বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ে আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে ছাত্রলীগের বিবদমান একাধিক পক্ষের মধ্যে একের পর এক হামলা ও সংঘর্ষের ঘটনা ঘটছে। তবে এসব ঘটনায় অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক পদক্ষেপ না নেওয়ায় একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটছে। এতে বিশ্ববিদ্যালয়ের সাধারণ শিক্ষার্থীরা নিরাপত্তাহীনতায় দিন পার করছেন। তবে ছাত্রলীগের নেতা–কর্মীদের অনেকে মনে করছেন, বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রলীগের কমিটি থাকলে এসব দ্বন্দ্ব–সংঘাত এড়ানো সম্ভব।
চলতি বছরের তিন মাসে ছাত্রলীগের অভ্যন্তরীণ পক্ষগুলোর মধ্যে তিনটি হামলা, পাল্টাপাল্টি হামলার ঘটনা ঘটেছে। এসব ঘটনায় মামলাও হয়েছে। তবে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে এখনো কোনো ব্যবস্থা নেয়নি।
ছাত্রলীগের একাধিক নেতার সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, গত পাঁচ বছরে বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রলীগের বিবদমান পক্ষের মধ্যে সংঘাত ও হামলার ঘটনায় বন্দর থানায় অন্তত ১০টি মামলা হয়েছে। এর মধ্যে লঘু অপরাধের একটি মামলায় পুলিশ আদালতে অভিযোগপত্র দেয়। এ ছাড়া দুটি মামলা মীমাংসা হয়ে গেছে। অন্য মামলাগুলোর এখনো কোনো অভিযোগপত্র দেওয়া হয়নি। এর মধ্যে বেশ কয়েকটি গুরুতর মামলা রয়েছে।
জানতে চাইলে বন্দর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) আসাদুজ্জামান প্রথম আলোকে বলেন, এসব মামলায় সাক্ষ্য দিতে গড়িমসিসহ নানা কারণে তদন্ত বিঘ্নিত হয়। তারপরও কিছু মামলার তদন্ত প্রতিবেদন দেওয়া হয়েছে। বাকি মামলাগুলোর তদন্ত চলছে।
বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ে পাঁচ বছর ধরে সিটি করপোরেশনের মেয়র সাদিক আবদুল্লার অনুসারীরা একচ্ছত্র আধিপত্য বিস্তার করেছেন।
ছাত্রলীগের রাজনীতিতে সক্রিয় এমন অন্তত চারজন বলেন, এসব সংঘাতের পেছনে মূল কারণ এখানে কোনো কমিটি না থাকা। সাংগঠনিক কোনো কমিটি না থাকায় আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে থাকা নেতাদের সমর্থন নিয়ে একেকটি পক্ষ গড়ে ওঠে। তবে একই নেতার সমর্থকদের মধ্যেও উপদলে বিভক্ত হয়ে সংঘাতে জড়ানোর ঘটনাও ঘটেছে। বর্তমানে সংঘাতে জড়ানো দুটি পক্ষই নগর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও সিটি মেয়র সেরনিয়াবাত সাদিক আবদুল্লাহর অনুসারী।
নিজেদের মধ্যেই আধিপত্যের লড়াই
বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ে পাঁচ বছর ধরে সিটি করপোরেশনের মেয়র সাদিক আবদুল্লার অনুসারীরা একচ্ছত্র আধিপত্য বিস্তার করেছেন। ২০২১ সালের মাঝামাঝি বরিশাল সদর আসনের সংসদ সদস্য ও পানিসম্পদ প্রতিমন্ত্রী জাহিদ ফারুকের অনুসারী হিসেবে আরেকটি পক্ষ ক্যাম্পাসে সক্রিয় হয়। এই পক্ষের নেতৃত্বে আছেন রক্তিম হাসান ও ময়িদুর রহমান। অন্যদিকে মেয়রের অনুসারী পক্ষটির নেতৃত্বে ছিলেন মহিউদ্দীন আহমেদ ওরফে সিফাত, আলীম সালেহীসহ কয়েকজন। কিন্তু গত বছর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মদিন উদ্যাপন উপলক্ষে তাঁর প্রতিকৃতিতে শ্রদ্ধা নিবেদন করা নিয়ে ছাত্রলীগের দুই পক্ষের মধ্যে হাতাহাতি হয়। এর জেরে গত বছরের ৫ জুলাই রাতে দুই পক্ষের মধ্যে ক্যাম্পাসে পাল্টাপাল্টি হামলার ঘটনা ঘটে। হামলায় উভয় পক্ষের সাতজন আহত হন। এরপর প্রতিমন্ত্রীর পক্ষটি আর ক্যাম্পাসে যায়নি।
শিক্ষার্থীদের ভাষ্য, প্রতিমন্ত্রীর পক্ষটি ক্যাম্পাসে অনুপস্থিত থাকায় মেয়রের অনুসারী মহিউদ্দীন ক্যাম্পাসে একচ্ছত্র আধিপত্য বিস্তার করেন। তাঁকে সহায়তা করেন তাঁর অনুসারী তাহমিদ জামান। নিজের ক্ষমতা নিরঙ্কুশ করতে মহিউদ্দীন তাঁরই অনুসারী আলীম সালেহীকেও ক্যাম্পাস থেকে বিতাড়িত করেন। ফলে একচ্ছত্র নিয়ন্ত্রক হন মহিউদ্দীন। কিন্তু মহিউদ্দীনের আধিপত্য বেশি দিন স্থায়ী হয়নি। গত ২৫ জানুয়ারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শের-ই-বাংলা হলের একটি কক্ষে ঢুকে মহিউদ্দীনকে কুপিয়ে জখম করে দুর্বৃত্তরা। এ ঘটনায় মহিউদ্দীন আহমেদ বাদী হয়ে সাতজনকে আসামি বন্দর থানায় মামলা করেন। মামলায় আলীম সালেহী, রিয়াজ মোল্লা ও তাঁদের সহযোগী চারজনকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ।
মহিউদ্দীন হামলায় আহত হওয়ার পর তাঁরই অনুসারী তাহমিদ জামান ক্যাম্পাসের নিয়ন্ত্রণ নেন। এতে মহিউদ্দীন এখন ক্যাম্পাস থেকে ছিটকে পড়েছেন।
আতঙ্কে শিক্ষার্থীরা
রাজনৈতিক সংগঠনের নেতা–কর্মীদের এসব সংঘাতের ঘটনায় সাধারণ শিক্ষার্থীরা সব সময়ই আতঙ্কে থাকেন। সবচেয়ে বেশি ভুক্তভোগী বিশ্ববিদ্যালয়ের আবাসিক শিক্ষার্থীরা। শের-ই-বাংলা হলের সাতজন আবাসিক শিক্ষার্থীর সঙ্গে এই প্রতিবেদকের কথা হয়।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে ওই শিক্ষার্থীরা বলেন, ছাত্রলীগের পক্ষগুলো সাধারণ শিক্ষার্থীদের প্রতিপক্ষের সমর্থক হিসেবে সব সময় সন্দেহ করে। এমন সন্দেহের জেরে অনেক সাধারণ শিক্ষার্থী নির্যাতনের শিকার হয়েছেন। ১ এপ্রিল শের-ই-বাংলা হলে যে তিন শিক্ষার্থী নির্যাতনের শিকার হয়েছেন, তাঁদেরকে ছাত্রলীগের একটি পক্ষ সন্দেহ করত। ওই পক্ষের সন্দেহ ছিল, ওই তিন শিক্ষার্থী আরেক পক্ষের সমর্থক এবং তাঁরা ওই পক্ষকে হলের গোপন খবর সরবরাহ করেন।
সংঘাত বন্ধে কমিটি চায় ছাত্রলীগ
বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রলীগের কমিটি না থাকায় দল-উপদলে বিভক্ত হয়ে কোন্দলে লিপ্ত হওয়ার ঘটনা ঘটছে বলে মনে করেন পক্ষগুলোর নেতৃস্থানীয়রা। ছাত্রলীগের কমিটি থাকলে এ ধরনের অভ্যন্তরীণ কোন্দল, সংঘাত এড়ানো সম্ভব হতো বলে মনে করছেন অনেকে।
প্রতিমন্ত্রীর সমর্থক পক্ষের নেতা রক্তিম হাসান বলেন, ‘আমরা দীর্ঘদিন ধরেই দাবি করে আসছি, এখানে কমিটি দেওয়া হোক। এ জন্য আমাদের কাছ থেকে একবার জীবনবৃত্তান্তও নেওয়া হয়েছিল। কিন্তু এরপর সে উদ্যোগে ভাটা পড়ে।’
তবে মেয়র সাদিক আবদুল্লাহর অনুসারী তাহমিদ জামান প্রথম আলোকে বলেন, ‘আসলে এখানে কমিটি বড় নয়, আমরা সংগঠনকে গতিশীল করার জন্য কাজ করে যাচ্ছি। এসব ক্ষেত্রে আমাদের অভিভাবক সাদিক আবদুল্লাহ যা করবেন, সেটাই আমাদের সিদ্ধান্ত।’ দ্বন্দ্ব–সংঘাতের প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘এখন আমাদের ক্যাম্পাসে শান্তিপূর্ণ পরিবেশ বিরাজ করছে। কোনো অশান্তি নেই, সংঘাত নেই।’
ছাত্রলীগের দ্বন্দ্ব-সংঘাতের বিষয়ে পানিসম্পদ প্রতিমন্ত্রীর অনুসারী মহানগর যুবলীগের যুগ্ম আহ্বায়ক মাহমুদুল হক খান মামুন বলেন, বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ে যাঁরা প্রকৃতঅর্থে ছাত্রলীগের আদর্শ ধারণ করে ছাত্রলীগ করতে চান, তাঁরা নানাভাবে নিগৃহীত হচ্ছেন। কমিটি না থাকায় সেখানে ‘চেইন অব কমান্ড’ বলতে কিছু নেই। মূল দলের একটি পক্ষ ‘ব্যক্তিপ্রভাব’ বজায় রাখতে বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রলীগকে প্রতিষ্ঠিত হতে দিতে চাইছে না।
মেয়র সাদিক আবদুল্লাহর ঘনিষ্ঠজন ও জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক তালুকদার মো. ইউনুস বলেন, বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রলীগের কর্মকাণ্ডের বিষয়ে তাঁরা কেউ হস্তক্ষেপ করেন না। তবে ছাত্রলীগের নামে ক্যাম্পাসে কেউ হানাহানি করুক, সেটা তাঁরা চান না। দ্রুত বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের কমিটি গঠনের জন্য পদক্ষেপ নেওয়া হবে বলে জানান তিনি।
বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন যা বলছে
বিশ্ববিদ্যালয়ে বারবার এমন ঘটনা ঘটলেও বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনকে কখনোই কঠোর ব্যবস্থা নিতে দেখা যায়নি। নানা সময় এসব ঘটনায় তদন্ত কমিটি হলেও ঘটনায় জড়িত ব্যক্তিদের শাস্তি হয়েছে, এমন নজির কম। এসব ঘটনায় ব্যবস্থা নেওয়ার বিষয়ে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন অসহায় কি না জানতে চাইলে বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর মো. খোরশেদ আলম প্রথম আলোকে বলেন, ‘বিষয়টি অসহায়ত্ব নয়, বরং শুরুতে আমরা শিক্ষার্থীদের ভবিষ্যেতের কথা চিন্তা করে এসব ঘটনায় লঘু শাস্তির দিকটা বিবেচনা করতাম। কিন্তু গত কয়েক বছরের তথ্য ঘেঁটে দেখবেন যে এসব ঘটনায় ঘুরেফিরে ১০ থেকে ১২ জনের নাম আসছে। এ জন্য গুটিকয়েকের জন্য তো আর ১০ হাজার শিক্ষার্থী নিরাপত্তা, শিক্ষার পরিবেশ বিঘ্নিত হতে পারে না। সে জন্য এসব হানাহানি বন্ধে এখন আমরা সর্বোচ্চ কঠোর অবস্থানে।’
চলমান মামলাগুলোর অগ্রগতি সম্পর্কে খোরশেদ আলম বলেন, ‘অনেক ঘটনায় দেখা যায়, অভিযোগকারী শিক্ষার্থী বাইরে বসে মীমাংসা করে আর তদন্ত কমিটির কাছে সাক্ষ্য দিতে আসেন না। সে ক্ষেত্রে ওই সব ঘটনায় আমাদের কিছু করার থাকে না। আর যেসব ঘটনা ফৌজদারি অপরাধ, সেগুলো নিয়ে মামলা হওয়ায় সেসব বিষয়ে আমরা আইনের কাছেই ছেড়ে দিই।’