গ্রেপ্তার বিএনপি নেতা-কর্মীদের ১০ ভাগের ৯ ভাগই জামিনে মুক্ত। আবারও গ্রেপ্তারের শঙ্কার কথা বলছেন তাঁরা।
ঢাকায় বিএনপির গত ২৮ অক্টোবরের মহাসমাবেশ ঘিরে সংঘর্ষের পর থেকে খুলনা বিভাগের বিভিন্ন থানায় দলের নেতা-কর্মীদের বিরুদ্ধে অন্তত ১৫৫টি মামলার তথ্য পাওয়া গেছে। এসব মামলায় গ্রেপ্তার হন পৌনে তিন হাজারের বেশি নেতা-কর্মী। তাঁদের বেশির ভাগ জামিন পেলেও এখনো প্রায় ২০০ নেতা-কর্মী কারাবন্দী।
বিএনপি নেতাদের অভিযোগ, পুলিশ পরিকল্পিতভাবে একের পর এক ‘গায়েবি মামলা’ দিয়ে বিএনপির নেতা-কর্মীদের ঘরছাড়া করেছিল। এখন উচ্চ আদালত থেকে আগাম জামিনের পরও নেতা-কর্মীদের গ্রেপ্তার করছে পুলিশ। এর ফলে অনেকের মধ্যে আবারও গ্রেপ্তারের আতঙ্ক কাজ করছে।
খুলনা বিভাগের ১০টি জেলা। জেলা পর্যায়ের শীর্ষ নেতা ও বিএনপিপন্থী আইনজীবীদের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, ২৮ অক্টোবরের পর থেকে জানুয়ারি পর্যন্ত বিভাগে ১৫৫টি মামলা হয়েছে। সবচেয়ে বেশি মামলা হয়েছে খুলনার ৯টি উপজেলায়, ২৮টি। খুলনা নগরের ৮টি থানায় মামলা হয়েছে আরও ১১টি। এ ছাড়া বাগেরহাটে ২২টি, কুষ্টিয়ায় ২১টি, যশোরে ১৬টি, ঝিনাইদহে ১৩টি, সাতক্ষীরায় ১১টি, চুয়াডাঙ্গায় ১১টি, মেহেরপুরে ৯টি, মাগুরায় ৯টি ও নড়াইলে ৪টি মামলা হয়েছে। কেন্দ্র থেকে শুরু করে ওয়ার্ড পর্যায় পর্যন্ত নেতা-কর্মীরা এসব মামলার আসামি।
বিএনপিপন্থী আইনজীবীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, এসব মামলার বেশির ভাগই হয়েছে জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে। জাতীয় নির্বাচনের পরও বিভাগের কয়েকটি থানায় বিএনপি নেতা-কর্মীদের নামে মামলা হয়েছে। প্রায় সবগুলো মামলার বাদী পুলিশ। এসব মামলায় বেশির ভাগ ক্ষেত্রে যানবাহনে অগ্নিসংযোগ, পুলিশের কাজে বাধা দেওয়া, হামলা, ককটেলের বিস্ফোরণ ঘটিয়ে জনমনে আতঙ্ক সৃষ্টি করা, আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি ঘটানোসহ সরকারের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন ও অন্তর্ঘাতমূলক কর্মকাণ্ডের অভিযোগ আনা হয়েছে। বিএনপি নেতাদের অভিযোগ, বিএনপিকে কোণঠাসা করতে এসব কাল্পনিক মামলা করা হয়েছে।
বিএনপির দলীয় সূত্রগুলো বলছে, এসব মামলায় গ্রেপ্তার হন অন্তত ২ হাজার ৭৫৪ জন। খুলনা নগর ও জেলা মিলে ৯৭০ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়। ১০ জেলায় হওয়া এসব মামলায় ২ হাজার ৫৬৯ জনের মতো নেতা-কর্মী জামিন পেয়েছেন। বেশির ভাগই উচ্চ আদালত থেকে আগাম জামিন নিয়েছেন। এখনো কারাগারে আছেন ১৮৫ জন।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, বিএনপি এবং এর অঙ্গ ও সহযোগী সংগঠনের জেলা ও উপজেলা পর্যায়ের শীর্ষ নেতাদের প্রায় সবাই এখন জামিনে আছেন।
খুলনা জেলা বিএনপির আহ্বায়ক আমীর এজাজ খান গত ১১ ফেব্রুয়ারি মুক্তি পেয়েছেন। কুষ্টিয়া বিএনপির সভাপতি সৈয়দ মেহেদী আহমেদ রুমী ও সাধারণ সম্পাদক সোহরাব উদ্দীন গত ৯ ফেব্রুয়ারি, নড়াইল জেলা বিএনপি সাধারণ সম্পাদক ও সদর উপজেলার সাবেক চেয়ারম্যান মো. মনিরুল ইসলাম এবং জেলা স্বেচ্ছাসেবক দলের সদস্যসচিব মঞ্জুরুল সাঈদ গত ১৩ ফেব্রুয়ারি কারামুক্ত হয়েছেন। খুলনার দৌলতপুর থানা বিএনপির সদস্যসচিব ২৫ ফেব্রুয়ারি জামিনে মুক্তি পেয়েছেন।
২৮ অক্টোবরের পর থেকে আত্মগোপনে ছিলেন খুলনা নগর বিএনপির আহ্বায়ক শফিকুল আলম (মনা) ও সদস্যসচিব শফিকুল আলম (তুহিন)। প্রায় সাড়ে তিন মাস পর উচ্চ আদালত থেকে জামিন পেয়ে গত ৭ ফেব্রুয়ারি খুলনার দলীয় কার্যালয়ে সংবাদ সম্মেলন করেন তাঁরা। সেখানে তাঁরা বলেন, উচ্চ আদালত থেকে আগাম জামিনের পরও নগরের দৌলতপুর থানা বিএনপির সদস্যসচিব শেখ ইমাম হোসেনকে ৫ ফেব্রুয়ারি গ্রেপ্তার করে পুলিশ। নগরের খানজাহান আলী থানা ছাত্রদলের আহ্বায়ক মাসুম বিল্লাহ একটি মামলায় কারাগার থেকে জামিনে বের হওয়ার পর অন্য একটি মামলায় আবারও কারাগারে পাঠানো হয়েছে।
খুলনা নগরের খানজাহান আলী থানা যুবদলের সক্রিয় কর্মী মেহেদী হাসান। বিশেষ ক্ষমতা আইনের এক মামলায় গত ২২ জানুয়ারি উচ্চ আদালত থেকে জামিন পেয়েছেন তিনি। গত রোববার দুপুরে খুলনা আদালত চত্বরে দাঁড়িয়ে মেহেদী হাসান বলেন, গত ১৮ নভেম্বর তাঁকে নগরের ফুলবাড়ি গেট এলাকা থেকে পুলিশ ধরে নিয়ে যায়। পরে নাশকতার মামলায় কারাগারে পাঠানো হয়। এরপর নিম্ন আদালত জামিন নামঞ্জুর করেন। ৬৬ দিন কারাভোগের পর উচ্চ আদালতের জামিনে মুক্ত হয়েছেন।
মেহেদী হাসান পেশায় ইলেকট্রনিক যন্ত্রাংশের ডিলার। তবে গত প্রায় তিন মাস দোকান খুলতে পারেন না। মেহেদী বলেন, ‘ব্যবসা-বাণিজ্য সব বন্ধ, জেলে কাটাব, না দোকান খুলব। আর্থিকভাবে ক্ষতির মধ্যে পড়েছি। পরিবারও সব সময় উদ্বিগ্ন থাকে।’ ‘কাল্পনিক মামলায়’ জেল খেটেছেন দাবি করে মেহেদী বলেন, ‘বিএনপি করি, এটাই আমাদের অপরাধ। আমাদের মামলার এজাহারে নাম থাকা ১৭ জনের কেউই ওই ঘটনার সঙ্গে জড়িত ছিলাম না।’
খুলনা নগর বিএনপির সদস্যসচিব শফিকুল প্রথম আলোকে বলেন, গত কয়েক মাসে অভিযানের নামে বাড়ি ভাঙচুর, পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে দুর্ব্যবহার, বৃদ্ধ ও শিশুদের নাজেহাল করা, ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ করে দেওয়া, নেতাকে না পেয়ে স্বজনকে ধরে নিয়ে যাওয়া—সবই করেছে পুলিশ। এখন জামিনে থাকার পরও পুলিশ নেতা-কর্মীদের গ্রেপ্তার করছে। এতে জামিনে থাকা নেতা-কর্মীদের মধ্যেও গ্রেপ্তার আতঙ্ক বিরাজ করছে।
গ্রেপ্তারের পর জামিন পেতে এবং মামলা পরিচালনার জন্য বিএনপির পক্ষ থেকে সহায়তা দেওয়া হয় বলে দাবি করেছেন দলটির নেতারা। এই সহায়তা নিয়ে তৃণমূলের কর্মীদের মধ্যে মিশ্র প্রতিক্রিয়া আছে। খুলনা আদালতে হাজিরা দিতে আসা বিএনপির এক কর্মী প্রথম আলোকে বলেন, ‘১৫ বছর রাষ্ট্রক্ষমতার বাইরে থেকে দল যে সহায়তা করছে, তা যথেষ্ট।’
কয়রা উপজেলা বিএনপির অন্য এক কর্মী নিজের অভিজ্ঞতা থেকে প্রথম আলোকে বলেন, ‘দল মূলত সহায়তা করে জামিনের সময়, সেটাও ধীরগতিতে। গ্রেপ্তারের পর ওকালতনামাসহ প্রাথমিক পর্যায়ের আনুষঙ্গিক অন্যান্য খরচ পরিবারকেই বহন করতে হয়। পরিবারকে সহায়তার নামে যেটা দেওয়া হয়, সেটা বলার মতো কিছু নয়।’