সুপেয় পানির জন্য অপেক্ষার সারি দীর্ঘ হচ্ছে নগরে। সম্প্রতি চট্টগ্রাম নগরের টেরিবাজার এলাকায়
সুপেয় পানির জন্য অপেক্ষার সারি দীর্ঘ হচ্ছে নগরে। সম্প্রতি চট্টগ্রাম নগরের টেরিবাজার এলাকায়

চট্টগ্রাম ওয়াসা

পানি লবণাক্ত, বাড়ছে ঝুঁকি

পানিতে অতিরিক্ত লবণের কারণে উচ্চ রক্তচাপ তৈরি হতে পারে। পাশাপাশি কিডনি ও চোখ ক্ষতিগ্রস্ত হয়।

হালদা ও কর্ণফুলী নদী থেকে পানি নিয়ে পরিশোধনের মাধ্যমে নগরে সরবরাহ করে চট্টগ্রাম ওয়াসা। সমুদ্রের পানি নদীতে ঢুকে পড়ায় ওয়াসার পানিতে লবণের মাত্রা বেড়ে গেছে। কমেছে উৎপাদনও। এতে বিভিন্ন এলাকায় দিনের পর দিন পানি আসছে না। আবার যেটুকু আসছে, লবণাক্ততার কারণে সেটুকুও মুখে তোলার জো নেই। 

নগরের সরাইপাড়ার বাঁচা মিয়া সড়কের বাসিন্দা মোহাম্মদ জাহেদুল আলম রোজার শুরু থেকেই ঠিকমতো পানি পাচ্ছিলেন না। এ নিয়ে তিনি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে স্ট্যাটাস দিয়েছেন। তিনি লিখেছেন, পানি না পাওয়ায় রোজার দিনে মানুষের কষ্ট আরও দ্বিগুণ হয়েছে। জানতে চাইলে জাহেদুল প্রথম আলোকে বলেন, মাঝেমধ্যে পানি পাওয়া গেলেও তা ছিল লবণাক্ত। সেদ্ধ করেও লবণ যাচ্ছে না। এ কারণে কেনা পানি ব্যবহার করতে হচ্ছে। 

লবণাক্ত পানি নিয়ে গ্রাহক ও ওয়াসা কর্তৃপক্ষ; দুই পক্ষই দীর্ঘদিন ধরে ধুঁকছে। সংস্থাটি দৈনিক ৫০ কোটি লিটার পানি উৎপাদন করে। গত বছর ফেব্রুয়ারি থেকে এপ্রিল পর্যন্ত লবণাক্ততার কারণে উৎপাদন নেমে এসেছিল ২৫ কোটিতে। পানির সংকট সমাধানে মানববন্ধনও করেছিল চট্টগ্রাম নাগরিক ফোরাম নামের একটি সংগঠন। এ বছর ১০ মার্চ থেকে পানির সংকট শুরু হয়। বর্তমানে দৈনিক উৎপাদন হচ্ছে ৪১ থেকে ৪২ কোটি লিটার পানি। 

সংশ্লিষ্ট  ব্যক্তিদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, কাপ্তাই হ্রদ থেকে পানি এসে কর্ণফুলী ও হালদা নদীতে পড়ে। স্বাভাবিক অবস্থায় হ্রদে পানির স্তর ১০৯ ফুট পর্যন্ত থাকে। বর্তমানে স্তরটি ৮১ ফুট। মূলত গ্রীষ্মের শুরুতেই হ্রদের বিভিন্ন জায়গায় পানি কমে যায়। এতে নদীকেন্দ্রিক যোগাযোগ, ব্যবসা-বাণিজ্য, মৎস্য উৎপাদন ও পর্যটনে ক্ষতির পাশাপাশি জলবিদ্যুৎ প্রকল্পের উৎপাদন যেমন কমে, ঠিক তেমনি ওয়াসার পানির সংকট তৈরি হয়। 

বর্তমানে ওয়াসার আবাসিক গ্রাহক সংযোগ ৭৮ হাজার ৫৪২টি ও বাণিজ্যিক সংযোগ ৭ হাজার ৭৬৭টি। নগরের প্রায় ১ হাজার ২০০ কিলোমিটার পাইপলাইনের মাধ্যমে পানি সরবরাহ করা হয়। লবণাক্ততার জন্য হালিশহর, উত্তর ও দক্ষিণ পতেঙ্গা, কাটগড়, বাকলিয়া, কর্নেলহাট, আকবর শাহ, পাহাড়তলীসহ একাধিক এলাকায় সংকট তৈরি হয়েছে। 

এসব এলাকার গ্রাহকেরা বলছেন, লবণের কারণে পানি পান করা যাচ্ছে না। গোসল করলেও চুলকানি হচ্ছে। প্রায় প্রতিবছরই লবণাক্ততার জন্য সীমাহীন ভোগান্তি পোহাতে হয়। কিন্তু কর্তৃপক্ষ স্থায়ী সমাধানের পথে হাঁটছে না। 

সংকটের বিষয়ে ওয়াসার ব্যবস্থাপনা পরিচালক এ কে এম ফজলুল্লাহ প্রথম আলোকে বলেন, জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে বৃষ্টি কম হচ্ছে। পলি জমে কাপ্তাই হ্রদ ভরাট হচ্ছে। হ্রদ বাঁচানো গেলে এই সংকট থাকবে না। 

বাড়ছে ঝুঁকি

লবণাক্ত পানি পান ও ব্যবহারের মাধ্যমে নানা ধরনের শারীরিক জটিলতা তৈরি হতে পারে বলে মনে করছেন চিকিৎসকেরা। জনস্বাস্থ্য রক্ষা অধিকার কমিটির সদস্যসচিব সুশান্ত বড়ুয়া প্রথম আলোকে বলেন, পানিতে অতিরিক্ত লবণের কারণে উচ্চ রক্তচাপ তৈরি হতে পারে। পাশাপাশি কিডনি ও চোখ ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এ ছাড়া শরীরে দীর্ঘমেয়াদি প্রভাব থেকে যায়। 

চট্টগ্রাম জেলা সিভিল সার্জন মো. ইলিয়াছ চৌধুরী প্রথম আলোকে বলেন, খাওয়ার পানিতে সর্বোচ্চ ১৪৫ মিলিগ্রাম সোডিয়াম বা লবণ থাকতে পারে। দীর্ঘদিন ধরে এর বেশি পরিমাণে সোডিয়ামযুক্ত পানি পান ও ব্যবহার করলে শরীরে নানা ধরনের সমস্যা তৈরি হবে। বিশেষ করে উচ্চ রক্তচাপের রোগীরা বেকায়দায় পড়বেন। 

ওয়াসার প্রধান প্রকৌশলী মাকসুদ আলম জানান, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার নির্দেশনা হলো, এক লিটার পানিতে সর্বোচ্চ ২৫০ মিলিগ্রাম লবণ থাকতে পারে। কিন্তু সমুদ্রের পানি ঢুকে পড়ার কারণে লবণের পরিমাণ কয়েক গুণ বেড়ে গেছে। 

সুপেয় পানির জন্য অপেক্ষার সারি দীর্ঘ হচ্ছে নগরে। সম্প্রতি চট্টগ্রাম নগরের টেরিবাজার এলাকায়

তিন হাজার কোটির প্রকল্প

ওয়াসা বর্তমানে চারটি শোধনাগারের মাধ্যমে পানি উৎপাদন করে। এর মধ্যে রাঙ্গুনিয়ায় আছে শেখ হাসিনা পানি শোধনাগার-১ ও ২। এই দুটি থেকে ২৮ কোটি লিটার পানি আসে। মোহরা পানি শোধনাগার থেকে আসে ৯ কোটি লিটার। আর মদুনাঘাট এলাকায় অবস্থিত শেখ রাসেল পানি শোধনাগার থেকে আসে আরও ৯ কোটি লিটার। কাপ্তাই হ্রদে পানি কমে যাওয়া ও সমুদ্রের জোয়ারের পানি কর্ণফুলী নদীতে ঢুকে পড়ার কারণে মোহরা ও শেখ রাসেল পানি শোধনাগারের প্ল্যান্ট বন্ধ রাখতে হচ্ছে দৈনিক চার থেকে পাঁচ ঘণ্টা। 

ওয়াসার নথিপত্র অনুযায়ী, লবণাক্ততার সমস্যা সমাধানে গত বছরের শেষ দিকে নতুন একটি প্রকল্পের প্রস্তাবনা স্থানীয় সরকার বিভাগে পাঠানো হয়। এই প্রকল্পের আওতায় রাঙ্গুনিয়ায় পানি সংগ্রহের স্টেশন তৈরি করা হবে। ২০ কিলোমিটার পাইপলাইন বসানো হবে। 

পাশাপাশি আরও একটি পানি শোধনাগার নির্মাণ করা হবে। এই শোধনাগারে ২০ কোটি লিটার পানি শোধনের সক্ষমতা থাকবে।  ওয়াসার প্রধান প্রকৌশলী মাকসুদ আলম প্রথম আলোকে বলেন, নতুন প্রকল্পের ব্যয় প্রাথমিকভাবে ৩ হাজার কোটি টাকা ধরা হয়েছে। এখন দাতা সংস্থা খোঁজা হচ্ছে। প্রকল্প বাস্তবায়ন করা গেলে লবণাক্ততার সমস্যা সমাধান হয়ে যাবে। 

তবে লবণাক্ততার সমস্যা দ্রুত সমাধান করা সম্ভব বলে মনে করেন চট্টগ্রাম প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের ওয়াটার রিসোর্স ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের প্রধান জি এম সাদিকুল ইসলাম। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, এখন প্রকল্প বাস্তবায়নের পাশাপাশি জোয়ার পানি আটকে দেওয়ার জন্য রেগুলেটর নির্মাণ করা প্রয়োজন।