বান্দরবানের নাইক্ষ্যংছড়ি সীমান্ত থেকে সাত কিলোমিটার দূরে রামুর কচ্ছপিয়া ইউনিয়নের গর্জনিয়া বাজার। সেখান থেকে আধা কিলোমিটার এগোলে গর্জনিয়া পশু বিক্রির হাট। এবার ঈদ উপলক্ষে এই হাট বেশ জমজমাট। গতকাল বৃহস্পতিবার দুপুরে হাটে গিয়ে দেখা যায় যে বড়, ছোট ও মাঝারি মিলিয়ে ৮০০টির মতো গরু উঠেছে। এর মধ্যে কমপক্ষে ৬০০টি মিয়ানমারের চোরাই গরু। দেশীয় বলে এসব গরু বিক্রি হচ্ছে।
সীমান্তের বিভিন্ন সূত্র ও অনুসন্ধানে জানা গেছে, নাইক্ষ্যংছড়ির দুর্গম সীমান্ত দিয়ে রাতের আঁধারে বাংলাদেশে ঢুকছে মিয়ানমারের শত শত গরু। ঘাটে ঘাটে চাঁদা দিয়ে সেই চোরাই গরু সাত কিলোমিটার দূরে কক্সবাজারের রামুর গর্জনিয়া বাজারে পৌঁছে যাচ্ছে। এরপর এই বাজার থেকে ঢাকা, চট্টগ্রাম ও কক্সবাজারের ব্যবসায়ীরা কিনে নিচ্ছেন। চোরাই গরু কেনাবেচার সঙ্গে জড়িত রয়েছেন স্থানীয় ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান, সদস্য থেকে শুরু করে স্থানীয় রাজনৈতিক দলের নেতা-কর্মীরা। গরু পাচারকে ঘিরে গত কয়েক মাসে পাঁচজনের মৃত্যু হয়েছে। বিজিবির সঙ্গে কারবারিদের গোলাগুলিতে হতাহতের ঘটনাও ঘটছে। আবার ডাকাত দলের গুলিতে কৃষকের মৃত্যু হয়েছে। কিন্তু চোরাচালান বন্ধ করতে পারছে না সরকারি সংস্থাগুলো।
সীমান্ত ও স্থানীয় সূত্র বলছে, গত এপ্রিল ও মে মাসে সীমান্ত দিয়ে এপারে চোরাই গরু ঢুকেছে ৭০ হাজারের বেশি। চলতি জুন মাসের প্রথম ১২ দিনে ঢুকেছে ৩৭ হাজারের বেশি গরু। গর্জনিয়া বাজার পর্যন্ত আনতে প্রতিটি গরুর জন্য ১১টি স্থানে মোট ১৭ হাজার টাকা করে চাঁদা দিতে হয় ব্যবসায়ীদের।
মিয়ানমার থেকে আসা এসব গরুর শরীরে সাংকেতিক চিহ্নের সিল মারা থাকে। গর্জনিয়া বাজারে তোলার আগে রাসায়নিক দিয়ে সেই সিল মুছে ফেলার চেষ্টা চলে। তারপরও কিছু গরুর গায়ে সিল থেকে যায়। মিয়ানমারের পাচারকারীরা গণনার সুবিধার্থে এই সিল লাগিয়ে দেয় বলে ব্যবসায়ীরা জানিয়েছেন।
বৃহস্পতিবার গর্জনিয়া হাটের একপাশে সাতটি চোরাই গরু নিয়ে দাঁড়িয়ে ছিলেন দোছড়ির বাসিন্দা মো. এরশাদুল্লাহ (৪৫)। সব কটি গরুর গায়ে সিল মারা ছিল। চোরাই গরু বিক্রির কারণ জানতে চাইলে এরশাদুল্লাহ বলেন, গরু মিয়ানমারের হলেও তিনি বাংলাদেশ সীমান্ত থেকে কিনেছেন। এরপর ১৬ হাজার টাকা চাঁদা দিয়ে হাটে এনেছেন।
আরেক ব্যবসায়ী সাহেব আলী (৪৪) বাজারে আনেন ১১টি চোরাই গরু। সেগুলোর ওজন গড়ে চার থেকে ছয় মণ। সাহেব আলী বলেন, সীমান্তে বিভিন্ন পক্ষকে চাঁদা দিয়ে এ ব্যবসা চলছে। দামে সস্তা হওয়ায় ঢাকা-চট্টগ্রামের ব্যবসায়ীরা মিয়ানমারের গরু কিনে নিয়ে যাচ্ছেন। চার-পাঁচ মণ ওজনের গরু বিক্রি হচ্ছে ৮০ হাজার থেকে ১ লাখ ১০ হাজার টাকায়। এ ক্ষেত্রে দেশীয় গরুর দাম হাঁকা হয় দেড় লাখ টাকা।
টানা তিন বছর ধরে গর্জনিয়া পশুর হাটের ইজারাদার কক্সবাজার সদরের ব্যবসায়ী তিনি। চলতি বছর ৪ কোটি ২৭ লাখ টাকায় বাজারটির ইজারা নেন আবদুর রহিম। মিয়ানমারের চোরাই গরু কেনাবেচার কারণে এ হাট জেলার সর্বোচ্চ ইজারার বাজারে পরিণত হয়েছে। এর মধ্যে গত ১৪ এপ্রিল থেকে বাজার ইজারা নেওয়ার দুই মাসে প্রায় ১ কোটি টাকা ইজারা আদায় করেছেন এ ইজারাদার।
জানতে চাইলে আবদুর রহিম প্রথম আলোকে বলেন, নাইক্ষ্যংছড়ি সীমান্ত দিয়ে যখন গরু আনা হয়, তখন পুলিশ-বিজিবি (বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ) কেউ ধরে না। ওই গরু হাটে এনে দেশীয় বলে দাবি করা হয়। তা ছাড়া হাটে কোনটি মিয়ানমারের আর কোনটি দেশীয় গরু, তা-ও পরখ করা যায় না।
চোরাই গরু থেকে চাঁদা আদায়ের অভিযোগ অস্বীকার করেছেন রামু থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) আবু তাহের দেওয়ান। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, মিয়ানমারের গরু আসে নাইক্ষ্যংছড়ির দুর্গম সীমান্ত দিয়ে। সীমান্ত দেখভালের দায়িত্বে আছে বিজিবি। গর্জনিয়ার বাজার থেকে চোরাই গরু কিনে নিয়ে যাওয়ার সময় পুলিশ ধাওয়া করে আটকের চেষ্টা করে। কিন্তু পাহাড়–জঙ্গলে ঢুকে গেলে আর ধরা সম্ভব হয় না।
এ প্রসঙ্গে জানার জন্য একাধিকবার চেষ্টা করেও নাইক্ষ্যংছড়ি ১১ বিজিবি ব্যাটালিয়নের অধিনায়ক লেফটেন্যান্ট কর্নেল সাহাল আহমদের বক্তব্য পাওয়া যায়নি। তাঁর সরকারি মুঠোফোনে খুদে বার্তা পাঠিয়েও সাড়া মেলেনি। তবে বিজিবির এক সদস্য বলেন, গত কয়েক মাসে পাচারের সময় বিজিবি কয়েক দফায় আট শতাধিক গরু জব্দ করেছে।
মঙ্গলবার রাত ১০টা। ঘুমঘুম ইউনিয়নের সীমান্তঘেঁষা গ্রাম রেজুপাড়া, তুমব্রু, নয়াপাড়া, হেডম্যান পাড়া। গ্রামগুলোর বিপরীতে কয়েক শ গজ দূরত্বে মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্য। মাঝখানে কাঁটাতারের বেড়া। দেখা গেছে, বেড়া ডিঙিয়ে টর্চের আলো-আঁধারি পরিবেশে মুখোশধারী কিছু লোক ওপারে চলে যাচ্ছেন গরু আনতে। কিছু লোক আবার গরুর পাল নিয়ে ঢুকছেন এপারে।
কথা বলে জানা গেল, তাঁরা সবাই ভাড়া খাটা লোক। অর্থাৎ টাকার বিনিময়ে গরু পার করে দেন। রাত ১০টার দিকে রেজুপাড়ায় আনা হয় শতাধিক গরু। গরুর আগে–পিছে ছিলেন সাত থেকে আটজন মুখোশধারী লোক।
স্থানীয় লোকজন জানান, ভোররাত পর্যন্ত নাইক্ষ্যংছড়ির ঘুমধুম, সদর ও দোছড়ি ইউনিয়নের অন্তত ৫১টি দুর্গম পয়েন্ট দিয়ে আনা হয় আরও কয়েক শ গরু।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, গরুর পাল বাংলাদেশের ভূখণ্ডে আনার পর দুর্গম সীমান্তের পাহাড়, জঙ্গল ও সামাজিক বনায়নের ভেতর জড়ো করা হয়। তারপর সময়–সুযোগ বুঝে ২০ থেকে ৫০টি গরুর পাল আনা হয় ঘুমধুম সীমান্তঘেঁষা চাকঢালা ও তুমব্রু টিভি টাওয়ার বাজারে। সেখান থেকে পাহাড়ি পথে গরু আনা হয় সাত কিলোমিটার দূরের কক্সবাজারের রামুর কচ্ছপিয়া ইউনিয়নের গর্জনিয়া বাজারে। গর্জনিয়া বাজার থেকেই চোরাই গরু ছড়িয়ে পড়ে রামুতে। সেখান থেকে গরুগুলো ট্রাকযোগে পৌঁছানো হয় জেলার বিভিন্ন কোরবানির পশুর হাটে। কিছু গরু সরবরাহ করা হয় চট্টগ্রামের সাতকানিয়া, লোহাগড়া, আনোয়ারা, বাঁশখালীসহ দেশের বিভিন্ন প্রান্তে।
অভিযোগ রয়েছে যে নাইক্ষ্যংছড়ি সদরের ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) চেয়ারম্যানসহ কয়েকজন জনপ্রতিনিধি ও রাজনৈতিক নেতা মূলত চোরাই গরু আনার ক্ষেত্রে মধ্যস্থতাকারী হিসেবে কাজ করেন।
চোরাই গরুর ব্যবসার সঙ্গে জড়িত থাকার অভিযোগ অস্বীকার করেছেন নাইক্ষ্যংছড়ি সদর ইউপির চেয়ারম্যান নুরুল আবছার। তাঁর দাবি, সীমান্ত দিয়ে গরু পাচার হলেও তিনি তাতে জড়িত নন। তাঁর বিরুদ্ধে অপপ্রচার ছড়াচ্ছে রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ।
নাইক্ষ্যংছড়ি উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ক্যানো ওয়ান চাকের দাবি, চোরাই গরুর কারবারে তাঁর দলের কেউ জড়িত কি না, সে বিষয়ে তিনি কিছু জানেন না। তবে রাতের আঁধারে গরু আনার বিষয়টি তিনি অনেকবার আইনশৃঙ্খলা কমিটির সভায় উত্থাপন করেছেন। পাচার বন্ধ হচ্ছে না। অন্যদিকে নাইক্ষ্যংছড়ি উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মো. জাকারিয়া প্রথম আলোকে বলেন, চোরাই গরুর বেচাবিক্রি বন্ধে তিনি বেশ কয়েকবার অভিযান চালিয়েছেন।
মাংসের সংকট নিরসন ও মিয়ানমার থেকে পশু আমদানির লক্ষ্যে ২০০২ সালে টেকনাফের শাহপরীর দ্বীপে একটি করিডর চালু করা হয়। করিডর দিয়ে গরু আমদানি হলে সরকার রাজস্ব পায় ৫০০ টাকা। পশু আমদানির কারণে দেশীয় খামারিরা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন, এমন অজুহাতে ২০২১ সালের ৭ জুলাই করিডর দিয়ে পশু আমদানি বন্ধ করা হয়। তবে মিয়ানমার থেকে চোরাই পথে পশু আসা বন্ধ হয়নি। টেকনাফের শুল্ক বিভাগের দেওয়া তথ্যমতে, করিডর চালুর ১৮ বছরে পশু আমদানির বিপরীতে সরকার ৩৬ কোটি ৮০ লাখ ৬৯ হাজার ৪০০ টাকা রাজস্ব আদায় করেছে। কিন্তু গত কয়েক বছরে এক টাকাও আয় হয়নি।
টেকনাফের ব্যবসায়ীরা বলেন, করিডর বন্ধের সুযোগ নিয়ে নাইক্ষ্যংছড়ি সীমান্ত দিয়ে গরু পাচার শুরু হয়। কোরবানির ঈদকে সামনে রেখে এখন দৈনিক দুই হাজারের বেশি গরু ঢুকছে। করিডর চালু থাকলে সরকার রাজস্ব পেত।
কক্সবাজার শহরসহ জেলার ৯টি উপজেলায় এবার কোরবানির পশু বিক্রির হাট বসেছে ৯৪টি। সব কটি হাটে চোরাই গরু বিক্রি হচ্ছে বলে জানা গেছে। কক্সবাজার সদরের খরুলিয়া, পিএমখালী, জুমছড়ি, রামুর কলঘর, মিঠাছড়ি ও টেকনাফের কয়েকটি বাজার সরেজমিন ঘুরে চোরাই গরু বিক্রি করতে দেখা গেছে। খরুলিয়া বাজারে গিয়ে দেখা যায় যে বিক্রির জন্য ৯ শতাধিক গরু আনা হয়েছে। এর মধ্যে মিয়ানমারের চোরাই গরু রয়েছে প্রায় ২০০টি।
এভাবে চোরাই গরু বিক্রি হওয়ার কারণে কক্সবাজারের খামারিরা বিপাকে পড়েছেন। বাংলাবাজার এলাকার খামারি সালাহ উদ্দিন প্রথম আলো বলেন, চোরাই গরুর কারণে তিনি দাম পাচ্ছেন না। বিক্রিও কমে গেছে।
জেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা মো. শাহাবুদ্দীন প্রথম আলোকে বলেন, জেলায় এবার কোরবানির পশুর চাহিদা ১ লাখ ৭৫ হাজার ১৪টি। দুই হাজারের বেশি খামার ও কৃষকের হাতে মজুত আছে ১ লাখ ৯৬ হাজার ৬৮৭ পশু। চোরাই গরুর কারণে স্থানীয় খামারিরা ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার বিষয়টি তিনি ঊর্ধ্বতন মহলকে জানিয়েছেন।