পশ্চিম সুন্দরবনের সাতক্ষীরা রেঞ্জের লেবুবুনিয়া এলাকায়। সম্প্রতি তোলা
পশ্চিম সুন্দরবনের সাতক্ষীরা রেঞ্জের লেবুবুনিয়া এলাকায়। সম্প্রতি তোলা

সুন্দরবনে জেলের ছদ্মবেশে মধু চুরি, মৌয়ালদের অভিযোগ

সুন্দরবনে চলতি মৌসুমে কাঙ্ক্ষিত পরিমাণ মধু পাওয়া যাচ্ছে না বলে জানিয়েছেন মৌয়ালরা। তাঁদের অভিযোগ, মৌসুম শুরুর আগেই জেলের ছদ্মবেশে বনে প্রবেশ করে মধু সংগ্রহ করা হয়েছে। এ কারণে এমন সংকট দেখা দিয়েছে। এর সঙ্গে রয়েছে তীব্র অনাবৃষ্টির প্রভাবও। এবার মধু সংগ্রহের লক্ষ্যমাত্রা পূরণ হবে না বলে তাঁদের আশঙ্কা। এতে দাদনের টাকা পরিশোধ করা নিয়ে দুশ্চিন্তায় পড়েছেন মৌয়ালরা।

বাঘ-কুমিরের আক্রমণের ঝুঁকি মাথায় নিয়ে সুন্দরবনের বিভিন্ন স্থান থেকে মধু সংগ্রহ করেন মৌয়ালরা। মড়ার উপর খাঁড়ার ঘা হিসেবে দাদন আদায়ের জন্য তাঁদের ওপর মহাজনের উৎপীড়নও রয়েছে। সাতক্ষীরা রেঞ্জ–সংলগ্ন গাবুরা, ৯ নম্বর সোরা, বুড়িগোয়ালিনী, দাতিনাখালী ও কালিঞ্চি এলাকার মৌয়ালরা বলছেন, টানা দুই সপ্তাহ সুন্দরবনের নানা প্রান্তে ঘুরেও প্রত্যাশিত পরিমাণ মধু মেলেনি। তাই হতাশ হয়ে অনেকেই দ্বিতীয়-তৃতীয় ধাপে মধু সংগ্রহ করতে যাননি। টাকা পরিশোধের চাপ রয়েছে। তবে মধু পাওয়া না যাওয়ায় মহাজনের কাছে সময় চেয়ে নিয়েছেন অনেকেই।

শ্যামনগর উপজেলার গাবুরা ইউনিয়নের ৯ নম্বর সোরা গ্রামের জিন্নাত আলী বলেন, ‘চলতি বছর দুই ট্রিপ (দুবার) বনে গে মহাজনের চালান তুলতি পারিনি। দুই লাখ টাকা দাদন নে আটজনের দল নিয়ে প্রথম ধাপে দুই মণ মধু পেয়েছি। বিক্রি হয়েছে ৬৪ হাজার টাকা। দ্বিতীয় ধাপে গে আরও চার মণ মধু পালিও মহাজনের কাছে ৩০ হাজার টাকার দেনা নয়ে গেছে।’ তাঁর দাবি, আগেভাগে মধু কেটে নেওয়া হয়েছে। প্রত্যাশামতো মধু না মেলায় তাঁর সহযোগীরা আর বনে যেতে চাইছেন না।

সাতক্ষীরা রেঞ্জ কর্মকর্তার কার্যালয় সূত্রে জানা গেছে, পশ্চিম সুন্দরবনের সাতক্ষীরা রেঞ্জে ১ এপ্রিল আনুষ্ঠানিকভাবে মধু সংগ্রহ শুরু হয়; যা চলবে ৩১ মে পর্যন্ত। ১৫ মে পর্যন্ত গত দেড় মাসে সাতক্ষীরা রেঞ্জের চারটি স্টেশন থেকে ১৮১টি পাস (অনুমতিপত্র) নিয়ে ১ হাজার ২৩৫ জন মৌয়াল মধু সংগ্রহে সুন্দরবনে যান। ৬ সপ্তাহে ৬৬৭ দশমিক ৫০ কুইন্টাল মধু সংগ্রহ করেছেন তাঁরা। একই সময়ে তাঁরা ১৮৫ দশমিক ২৫ কুইন্টাল মোম সংগ্রহ করেছেন। চলতি বছর পশ্চিম সুন্দরবন সাতক্ষীরা রেঞ্জ থেকে ৯৫০ কুইন্টাল মধু ও ২৮৬ কুইন্টাল মোম সংগ্রহের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে।

সুন্দরবন–সংলগ্ন গাইনবাড়ি এলাকার মৌয়াল ইলিয়াস গাজী (৫৪) ও আঠারবেঁকি গ্রামের এন্তাজ গাইন (৫৭) জানান, বন বিভাগের নির্দেশনা মেনে এপ্রিলের শুরুতে তাঁরা সুন্দরবনে মধু সংগ্রহ করতে যান। আগেভাগে জেলের ছদ্মবেশে বনে ঢুকে মধু চুরি করায় এমন অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে। ৫০-৬০ শতাংশ মধুর চাক কাটা দেখেছেন তাঁরা।

কাশিমাড়ী গ্রামের ইসমাইল বিশ্বাস জানান, ৩০ বছরের বেশি সময় ধরে তিনি সুন্দরবন থেকে মধু সংগ্রহের কাজ করছেন। তবে আগের বছরগুলোর তুলনায় চলতি মৌসুমে অর্ধেক মধুও পাওয়া পাওয়া যায়নি। ফলে চলতি মৌসুমে দুই দফায় মাত্র ১১ মণ মধু পাওয়ায় দাদনের টাকা পরিশোধ নিয়ে বিপাকে পড়েছেন তিনি। ঋণের বোঝা ভারী না করতেই তিনি এ বছর তৃতীয় ধাপে সুন্দরবনে যাচ্ছেন না।

মৌসুম শুরুর আগেই মাছ শিকারের আড়ালে সুন্দরবনে ঢুকে মধু চুরি করছে দুর্বৃত্তরা—এমন অভিযোগ করেন ৯ নম্বর সোরা গ্রামের শহিদুল ইসলাম ও কালিঞ্চির আবদুল আজিজ সরদার। তাঁদের মতে, এবার পর্যাপ্ত বৃষ্টির অভাবে অনেক গাছে সময়মতো ফুল আসেনি। এটিও মধুর সংকটের জন্য দায়ী।

এদিকে ভবিষ্যতে মধু চুরি ঠেকানো না গেলে সুন্দরবনে মৌয়ালদের যাতায়াত কমে যাবে বলে আশঙ্কা করেছেন দাতিনাখালী গ্রামের ষাটোর্ধ্ব মৌয়াল আবুল হোসেন। তিনি জানান, মহাজনের কাছ থেকে চড়া সুদে ঋণ নিয়ে লোকজন নিয়ে সুন্দরবনে গেলেও মধু না পাওয়ায় অনেকের মতো তিনিও ঋণগ্রস্ত হয়ে পড়েছেন।