হাতি আসার খবরে পাড়া–প্রতিবেশীর চিৎকার শুনে ঘর থেকে বের হন মো. আকবর (৩৮)। ঘরের উঠানেই হাতির সামনে পড়ে যান তিনি। দৌড়ে পালানোর চেষ্টাও করেন। কিন্তু উঠানের সীমানায় জালে পেঁচিয়ে পড়ে যান। সঙ্গে সঙ্গে হাতি প্রথমে পা দিয়ে তাঁকে পিষ্ট করে, পরে শুঁড়ে তুলে আছড়ে ফেলে। ঘটনাস্থলেই মারা যান তিনি। গত ২২ অক্টোবর রাতে কর্ণফুলী উপজেলার বড় উঠান ইউনিয়নের ৭ নম্বর ওয়ার্ডের জানুর বাপের বাড়ি এলাকায় এ ঘটনা ঘটে।
চট্টগ্রামের আনোয়ারা, কর্ণফুলী ও বাঁশখালীর পাহাড়ি এলাকায় বন্য হাতির আক্রমণের ঘটনা নিয়মিত হয়ে দাঁড়িয়েছে। এই তিন উপজেলায় আকবরসহ গত ৬ বছরে হাতির হামলায় ২৮ জনের মৃত্যু হয়েছে। আহতের সংখ্যা শতাধিক। এসব এলাকায় পাহাড়ের পাদদেশে বসবাসরত মানুষের ফসলের খেত, ধানের গোলা ও বাড়িঘরে নিয়মিত হানা দিচ্ছে হাতি। অপর দিকে প্রাণহানি বন্ধে এবং ফসল ও বসতবাড়ি রক্ষায় বৈদ্যুতিক তারের ফাঁদ লাগিয়ে মানুষও হাতি হত্যা করছেন। গত এক দশকে কেবল বাঁশখালী উপজেলায় ১৪টি হাতির মৃত্যু হয়েছে।
বন্য প্রাণী বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বন্য হাতি বংশপরম্পরায় অতীতের পথ ধরে হাঁটাচলা করে। এতে বিঘ্ন ঘটলে তারা মারমুখী হয়ে ওঠে। একটি হাতি দৈনিক ১৫-১৬ ঘণ্টা এবং ৭০-৮০ কিলোমিটার হাঁটে। আর খাবার খায় প্রায় ১৫০ কেজি। সব মিলিয়ে হাতির জন্য বিশাল জায়গা প্রয়োজন হলেও তা এখন কমে আসছে। ফলে হাতি ক্ষুব্ধ হয়ে উঠছে।
বন বিভাগের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, হাতির চলাচলের রাস্তায় বসতি স্থাপন, বন উজাড়, হাতির করিডর নষ্টসহ নানা কারণে এসব এলাকায় হাতি ও মানুষ মুখোমুখি হয়ে পড়েছে। নব্বই দশকে আনোয়ারা ও কর্ণফুলী উপজেলার দেয়াঙ পাহাড় হাতির এলাকা বলে পরিচিত ছিল। বিশেষ করে বাঁশখালী থেকে প্রায়ই রাতের বেলা হাতি আসা–যাওয়া করত। কিন্তু সেখানে আড়াই হাজার একর জায়গায় গড়ে তোলা হয় কেইপিজেড। কেইপিজেডের ভেতরে সবুজ পাহাড়ে বর্তমানে চারটি হাতি অবস্থান নেয়। প্রায় প্রতি রাতে এসব হাতি লোকালয়ে চলে আসে এবং এতে জানমালের ক্ষতি হচ্ছে। এ ছাড়া আনোয়ারা থেকে বাঁশখালী পর্যন্ত হাতির দীর্ঘ করিডর ছিল। এই করিডরের নানা স্থানে এখন বসতি গড়ে উঠেছে।
আনোয়ারা, বাঁশখালী ও কর্ণফুলী উপজেলায় হাতি নিয়ে দীর্ঘদিন ধরে গবেষণা করছেন বেঙ্গল ডিসকাভারের প্রধান নির্বাহী ও বন্য প্রাণী সংরক্ষক আমিনুল ইসলাম। প্রথম আলোকে তিনি বলেন, আনোয়ারা-কর্ণফুলীতে কেইপিজেড ও চায়না ইকোনমিক্যাল জোনের কারণে বন উজাড় হয়েছে। ফলে লোকালয়ে হাতি আসছে। অপর দিকে বাঁশখালীর বিভিন্ন এলাকায় বনের জায়গায় ঘর, খামার গড়ে উঠেছে। ধানও চাষ হচ্ছে। ফলে হাতি সেখানে হামলা করছে। এ কারণে এই এলাকায় হাতি ও মানুষের মধ্যে দ্বন্দ্ব লেগেই আছে।
বন্য প্রাণী বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বন্য হাতি বংশপরম্পরায় অতীতের পথ ধরে হাঁটাচলা করে। এতে বিঘ্ন ঘটলে তারা মারমুখী হয়ে ওঠে। একটি হাতি দৈনিক ১৫-১৬ ঘণ্টা এবং ৭০-৮০ কিলোমিটার হাঁটে। আর খাবার খায় প্রায় ১৫০ কেজি। সব মিলিয়ে হাতির জন্য বিশাল জায়গা প্রয়োজন হলেও তা এখন কমে আসছে। ফলে হাতি ক্ষুব্ধ হয়ে উঠছে।
আমিনুল ইসলাম বলেন, এ দ্বন্দ্ব নিরসনে মানুষকে, বিশেষ করে তরুণদের সচেতন হতে হবে। হাতি না সরিয়ে হাতিভিত্তিক পর্যটন—ইকো ভিলেজও গড়ে তোলা যায়। পাশাপাশি বন ও লোকালয়ের মাঝখানে গাছপালাসহ খালি জমি বা ভূমি রাখতে হবে, যা ইকোটোন হিসেবে থাকবে। ফলে হাতি বন থেকে নেমে সেখান থেকে ঘুরে বনে ফিরে যাবে।
জলদী বন্য প্রাণী অভয়ারণ্য রেঞ্জের রেঞ্জ কর্মকর্তা আনিসুজ্জামান শেখের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, আনোয়ারা, কর্ণফুলী ও বাঁশখালী—এই তিন উপজেলায় ৪৪টি হাতি রয়েছে। এসব হাতি প্রতিদিন দীর্ঘ পথ পরিভ্রমণ করে। ৪৪টির মধ্যে বাঁশখালীর পাহাড়েই ৪০টি অবস্থান করছে। বাকি ৪টি হাতি কর্ণফুলী উপজেলায় শিল্পকারখানা তৈরির কারণে সেখানে আটকে পড়েছে। কর্ণফুলীর দেয়াঙ পাহাড়ে এসব হাতি এখন নিয়মিত হানা দিচ্ছে।
আনোয়ারা, কর্ণফুলী ও বাঁশখালী—এই তিন উপজেলায় ৪৪টি হাতি রয়েছে। এসব হাতি প্রতিদিন দীর্ঘ পথ পরিভ্রমণ করে। ৪৪টির মধ্যে বাঁশখালীর পাহাড়েই ৪০টি অবস্থান করছে। বাকি ৪টি হাতি কর্ণফুলী উপজেলায় শিল্পকারখানা তৈরির কারণে সেখানে আটকে পড়েছে। কর্ণফুলীর দেয়াঙ পাহাড়ে এসব হাতি এখন নিয়মিত হানা দিচ্ছে।
আনিসুজ্জামান শেখ বলেন, চুনতি বন্য প্রাণী অভয়ারণ্য থেকে বাঁশখালী ইকোপার্ক পর্যন্ত ১৫ কিলোমিটার হাতির করিডর (চলাচলের পথ) ছিল। এই পথে এখন নানা বাধার সম্মুখীন হচ্ছে হাতি। এভাবে হাতির চলাচলের পথ সংকুচিত হচ্ছে।
২০১৮ সালের সালের ১৩ জুলাই থেকে এ বছরের নভেম্বর পর্যন্ত সময়ে ৬ বছরে আনোয়ারা ও কর্ণফুলী উপজেলায় ১৭ জন মানুষের মৃত্যু হয়েছে। তাঁরা হলেন মো. আকবর (৩৮), হালিমা খাতুন (৫৫), মো. দুলাল (৫০), রেহেনা আক্তার (৩৫), মোহাম্মদ ছৈয়দ (৫৭), ছাবের আহমদ (৭৫) আজিজ ফকির (৭০), মানসিক ভারসাম্যহীন অজ্ঞাতপরিচয় ব্যক্তি (৬০), জালাল আহমদ (৭২), মোহাম্মদ সোলায়মান (৭০), দেবী রানী দে (৪৫), মায়া রানী বড়ুয়া (৬০), আখতার হোসেন চৌধুরী (৫০), মোমেনা খাতুন (৬৫), আখতার হোসেন চৌধুরী (৫০), আবদুল মোতালেব (৬৮) ও আবদুর রহমান (৭০।
হাতির হামলার ঘটনা তিন উপজেলার মধ্যে বাঁশখালীতে বেশি ঘটে। এর মধ্যে কেবল গত দুই বছরেই এই উপজেলায় ১১ জনের মৃত্যুর তথ্য আছে। এর মধ্যে ২০২৪ সালের ১২ জুলাই পুকুরিয়ায় আবদুস সবুর (৪২), ১ মে বৈলছড়ি এলাকায় সিবাগাতুল্লাহ (১৬), ৬ ফেব্রুয়ারি পুকুরিয়ায় আবুল কালাম (৬৫) নিহত হন। এর আগে ২০২৩ সালের ২৫ আগস্ট আবুল হাশেম (৪৫), ২৫ জুলাই বৈলছড়ি এলাকার ফকির মোহাম্মদ, ৭ ফেব্রুয়ারি অজ্ঞাতনামা নারী, ২৫ জানুয়ারি চাম্বলের নুরুল ইসলাম, আনোয়ারা বেগম, দীপ্তি দেব, শাহ আলম, ও সেনোয়ারা বেগম মারা যান হাতির আক্রমণে।
বন বিভাগের কর্মকর্তারা জানান, জানমাল ও ফসল রক্ষায় অনেক এলাকার কৃষক বৈদ্যুতিক তার দিয়ে রাখেন হাতির চলাচলের পথে। ফলে প্রায় হাতির মৃত্যু ঘটছে। আইনি পদক্ষেপ নিয়েও এ ধরনের ঘটনা ঠেকানো যাচ্ছে না।
বাঁশখালীর কালীপুর রেঞ্জ কর্মকর্তা মো. মনোয়ার হোসেন বলেন, ২০১৪ সাল থেকে এ পর্যন্ত ১০ বছরে কালিপুর রেঞ্জ আওতায় এখন পর্যন্ত ১১টি বন্য হাতির মৃত্যু হয়েছে। বিষক্রিয়ায়, বৈদ্যুতিক ফাঁদে ও দুর্ঘটনায় এসব হাতির মৃত্যু হয়েছে। এর মধ্যে বৈদ্যুতিক ফাঁদে পড়ে চারটি হাতির মৃত্যুর ঘটনা রেকর্ড করা হয়েছে। বিষক্রিয়ায় মারা গেছে দুটি।
অপর দিকে একই উপজেলার জলদী রেঞ্জে তিনটি হাতি মারা গেছে। এর মধ্যে ২০২৩ সালের ৮ জুলাই চাম্বলের দুইল্লাঝিরি এলাকার পাহাড়ের পাদদেশে একটি এবং ২০২১ সালের ১২ নভেম্বর চাম্বল এলাকার পূর্ব চাম্বলে ধানখেত থেকে একটি হাতির মরদেহ উদ্ধার করে বন বিভাগ।
বৈদ্যুতিক ফাঁদ পেতে হাতি হত্যা মামলায় ২০২১ সালের ১৪ ডিসেম্বর বাবা ও ছেলেকে গ্রেপ্তার করে কারাগারে পাঠান বাঁশখালীর সহকারী জজ আদালতের বিচারক মো. মাঈনুল ইসলাম। ওই দুজন হলেন মোহাম্মদ কালাম (৬৫) ও তাঁর ছেলে নেজাম (২৪)। তাঁদের বাড়ি সাতকানিয়া উপজেলায় এওচিয়া ইউনিয়নের ১ নম্বর ওয়ার্ডে। হাতি হত্যার ঘটনায় বন বিভাগ তাঁদের বিরুদ্ধে মামলা করেছিল।
হাতি মানুষের দ্বন্দ্ব নিরসনে বন বিভাগের পক্ষ থেকে স্বেচ্ছাসেবক নিয়োগসহ এ পর্যন্ত বেশ কিছু উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। তবে সমস্যার সমাধান হয়নি। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এ জন্য দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা, হাতির করিডর পুনরুদ্ধার ও বন সংরক্ষণ জরুরি।
গত ২১ অক্টোবর পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসানের উদ্যোগে কেইপিজেডে হাতি সুরক্ষায় ১১ সদস্যবিশিষ্ট বিশেষজ্ঞ কমিটি গঠন করা হয়। ওই কমিটি কেইপিজেডের কর্মীদের নিরাপদ কর্মপরিবেশ এবং মানুষ-হাতির দ্বন্দ্ব নিরসনে করণীয় বিষয়ে সুনির্দিষ্ট সুপারিশ–সংবলিত প্রতিবেদন জমা দেয়। ওই কমিটি প্রতিবেদনে উল্লেখ করে কেইপিজেড হাতি চলাচলের করিডর। তাই সেখান থেকে হাতি সরানো যাবে না। সেখানে হাতি রেখেই সংরক্ষণের সুপারিশ করা হয়।