প্রায় ৩৪ বছর ধরে জুতা মেরামতের কাজ করেন গোবিন্দ ঋষিদাস। নেত্রকোনা শহরের থানা মোড় এলাকায় গেলে দেখা মিলবে এই ব্যক্তির। জুতা পলিশ ও সেলাইয়ের কাজ করেই সংসার চালান তিনি। সকাল থেকে রাত পর্যন্ত একটানা খাটুনি শেষে পকেটে আসে সর্বোচ্চ ৩০০ টাকা। তবে তাঁর দৈনিক আয়ের বেশির ভাগ অংশই ব্যয় হয়ে যাচ্ছে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য কিনতে। দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির কারণে সংসারের খরচের হিসাব মেলাতে গিয়ে হিমশিম খাচ্ছেন গোবিন্দ।
আজ শনিবার সকালে থানা মোড় এলাকায় গোবিন্দের সঙ্গে কথা হয়। তিনি শহরের সাতপাই রেল কলোনি এলাকার বাসিন্দা গোপাল ঋষিদাসের ছেলে। দুই মেয়ে, এক ছেলে ও স্ত্রীকে নিয়ে গোবিন্দ ঋষিদাসের সংসার। বড় মেয়ে কবিতার বয়স ১৭। ছেলে আনন্দ ঋষিদাস নেত্রকোনা উচ্চবিদ্যালয়ে চতুর্থ শ্রেণিতে লেখাপড়া করে। আর ছোট মেয়ে অর্পিতাকে এবার স্কুলে ভর্তি করা হয়েছে। তাঁর স্ত্রী হেমলতা গৃহিণী। গোবিন্দের আয় দিয়েই পুরো সংসার চলে। আর্থিক টানাপোড়েনে কয়েক বছর আগেই বড় মেয়ে কবিতার পড়াশোনা বন্ধ হয়ে গেছে। সম্প্রতি গ্যাস, বিদ্যুতের দাম বাড়ার পাশাপাশি নিত্যপণ্যের দাম এতটাই বেড়েছে যে ছোট দুই ছেলেমেয়েকে কত দিন পড়াশোনা করাতে পারবেন, তা নিয়ে সন্দিহান গোবিন্দ।
গোবিন্দের ভাষ্য, করোনা মহামারির আগেও তাঁর পরিস্থিতি এতটা মন্দ ছিল না। তখন সারা দিনে ৪০০ থেকে ৫০০ টাকার হতো। সেই সময় নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের দাম অনেকটা নাগালের মধ্যে ছিল। তবে এখন প্রায় সব জিনিসের দামই নাগালের বাইরে চলে যাচ্ছে। গোবিন্দ বলেন, ‘এভাবে চলতে থাকলে আমরা আর বাঁচব না। দুইটা বাচ্চা ইস্কুলে (স্কুল) পড়ে। পেনসিল-কলম-খাতার দামও অনেক বাড়ছে। পাগলের মতো হয়ে যাচ্ছি। বাচ্চাদের লেখাপড়া মনে হয় আর করাইতে পারতাম না। আমার মতো জুতার কামই করতে হইব তাদের।’
প্রতিদিন সকাল সাতটায় দোকান খোলেন গোবিন্দ। দুপুরে ঘণ্টা দেড়েকের জন্য বাসায় যান। এরপর নাওয়া-খাওয়া সেরে আবার দোকানে বসে রাত নয়টা পর্যন্ত কাজ করেন। প্রতিদিনের মতো আজ সকাল সাতটায় দোকানে এসেছেন। এরপর সকাল সাড়ে ৯টা পর্যন্ত মাত্র ৩০ টাকা আয় করতে পেরেছেন তিনি।
গোবিন্দ বলেন, ‘কাজকাম একবারে নাই বললেই চলে। খুবই কষ্টে সংসার চলছে। বাজারে প্রায় সব জিনিসের দাম হুড়হুড় করে বাড়ছে। কিন্তু কাজের মুজুরি বাড়ছে না। মাস ছয়েক আগেও জুতা পলিশের ডায়মন্ড ক্রিম কিনতাম ৩৫ টাকায়। এখন তা ৫৫ টাকায় কিনতে হয়। ১০–১৫ টাকা দামের ব্রাশ এখন ৪০ টাকা দিয়ে কিনতে হয়। সকাল থেকে রাত পর্যন্ত কাজ করে ২৫০ থেকে ৩০০ টাকা পর্যন্ত আয় করা যায়। কোনো দিন তা–ও হয় না। যেই টাকা পাই, সেটা দিয়ে পাঁচজনের সংসার চালানো কষ্ট।’
রাতে বাসায় ফেরার সময় বাজার করেন গোবিন্দ। কয়েক মাস ধরে বাজারে গেলে মুহূর্তেই পকেট খালি হয়ে যায়। কিন্তু বাজারের ব্যাগ ভরে না। গোবিন্দ বলেন, ‘চাল, আলু, ডাল কিনতেই তো সব টাকা শেষ হয়ে যায়। মাছ-মাংস কেনা হয় না। ছোট মেয়েটা মুরগির মাংস খেতে পছন্দ করে। তাই মাসে দুই–তিনবার ব্রয়লার মুরগি কেনা হতো। কিন্তু এখন ব্রয়লারের দামও বেড়ে গেছে।’
তবে সবকিছু ছাপিয়ে বড় মেয়ে কবিতার বিয়ে নিয়েই এখন গোবিন্দের ভাবনা বেশি। কবিতা ষষ্ঠ শ্রেণি পর্যন্ত পড়াশোনা করেছে। তাঁর ইচ্ছা ছিল মেয়েকে কলেজে পড়াবেন। কিন্তু অভাবের কারণে সেটা সম্ভব হয়নি। গোবিন্দ বলেন, ‘বড় মেয়েডার বয়স এখন ১৭। আর এক বছর পরে বিয়ে দেওন যাইব। কিন্তু বিয়ে দিতে গেলে তো অনেক খরচ করতে হইব। দেনা–পাওনার বিষয় আছে। খালি হাতে তো আর বিয়ে দেওন যাইব না। কী জানি, সামনে কপালে কী আছে!’