সুরুজ মিয়া (৪০) প্রতিদিন সকালে ৯ বছর বয়সী ছেলে রুবেলকে নিয়ে আসেন হাওরে। ছোট্ট যে নৌকা নিয়ে তাঁরা হাওরে সারা দিন কাটান, সেটি আসলে একটি ভাসমান দোকান। হাওরে আসা পর্যটকদের কাছে দিনভর এটা-সেটা বিক্রি করেন তাঁরা। এতে যে আয় হয়, তা দিয়েই চলে সংসার।
শুধু সুরুজ মিয়া একা নন, তাঁর মতো আরও অনেকে সুনামগঞ্জে টাঙ্গুয়ার হাওরে এভাবে বর্ষায় ছোট নৌকায় ভাসমান দোকান দিয়ে সংসার চালান। বড়দের পাশাপাশি অনেক শিশুরা নৌকায় এভাবে দোকান নিয়ে ঘোরে হাওরে। কারও নৌকা নিজের, আবার কেউ নৌকা ভাড়া করে আনেন। ছয় মাস এভাবে ভাসমান নৌকায় পর্যটকদের জন্য দোকান দেন তাঁরা। কেউ কেউ আবার পর্যটকদের কাছে লাইফ জ্যাকেট ভাড়া দেওয়ার কাজ করেন।
সুরুজ মিয়ার বাড়ি হাওরের জয়পুর গ্রামে। সম্প্রতি হাওরের পর্যবেক্ষণ টাওয়ার এলাকায় কথা হয় তাঁর সঙ্গে। সুরুজ মিয়া বলেন, বর্ষায় হাওরে মাছ ধরা আর শুকনা মৌসুমে কৃষিকাজ করেন তিনি। মা, স্ত্রী আর তিন ছেলেমেয়ে নিয়ে ছয়জনের সংসার। নিজের কোনো জমি নেই। অন্যের জমিতে শ্রমিকের কাজ করেন। এখন বর্ষায় হাওরে মাছও মেলে কম। তাই নৌকা নিয়ে অন্যদের মতো দোকান দিয়েছেন। সুরুজ বলেন, নৌকা ভাড়া এনেছেন, দিনে ১৫০ টাকা দিতে হয়। সারা দিনে সব বাদে ৫০০-৬০০ টাকা থাকে।
হাওরের গোলাবাড়ি গ্রামের সাব্বির আহমদের (১৫) নৌকায় ১০টি লাইফ জ্যাকেট। সেগুলো পর্যটকদের ভাড়া দেয় সে। ভাড়া কারও কাছ থেকে ২০ টাকা, কারও কাছ থেকে ৩০ টাকা নেয়। তাঁর আরেক ভাই নিজাম (১২) একইভাবে আরেকটি নৌকায় লাইফ জ্যাকেট নিয়ে ঘুরছে। সাব্বির বলছিল, তার মতো অনেকেই দোকান, কেউ লাইফ জ্যাকেট নিয়ে আসে প্রতিদিন। তাদের অনেকেই স্কুলে যায় না।
হাওরের পর্যবেক্ষণ টাওয়ারের কাছাকাছি গিয়ে দেখা যায়, সারি সারি হিজল ও করচগাছের পাশে পর্যটকবাহী বড় বড় নৌকাগুলো রাখা। পর্যটকদের কেউ কেউ স্বচ্ছ জলে নেমে জলকেলি করছেন, কেউ সাঁতার কাটছেন। কেউবা নৌকায় বসে শুনছেন গান। এর মধ্যে পর্যটকদের কাছে ছুটে যাচ্ছে আরও কিছু ছোট ছোট নৌকা। এসব ছোট ছোট নৌকাই একেকটি ‘দোকান’। চা, বিস্কুট, বোতলজাত পানি, চিপস, পান-সিগারেট, কলা, বাদামসহ নানা পণ্য আছে এসব দোকানে।
হাওরের জয়পুর গ্রামের বাসিন্দা সিরাজুল ইসলাম (৩৫) চার বছর ধরে এখানে নৌকায় দোকান নিয়ে ঘোরেন। বর্ষা মৌসুমেই মূলত এ দোকান দেন তিনি। এর আগে হাওরে থাকা কিছু জমিতে বোরো ধান লাগান। হাওরের জমিতে যে ধান পান, তাতে সংসার চলে না। নৌকায় দোকান দেওয়ার আগে দিনমজুরি করতেন। এখন এই দোকানের আয়েই সংসার চলে। সিরাজুল ইসলাম জানান, হাওরের জয়পুর, গোলাবাড়ি, নতুনপাড়া, ছিলান তাহিরপুরসহ কয়েকটি গ্রামের লোকজন বর্ষায় এখানে দোকান দেন। প্রতিদিনই দোকান নিয়ে এলেও মূলত বেচাবিক্রি বেশি হয় ছুটির দিনে। শুক্র ও শনিবার হাওরে পর্যটক থাকেন বেশি। এই দুই দিন বিক্রিও হয় বেশি। এমনিতে ৫০০ থেকে ৭০০ টাকা আয় হয়। শুক্র ও শনিবার বিক্রি হয় অন্যদিনের চেয়ে দ্বিগুণ।
নৌকার দোকানিরা বলেন, টাঙ্গুয়ার হাওরে জুন থেকে নভেম্বর—এই ছয় মাসেই পর্যটক বেশি আসেন। তখন হাওরে পানি থাকে বেশি। শুকনা মৌসুমে পর্যটক আসেন কম। এ কারণে বর্ষাতেই দোকান দেন তাঁরা।
সুনামগঞ্জের তাহিরপুর উপজেলায় টাঙ্গুয়ার হাওরের অবস্থান। জেলা শহর থেকে এর দূরত্ব ৪০ কিলোমিটার। টাঙ্গুয়ার হাওর বিশ্ব ঐতিহ্যের অংশ। হাওরের উত্তরেই ভারতের মেঘালয় পাহাড়। এখানে এলে পর্যটকেরা একসঙ্গে হাওর ও পাহাড়ের সৌন্দর্য উপভোগ করতে পারেন। অনেকেই নৌকায় রাত যাপন করেন হাওরে। এটি পর্যটকদের বাড়তি আনন্দ দেয়।
তাহিরপুর উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান করুণা সিন্ধু চৌধুরী বলেন, টাঙ্গুয়ার হাওর দিন দিন পর্যটকদের কাছে প্রিয় স্থান হয়ে উঠেছে। প্রতিদিন এখানে পর্যটক আসেন। এতে স্থানীয় লোকজনও নানাভাবে উপকৃত হচ্ছেন। প্রকৃতি-পরিবেশ রক্ষা করে এখানে হাওরবান্ধব পর্যটন বিকশিত হওয়ার পক্ষে তিনি।