ভবদহ অঞ্চলে ভারী বৃষ্টিতে তলিয়ে গেছে গ্রামের পর গ্রাম

বাড়িঘরে পানি, উঠানে তৈরি করা হয়েছে বাঁশের সাঁকো। টিউবওয়েল ডুবে যাওয়ায় পানীয় জলের সমস্যা দেখা দিয়েছে। সোমবার যশোরের অভয়নগরের ডুমুরতলা গ্রামে
ছবি: প্রথম আলো

যশোরের ভবদহের বিস্তীর্ণ এলাকা বৃষ্টির পানিতে তলিয়ে গেছে। নদী দিয়ে পানি নিষ্কাশিত না হওয়ায় দেখা দিয়েছে জলাবদ্ধতা। গত শুক্রবার সন্ধ্যা থেকে আজ সোমবার সকাল পর্যন্ত ভারী বৃষ্টিতে অভয়নগর ও মনিরামপুর উপজেলার ৪০টির বেশি গ্রামে পানি ঢুকে পড়েছে। এসব গ্রামের বেশির ভাগ ঘরবাড়ি, ধর্মীয় ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, রাস্তাঘাট এবং মাছের ঘের প্লাবিত হয়েছে। দুর্ভোগে পড়েছেন পানিবন্দী মানুষ।

যশোরের অভয়নগর, মনিরামপুর ও কেশবপুর এবং খুলনার ডুমুরিয়া ও ফুলতলা উপজেলার অংশবিশেষ নিয়ে ভবদহ অঞ্চল। এই এলাকার পানি ওঠানামা করে মুক্তেশ্বরী, টেকা, শ্রী ও হরি নদ-নদী দিয়ে। পলি পড়ে নদীগুলো নাব্যতা হারিয়েছে। ফলে এসব নদী দিয়ে এখন ঠিকমতো পানি নিষ্কাশিত হচ্ছে না। এ কারণে পানি আটকা পড়ে জলাবদ্ধতার সৃষ্টি হয়েছে।

আবহাওয়া অধিদপ্তরের তথ্যমতে, বৃষ্টি ১ থেকে ১০ মিলিমিটার হলে সেটিকে হালকা বৃষ্টি বলা হয়। ১১ থেকে ২২ মিলিমিটারের মধ্যে বৃষ্টি হলে তা মাঝারি ধরনের বৃষ্টি। মাঝারি ধরনের ভারী বৃষ্টি বলা হয় ২৩ থেকে ৪৩ মিলিমিটার হলে। আর ৪৪ থেকে ৮৮ মিলিমিটারের বৃষ্টি হচ্ছে ভারী বৃষ্টি। যদি ৮৮ মিলিমিটারের চেয়ে বেশি বৃষ্টি হয়, তবে তা অতি ভারী বৃষ্টি হিসেবে ধরা হয়।

বাড়িঘরে পানি উঠেছে। ঘর থেকে বের হওয়ার হওয়ার জন্য তৈরি করা হয়েছে বাঁশের সাঁকো। সোমবার দুপুরে যশোরের অভয়নগর উপজেলার ডুমুরতলা গ্রামে

যশোরের বীরশ্রেষ্ঠ মতিউর রহমান বিমানঘাঁটির আবহাওয়া পর্যবেক্ষণাগার সূত্র জানায়, সেপ্টেম্বর মাসে স্বাভাবিক গড় বৃষ্টি ধরা হয় ২৫৪ মিলিমিটার। গত ১৩ সেপ্টেম্বর সন্ধ্যা ছয়টা থেকে আজ ১৬ সেপ্টেম্বর বেলা তিনটা পর্যন্ত জেলায় ২৭৩ মিলিমিটার বৃষ্টি রেকর্ড করা হয়েছে। এর মধ্যে গতকাল রোববার সর্বাধিক ১০৯ মিলিমিটার বৃষ্টি রেকর্ড করা হয়। শুক্রবার সন্ধ্যা থেকে ভারী বৃষ্টি শুরু হয়। তা অব্যাহত ছিল আজ সোমবার সকাল পর্যন্ত। কখনো মাঝারি আবার কখনো হালকা বর্ষণ অব্যাহত রয়েছে। ফলে ভবদহ অঞ্চলের ৫২টি বিল প্লাবিত হয়েছে। বিল উপচে পানি ঢুকে পড়েছে আশপাশের গ্রামগুলোতে।

অভয়নগর উপজেলার ডুমুরতলা গ্রামের ভানু মণ্ডল বলেন, ‘ঘরের মধ্যে জল ঢুকে পড়েছে। বৃষ্টির সঙ্গে ওপরের দিকের জল চাপ দেওয়ায় জল বেড়েই চলেছে। উঠোনে বাঁশের সাঁকো তৈরি করেছি। ঘর থেকে সাঁকো দিয়ে বের হচ্ছি। জল আর একটু বাড়লে বাড়িঘর ছেড়ে রাস্তায় উঠতে হবে। টিউবওয়েল ডুবে যাওয়ায় পানীয় জলের সমস্যা দেখা দিয়েছে।’

একই গ্রামের শিবপদ বিশ্বাস বলেন, ‘আমার বাড়ির উঠোনে হাঁটুজল। প্রতিদিন জল বাড়ছে। গ্রামের ১৫৫টি বাড়ির মধ্যে দুই-তিনটি ছাড়া সব বাড়ির উঠানে এক থেকে তিন ফুট জল উঠেছে। কয়েকটি বাড়ির ঘরে জল উঠেছে। আর একটু বৃষ্টি হলে বাড়িঘর ছাড়তে হবে।’

মনিরামপুর উপজেলার হাটগাছা গ্রামের মিন্টু বৈরাগী বলেন, ‘খুব খারাপ অবস্থায় আছি। আমার গোয়ালঘর, বাথরুম, টিউবওয়েল জলে তলিয়ে গেছে। উঠানে হাঁটুর বেশি জল। ঘরের বারান্দায় জল উঠেছে। ঘরে জল উঠলে রাস্তায় ওঠা ছাড়া উপায় থাকবে না।’

যশোরের ভবদহের বিস্তীর্ণ এলাকা বৃষ্টির পানিতে তলিয়ে গেছে। জলাবদ্ধ যশোরের মনিরামপুর উপজেলার হাটগাছা নিম্ন মাধ্যমিক বিদ্যালয়। সোমবার দুপুরে

ভবদহ পানিনিষ্কাশন সংগ্রাম কমিটির আহ্বায়ক রণজিৎ বাওয়ালির বাড়ির উঠানে হাঁটুপানি। পানি ছুঁই ছুঁই করছে তাঁর ঘরের বারান্দায়। তিনি বলেন, ‘বৃষ্টির জল জমে ভবদহ এলাকা ডুবতে শুরু করেছে। এলাকার ৪০টির বেশি গ্রামে জলাবদ্ধতা দেখা দিয়েছে। প্রতিদিন নতুন নতুন এলাকা প্লাবিত হচ্ছে। অনেকের বাড়িতে জল। আবার কারও কারও ঘরের মধ্যে জল প্রবেশ করেছে। এলাকার বিলে টাইডাল রিভার ম্যানেজমেন্ট (টিআরএম) বা জোয়ারাধার চালু না করলে জলাবদ্ধতা থেকে মুক্তি নেই। টিআরএমের দাবিতে আমরা ৮ সেপ্টেম্বর যশোরের জেলা প্রশাসকেরা (ডিসি) মাধ্যমে পানিসম্পদ উপদেষ্টার কাছে স্মারকলিপি দিয়েছি। দ্রুত মিটিং করে পানিনিষ্কাশন ও জলাবদ্ধতা দূরীকরণে বিল কপালিয়ায় টিআরএম বাস্তবায়নের জন্য আন্দোলন শুরু করা হবে।’

পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো) সূত্র বলছে, ভবদহ অঞ্চলের জলাবদ্ধতা নিরসনে আপাতব্যবস্থা হিসেবে ভবদহ স্লুইসগেটের ওপর বৈদ্যুতিক সেচযন্ত্র দিয়ে পানি সরানোর কাজ চলছে। এ ছাড়া হরি নদে মাটি কাটার কাজ চলছে।

পাউবোর যশোরের কার্যালয়ের নির্বাহী প্রকৌশলী পলাশ কুমার ব্যানার্জি বলেন, এবার প্রবল বৃষ্টি। বর্তমানে হরি নদের ২ দশমিক ১ কিলোমিটার মাটি কাটার কাজ চলছে। ভবদহ স্লুইসগেটের ২১ ভেন্টের ওপর চারটি বড় ও পাঁচটি ছোট পাম্প সব সময় চলছে। বৃষ্টি থেমে গেলে এবং যশোর শহরের পানি না ঢুকলে চার থেকে পাঁচ দিনের মধ্যে পাম্প দিয়ে এলাকার পানি সরিয়ে ফেলা যাবে।