বশেষ গত শনিবার পাগলা মসজিদের ৮টি দানসিন্দুক খোলা হয়। এদিন বৈদেশিক মুদ্রা, হীরা, স্বর্ণালংকারসহ ২০ বস্তা টাকা পাওয়া যায়। ২০৬ জন মিলে দিনভর ২০ বস্তা টাকা গুনে ৪ কোটি ১৮ লাখ ১৬ হাজার ৭৪৪ টাকা পাওয়া যায়, যা এ যাবৎকালে সর্বোচ্চ দানের টাকা পাওয়ার রেকর্ড। শেষ ৯৭ দিনের হিসাব অনুযায়ী, এই মসজিদে মানুষ প্রতিদিন গড়ে ৪ লাখ ৩১ হাজার টাকার বেশি দান করছেন। এর আগে গত ১ অক্টোবর পাগলা মসজিদের দানবাক্স খুলে পাওয়া গিয়েছিল ১৫ বস্তা টাকা। দিনভর গুনে ৩ কোটি ৮৯ লাখ ৭০ হাজার ৮৮২ টাকা পাওয়া গিয়েছিল।
জেলা শহরের হারুয়া এলাকায় নরসুন্দা নদীপাড়ে অবস্থিত পাগলা মসজিদ। কথিত আছে, সঠিক নিয়তে এখানে দান করলে মানুষের মনের ইচ্ছা পূরণ হয়। সেই আকাঙ্ক্ষা থেকে বিভিন্ন প্রান্তের মানুষ এখানে দান করতে আসেন।
দীর্ঘদিন ধরেই পাগলা মসজিদে মানুষ দান করে আসছেন। তবে দানের বিপুল পরিমাণ টাকা পাওয়া শুরু হয় ২০১৫ সালের শুরুর দিকে। তখন ৮টি লোহার সিন্দুক খুলে একসঙ্গে প্রায় ৬৫ লাখ টাকা ও স্বর্ণালংকার পাওয়া যায়। তখনকার সময়ে ছয় মাস পরপর সিন্দুক খোলা হতো। এর পরেরবার পাওয়া গিয়েছিল প্রায় ৭৮ লাখ টাকা। ২০১৬ সালের শেষের দিকে সর্বোচ্চ প্রায় ১ কোটি ১০ লাখ টাকার ওপরে মিলেছিল দানসিন্দুকে। দিন দিন টাকা, বৈদেশিক মুদ্রা বেড়ে যাওয়ায় এর পর থেকে ছয় মাসের জায়গায় তিন মাস পরপর টাকার সিন্দুক খোলার প্রথা চালু হয়।
প্রতিবার প্রশাসন, ব্যাংক কর্মকর্তা, মসজিদ কমিটির লোকজন, গণমাধ্যমকর্মীসহ সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের উপস্থিতিতে দানবাক্স খোলা হয়। দিনভর গণনা শেষে ঘোষণা করা হয় দানের টাকার পরিমাণ। প্রথম আলোর প্রতিবেদন অনুয়ায়ী, ২০১৮ সালের ৩১ মার্চ ৮৪ লাখ ৯২ হাজার টাকা, একই বছরের ৭ জুলাই ৮৮ লাখ ২৯ হাজার ১৭ টাকা, একই বছরের ১৩ অক্টোবর ১ কোটি ১৩ লাখ ৯৬ হাজার ৬৮৫ টাকা পাওয়া গিয়েছিল। ২০১৯ সালের ১৯ জানুয়ারি পাওয়া যায় ১ কোটি ১৩ লাখ ৩৩ হাজার টাকা।
পাগলা মসজিদ ও ইসলামি কমপ্লেক্সের বর্তমান কমিটিতে ৩১ জন সদস্য রয়েছেন। তাঁদের মধ্যে স্থানীয় বিশিষ্ট ব্যক্তি, আইনজীবী, সাংবাদিকসহ বীর মুক্তিযোদ্ধারা আছেন।
২০১৯ সালের মার্চ থেকে করোনায় কিছুদিনের জন্য সবকিছু বন্ধ থাকলেও পাগলা মসজিদে দানের প্রবাহ বন্ধ থাকেনি। ২০১৯ সালের ২৬ অক্টোবর আবারও দানসিন্দুক খুলে ১ কোটি ৫০ লাখ ৮৪ হাজার ৫৯৮ টাকা পাওয়া যায়। এরপর ২০২০ সালের ১৬ ফেব্রুয়ারি ১ কোটি ৫০ লাখ ১৮ হাজার ৪৯৮ টাকা, একই বছরের ২২ আগস্ট ১ কোটি ৭৪ লাখ ৮৩ হাজার ৭১ টাকা পাওয়া গিয়েছিল। ২০২১ সালের ২৩ জানুয়ারি আবারও পাগলা মসজিদের দানসিন্দুক খোলার পর সর্বোচ্চ ২ কোটি ৩৮ লাখ ৫৫ হাজার ৫৪৫ টাকা পাওয়া যায়। একই বছরের ১৯ জুন স্বর্ণালংকার, বৈদেশিক মুদ্রাসহ ২ কোটি ৩৩ লাখ ৯৩ হাজার ৭৭৯ টাকা পাওয়া যায়। একই বছরের ৭ নভেম্বর আবারও দানসিন্দুক খুলে সোনা, হীরাসহ রেকর্ড ৩ কোটি ৭ লাখ ১৭ হাজার ৫৮৫ টাকা পাওয়া যায়।
২০২২ সালের ১২ মার্চ স্বর্ণালংকার, হীরা ও বৈদেশিক মুদ্রা ছাড়াও পাওয়া গিয়েছিল ৩ কোটি ৭৮ লাখ ৫৩ হাজার ২৯৫ টাকা। একই বছরের ২ জুলাই আবারও দানসিন্দুক খুলে ৩ কোটি ৬০ লাখ ২৭ হাজার ৪১৫ টাকা পাওয়া যায়। একই বছরের ১ অক্টোবর পাগলা মসজিদের দানবাক্স খুলে পাওয়া গিয়েছিল ৩ কোটি ৮৯ লাখ ৭০ হাজার ৮৮২ টাকা। শনিবার পাওয়া যায় ৪ কোটি ১৮ লাখ ১৬ হাজার ৭৪৪ টাকা। এ ছাড়া এদিন বিপুল পরিমাণ সোনা, রুপা, হীরার অলংকারসহ বৈদেশিক মুদ্রাও ছিল। ২০১৮ সালের মার্চ থেকে চলতি বছরের ৭ জানুয়ারি পর্যন্ত সাড়ে ৪ বছরে কেবল নগদ টাকা পাওয়া গেছে প্রায় ৩০ কোটি।
১৯৭৯ সাল থেকে প্রশাসনের নিয়ন্ত্রণে পাগলা মসজিদের কার্যক্রম চলে আসছে। সেই থেকে পদাধিকার বলে কিশোরগঞ্জের দায়িত্বপ্রাপ্ত জেলা প্রশাসকেরা পাগলা মসজিদ কমিটির সভাপতির দায়িত্বপালন করে আসছেন।
পাগলা মসজিদ ও ইসলামি কমপ্লেক্সের প্রশাসনিক কর্মকর্তা বীর মুক্তিযোদ্ধা মো. শওকত উদ্দিন ভূঁইয়া প্রথম আলোকে বলেন, অনেক আগে থেকেই অন্যান্য মসজিদের তুলনায় এ মসজিদে দান–খয়রাত বেশি হয়। যে কারণে এ মসজিদের অর্থ দিয়ে জেলা শহরের ঐতিহাসিক শহীদি মসজিদসহ বিভিন্ন মসজিদের উন্নয়মূলক কার্যক্রম হয়। পাশাপাশি পাগলা মসজিদ ও ইসলামি কমপ্লেক্সের খরচসহ জেলার বিভিন্ন মাদ্রাসা ও এতিমখানায় অনুদান দেওয়া হয়। অসহায় ও জটিল রোগে আক্রান্ত ব্যক্তিদেরও সহায়তা করা হয়। তবে এখানে একটি মেগা প্রকল্প ইসলামি কমপ্লেক্সের উদ্যোগ নেওয়ার কারণে গত প্রায় দুই বছর ধরে অন্যান্য মসজিদের উন্নয়নমূলক কার্যক্রমে অর্থ বরাদ্দ স্থগিত করা হয়েছে।
পাগলা মসজিদ ও ইসলামি কমপ্লেক্সের বর্তমান কমিটিতে ৩১ জন সদস্য রয়েছেন। তাঁদের মধ্যে স্থানীয় বিশিষ্ট ব্যক্তি, আইনজীবী, সাংবাদিকসহ বীর মুক্তিযোদ্ধারা আছেন। কমিটির সভাপতি কিশোরগঞ্জের জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ আবুল কালাম আজাদ এবং সাধারণ সম্পাদক পৌরসভার মেয়র মো. পারভেজ মিয়া।
শওকত উদ্দিন ভূঁইয়া বলেন, সভাপতি-সাধারণ সম্পাদকের যৌথ স্বাক্ষরে পাগলা মসজিদের আর্থিক লেনদেন হয়ে থাকে। এ মসজিদের টাকা দুটি ব্যাংকে রয়েছে। এর মধ্যে রূপালী ব্যাংকে নিয়মিত লেনদেনের পাশাপাশি মেঘনা ব্যাংকে একটি ফিক্সড ডিপোজিট রয়েছে। তিনি বলেন, মসজিদের আয় দিয়ে এ কমপ্লেক্সে অবস্থিত নুরুল কোরআন হাফিজিয়া মাদ্রাসার ১৩০ জন এতিম ও দুস্থ শিক্ষার্থীর বিনা মূল্যে পড়াশোনা ও ভরণপোষণ করা হচ্ছে। এ ছাড়া এখানে দায়িত্বরত কর্মীদের বেতনও এ মসজিদের আয় থেকে দেওয়া হয়।
মসজিদ কমিটি সূত্রে জানা গেছে, দানের অর্থ দিয়ে মসজিদের পাঁচ একর জায়গায় অতি দ্রুত একটি দৃষ্টিনন্দন ও আধুনিক স্থাপনা নির্মাণ করা হবে। এতে প্রাথমিক ব্যয় ধরা হয়েছে ১১৫ কোটি টাকা। মূল মসজিদটি ছয়তলা বিশিষ্ট হবে। প্রতি তলায় একসঙ্গে পাঁচ হাজার মুসল্লি নামাজ আদায় করতে পারবেন। পাশাপাশি আরও পাঁচ হাজার নারী মুসল্লির জন্য আলাদা নামাজের ব্যবস্থা থাকবে। এ ছাড়া শুক্রবার বা বিশেষ দিনে মসজিদের প্রাঙ্গণ মিলিয়ে প্রায় ৪০ হাজার মুসল্লি একসঙ্গে নামাজ আদায় করতে পারবেন।
পরিকল্পনা অনুযায়ী, ছয়তলা ভবনটির নিচে গাড়ি পার্কিংয়ের ব্যবস্থা থাকবে। এ ছাড়াও থাকবে একাডেমিক ভবন ও অতিথিশালা। অতিথিশালায় রাষ্ট্রের অতি গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের অবস্থানের ব্যবস্থাও থাকবে। মাদ্রাসা, গ্রন্থাগারসহ উন্নত মানের সাউন্ড সিস্টেম ও ১২০ ফুট উচ্চতার দৃষ্টিনন্দন মিনার থাকবে, যাতে আকর্ষণীয় লাইটিংয়ের ব্যবস্থা থাকবে। এ ছাড়া ভবনটিতে স্বয়ংক্রিয় আলোর ব্যবস্থা থাকবে, যা হবে দেশের মধ্যে অনন্য এক স্থাপনা।
জেলা প্রশাসক ও মসজিদ কমিটির সভাপতি মোহাম্মদ আবুল কালাম আজাদ প্রথম আলোকে বলেন, দৃষ্টিনন্দন পাগলা মসজিদ ও ইসলামি কমপ্লেক্স নির্মাণের জন্য একটি মেগা প্রকল্প হাতে নেওয়া হয়েছে। ইতিমধ্যে এর দরপত্র আহ্বান করা হয়েছে। প্রকৌশলীদের পরামর্শক নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। তাঁরা যাচাই-বাছাইয়ের পর নকশা চূড়ান্ত করে দিলেই দ্রুত কাজ শুরু হয়ে যাবে।
জেলা প্রশাসক বলেন, প্রকল্পের প্রাথমিক খরচ ধরা হয়েছে ১১৫ কোটি টাকা। কাজ শুরু হলে এর কমবেশিও হতে পারে। তাঁদের কাছে বর্তমানে অর্ধেকের কিছু কম টাকা রয়েছে। প্রাথমিক পর্যায়ে তাঁরা কাজ ধরতে পারবেন। তবে কাজ শুরু করলে বাকি টাকাও ব্যবস্থা হয়ে যাবে বলে তিনি আশা করছেন।
মসজিদের পেশ ইমাম মুফতি খলিলুর রহমান বলেন, সওয়াবের নিয়তে মসজিদে অনেক দূরদূরান্ত থেকে মানুষ এসে দান-খয়রাত করে থাকেন। খাস নিয়তে দান করলে মানুষের ইচ্ছা, মনের আশা ও বাসনা পূরণ হয়, সেই বিশ্বাস থেকে এখানে টাকাপয়সা, স্বর্ণমুদ্রা, হীরা, গবাদিপশুসহ অনেক জিনিস দান করে থাকেন।
মসজিদ কমপ্লেক্সের কর্মী মো. আলমগীর হোসেন বলেন, দেশ ও দেশের বাইরে থেকে বিভিন্ন ধর্মাবলম্বী মানুষ প্রতিদিন এখানে দান করতে আসেন। দান করতে এসে অনেকে তাঁদের মনের কথা বলেন। এমন দুজন ব্যক্তির ঘটনা উল্লেখ করে আলমগীর হোসেন বলেন, কিশোরগঞ্জ সদরের এক সিএনজিচালিত অটোরিকশাচালকের শিশুসন্তান দুর্ঘটনায় মারাত্মক আহত হয়। ওই ব্যক্তি সন্তানের সুস্থতার জন্য নিজের অটোরিকশাটি পাগলা মসজিদে দানের নিয়ত করেন। কিছুদিন পরই শিশুটি সুস্থ হয়ে উঠলে ওই ব্যক্তি অটোরিকশাটি মসজিদে দিয়ে যান। পরে মসজিদের পক্ষে নিলামের মাধ্যমে অটোরিকশাটি ৭১ হাজার টাকায় বিক্রি করা হয়। ঢাকার এক ব্যবসায়ীর বিয়ের ১৭ বছর পরও কোনো সন্তান হচ্ছিল না। পাগলা মসজিদে দানের নিয়ত করার পরের বছর একটি ছেলেসন্তানের জন্ম হয়। পরে ২০১৭ সালের দিকে তিনি পাগলা মসজিদে এসে ১ লাখ ২০ হাজার টাকা দান করেন।
মো. আলমগীর হোসেন বলেন, গত শুক্রবারও এক লোক গাড়িতে করে এসে ব্যাগভর্তি প্রায় আড়াই লাখ টাকা মসজিদের দানবাক্সে নিজ হাতে দিয়ে যান। অনেকেই আবার গরুসহ মূল্যবান জিনিসপত্র নিয়ে আসেন। সম্প্রতি একজনের দান করা ১টি গরু ১ লাখ ২০ হাজার টাকায় বিক্রি করা হয়েছে।
কিশোরগঞ্জ জেলা প্রশাসনের ওয়েবসাইটে দেওয়া বর্ণনা অনুযায়ী, জনশ্রুতি আছে যে পাগলবেশী এক আধ্যাত্মিক পুরুষ খরস্রোতা নরসুন্দা নদীর মধ্যস্থলে মাদুর পেতে ভেসে এসে বর্তমান মসজিদের কাছে স্থিত হন। তাঁকে ঘিরে আশপাশে অনেক ভক্ত সমবেত হন। মৃত্যুর পর তাঁর সমাধির পাশে পরবর্তীতে এই মসজিদ গড়ে ওঠে। কালের পরিক্রমায় যা পাগলা মসজিদ নামে পরিচিত হয়।