তথ্য অধিকার আইন

মানিকগঞ্জে তথ্য দিতে গড়িমসি, কালক্ষেপণ 

আইনে ২০ কার্যদিবসের মধ্যে তথ্য দেওয়ার বিধান রয়েছে। অথচ মানিকগঞ্জে সরকারি দপ্তরগুলো অধিকাংশে ক্ষেত্রে তথ্য দেয় না।

মানিকগঞ্জের সরকারি দপ্তরগুলোতে তথ্য অধিকার আইনে আবেদন করেও প্রয়োজনীয় তথ্য পাওয়া যাচ্ছে না। তথ্যের জন্য আবেদন করার পর নানা অজুহাতে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা তা দেন না। অনেক সময় আশ্বাসের নামে দিনের পর দিন কালক্ষেপণ করা হয়। 

মানিকগঞ্জের হরিরামপুর উপজেলায় স্থানীয় সংসদ সদস্যের অনুকূলে বরাদ্দ দেওয়া গ্রামীণ অবকাঠামো রক্ষণাবেক্ষণ (টিআর) কর্মসূচির বিভিন্ন প্রকল্পের তথ্য চেয়ে এ প্রতিবেদক গত ১৮ সেপ্টেম্বর উপজেলা প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তার (পিআইও) কার্যালয়ের দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তার কাছে আবেদন করেন। তবে দুই মাস পেরিয়ে গেলেও তথ্য সরবরাহ করা হয়নি। একইভাবে জেলার আরও তিনটি সরকারি দপ্তরে তথ্য অধিকার আইন অনুযায়ী তথ্য চেয়ে লিখিত আবেদন করা হয়েছিল। কিন্তু নির্দিষ্ট সময় পেরিয়ে গেলেও সেসব দপ্তর থেকে তথ্য সরবরাহ করা হয়নি।

আবেদন করে তথ্য না পেলে আপিল কর্তৃপক্ষের কাছে আপিল করতে হবে। সেখানেও তথ্য না পেলে তথ্য কমিশনে লিখিত অভিযোগ করতে হবে। 
সুরাইয়া বেগম, তথ্য কমিশনার

বাংলাদেশে ২০০৯ সালে তথ্য অধিকার আইন কার্যকর হয়। এই আইন অনুযায়ী অনুরোধের পরিপ্রেক্ষিতে দেশের যেকোনো নাগরিককে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ তথ্য দিতে বাধ্য থাকবে। এই আইন পাস হওয়ার ১৩ বছর পরও মানিকগঞ্জে যথাযথভাবে তা মানা হচ্ছে না। এই আইনের ৮ এর উপধারা (১) এর অধীন অনুরোধ পাওয়ার তারিখ থেকে অনধিক ২০ কার্যদিবসের মধ্যে তথ্য সরবরাহ করবেন। তবে মানিকগঞ্জের সরকারি বিভিন্ন দপ্তরে আবেদন করে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই তথ্য পাওয়া যাচ্ছে না। 

এ বিষয়ে জেলা প্রশাসক মুহাম্মদ আবদুল লতিফ প্রথম আলোকে বলেন, প্রকাশযোগ্য তথ্য হলে ২০ কার্যদিবসের মধ্যেই যেকোনো নাগরিককে তথ্য দেওয়ার বিধান রয়েছে। অন্যথায় আপিল কর্তৃপক্ষের কাছে আপিল করারও বিধান রয়েছে। দুই পক্ষের মধ্যে শুনানি শেষে আপিল কর্তৃপক্ষ কাঙ্ক্ষিত তথ্য দিতে বাধ্য থাকবেন।

 এ বিষয়ে তথ্য কমিশনার সুরাইয়া বেগম মুঠোফোনে প্রথম আলোকে বলেন, আবেদন করে তথ্য না পেলে আপিল কর্তৃপক্ষের কাছে আপিল করতে হবে। সেখানেও তথ্য না পেলে তথ্য কমিশনে লিখিত অভিযোগ করতে হবে।

প্রতিবেদন তৈরির জন্য প্রথম আলোর এ প্রতিবেদক গত মার্চ মাস থেকে সেপ্টেম্বর মাস পর্যন্ত সরকারি বিভিন্ন দপ্তরে তথ্য চেয়ে পাঁচটি আবেদন করেন। এর মধ্যে নির্দিষ্ট সময়ে একটি আবেদনের বিপরীতে তথ্য পাওয়া গেছে। বাকি চারটি আবেদনের কোনো তথ্য সরবরাহ করা হয়নি। তথ্য চেয়ে আবেদন করা হয়েছে, এমন দপ্তরের এক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, অনিয়ম ও দুর্নীতির তথ্য ফাঁস হওয়ার ভয়ে দপ্তরের প্রধানেরা তথ্য দিতে গড়িমসি করে থাকেন।

হরিরামপুর উপজেলায় ২০১৮-১৯ থেকে ২০২১-২২ পর্যন্ত চার অর্থবছরে কাবিখা, কাবিটা ও টিআর প্রকল্পের আওতায় স্থানীয় সংসদ সদস্য মমতাজ বেগমের অনুকূলে বরাদ্দের পরিমাণ, সব প্রকল্পের নাম, প্রকল্পভিত্তিক বরাদ্দের পরিমাণ ও  প্রকল্প এলাকার ঠিকানা চেয়ে গত ১৮ সেপ্টেম্বর তথ্য অধিকার আইনে পিআইও মো. মানিকুজ্জামানের কাছে আবেদন করা হয়েছিল। তবে নির্ধারিত সময়ের পর এক মাস পেরিয়ে গেলেও এ তথ্য পাওয়া যায়নি। দপ্তরে গিয়েও তাঁকে পাওয়া যায় না। মুঠোফোনে কল করা হলে তথ্য দেওয়ার আশ্বাস দিয়ে কালক্ষেপণ করেন এই কর্মকর্তা।

সিঙ্গাইর উপজেলায় স্থানীয় সংসদ সদস্যের অনুকূলে টিআর প্রকল্পের বরাদ্দ ও বরাদ্দের পরিমাণ জানতে চেয়ে গত ২৯ আগস্ট পিআইওর কাছে তথ্য অধিকার আইনে আবেদন করেন এই প্রতিবেদক। ওই দপ্তর থেকে এখন পর্যন্ত তথ্য সরবরাহ করা হয়নি।

সিঙ্গাইরের পিআইও আবু নাসের বলেন, ‘আমি অসুস্থ, ছুটিতে আছি। তথ্যের বিষয়ে আমার দপ্তরের উপসহকারী প্রকৌশলীর সঙ্গে যোগাযোগ করেন। তিনি তথ্য দিয়ে দেবেন।’ এরপর এ বিষয়ে কথা বলার জন্য উপসহকারী প্রকৌশলী মো. নূরুজ্জামানের মুঠোফোনে একাধিকবার কল করা হলেও তিনি ধরেননি।

সরকারি অর্থায়নের এসব প্রকল্পে অসংগতি ও অনিয়ম থাকতে পারে। এ কারণে হয়তো তথ্য দিতে গড়িমসি করা হচ্ছে। 
ইকবাল হোসেন, সহসভাপতি, সুজন, মানিকগঞ্জ

এর আগে গত ২৩ মার্চ জেলা করাতকলের তালিকা, কতগুলো করাতকলের লাইসেন্স আছে এবং তার মধ্যে নবায়ন করা আছে, সেসব বিষয়ে তথ্য চেয়ে জেলা বন বিভাগের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তার কার্যালয়ের দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তার কাছে আবেদন করা হয়। ওই দপ্তর থেকে এখনো কোনো তথ্য সরবরাহ করা হয়নি। এ ব্যাপারে জেলা বন বিভাগের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (চলতি দায়িত্ব) সাইফুল ইসলাম বলেন, ‘আমার দপ্তরে এসব তথ্য নেই, যা আছে পরে দেওয়ার চেষ্টা করব।’

এ ছাড়া গত ২৩ মার্চ  ২০২০-২১ অর্থবছরে এশীয় উন্নয়ন ব্যাংকের (এডিবি) অর্থায়নে পরিচালিত প্রকল্পের নামের তালিকা এবং সংশ্লিষ্ট প্রকল্পে নিয়োজিত ঠিকাদারের বিষয়ে তথ্য চেয়ে সদর উপজেলা প্রকৌশলী কাছে আবেদন করা হয়। এ পর্যন্ত ওই কার্যালয় থেকে কোনো তথ্য সরবরাহ করা হয়নি। এ বিষয়ে কথা বলার জন্য সদর উপজেলা প্রকৌশলী মিজানুর রহমানের মুঠোফোনে একাধিকবার কল করা হলে তিনি ধরেননি। 

সুশাসনের জন্য নাগরিকের (সুজন) জেলা কমিটির সহসভাপতি ইকবাল হোসেন বলেন, তথ্য পাওয়া যেকোনো নাগরিকের অধিকার। নাগরিকদের তথ্য পেতে সরকার আইনও করেছে। সরকারি অর্থায়নের এসব প্রকল্পে অসংগতি ও অনিয়ম থাকতে পারে। এ কারণে হয়তো তথ্য দিতে গড়িমসি করা হচ্ছে।