ইছামতী নদীর অদূরে বিস্তীর্ণ মাঠ। মাঠে বসেছে সারি সারি দোকান। বড় বড় মাছের পসরা সাজিয়ে বসেছেন দোকানিরা। ভোরের আলো ফুটতে না ফুটতেই দোকানে দোকানে মানুষের ঢল। ক্রেতা-বিক্রেতাদের হাঁকডাকে সরগরম গোটা এলাকা। আজ বুধবার সকালে বগুড়ার কয়েক শ বছরের ঐতিহ্য পোড়াদহ মেলায় এ দৃশ্য দেখা যায়। বগুড়া শহর থেকে প্রায় ১২ কিলোমিটার দূরে গাবতলী উপজেলার মহিষাবান ইউনিয়নের পোড়াদহ এলাকায় বসেছিল দিনব্যাপী এই মেলা।
বগুড়া অঞ্চলে ঐতিহ্যবাহী এ মেলা ‘জামাই মেলা’ নামেও পরিচিত। এবার মাছ ছাড়াও হরেক পদের মিষ্টান্ন, খেলনা, কাঠের আসবাব, প্রসাধনীর দোকান ছাড়াও চরকি, নাগরদোলা, মৃত্যুকূপে মোটরসাইকেল খেলা, সার্কাসসহ নানা আনন্দ ছিল এ মেলায়।
ঐতিহ্যবাহী এ মেলা সব ধর্ম, বর্ণ, গোত্র ও মতের মানুষের এক মহামিলন কেন্দ্র। কাজের ব্যস্ততায় আত্মীয়স্বজনদের সঙ্গে বিচ্ছিন্ন হয়ে যাওয়া এ অঞ্চলের লাখো মানুষ বছরে অন্তত একটিবারের জন্য হলেও একত্র হন এ মেলা ঘিরে। মেলার কয়েক দিন আগে থেকেই শতাধিক গ্রামে বিরাজ করে উৎসবের আমেজ। মেলা উপলক্ষে জামাতা-মেয়েসহ আত্মীয়স্বজনদের নিমন্ত্রণ জানানো হয়। মেলা থেকে শৌখিন মাছ কিনে শ্বশুরবাড়িতে নিমন্ত্রণ খেতে যাওয়ার চল আছে গাবতলী, সারিয়াকান্দি, ধুনটসহ এই অঞ্চলে।
যদিও মেলা শুরুর সঠিক দিনক্ষণ জানা যায় না। তবে একাধিক সূত্রে জানা যায়, প্রায় ৪০০ বছর আগে পোড়াদহসংলগ্ন মরা বাঙ্গালী নদীতে প্রতিবছর মাঘের শেষ বুধবার অলৌকিকভাবে বড় একটি কাতলা মাছ সোনার চালুনি পিঠে নিয়ে ভেসে উঠত। মাঘের শেষ বুধবার এ অলৌকিক ঘটনা দেখার জন্য অনেক মানুষ জড়ো হতো। পরে স্থানীয় একজন সন্ন্যাসী স্বপ্নাদিষ্ট হয়ে অলৌকিক এ মাছের উদ্দেশে অর্ঘ্য নিবেদনের জন্য সবাইকে উদ্বুদ্ধ করেন। সন্ন্যাসীর আহ্বানে সাড়া দিয়ে পোড়াদহ বটতলায় মাঘের শেষ বুধবার অলৌকিক মাছের উদ্দেশে স্থানীয় লোকজন অর্ঘ্য নিবেদন শুরু করেন। এটি সন্ন্যাসীপূজা নাম নেয়। পূজা উপলক্ষে লোকসমাগম বাড়তে থাকে ও বড় বড় মাছ বেচাকেনার জন্য মেলাটি প্রসিদ্ধ হয়ে ওঠে। কালক্রমে এই মেলা পরিচিতি পায় পোড়াদহের মেলা হিসেবে। ইছামতী, করতোয়া, যমুনা ও বাঙ্গালী নদীতে ধরা বাহারি মাছ বিক্রির জন্য মেলায় নিতেন জেলেরা। মেলায় মাছ কিনতে দূরদূরান্ত থেকে ভিড় করেন ক্রেতা ও দর্শনার্থীরা। বাংলা পঞ্জিকা অনুসারে প্রতিবছর মাঘ মাসের শেষ বুধবার (এবার ফাল্গুন মাসের প্রথম বুধবার মেলা বসেছে) ইছামতী নদীর তীরে পোড়াদহ মেলা বসে। এক দিনের মেলা হলেও আবহ থাকে কয়েক দিন ধরে।
গোলাবাড়ি বাজার বণিক সমিতির সাবেক সাধারণ সম্পাদক শামীম হাসান বলেন, প্রায় ৪০০ বছরের ঐতিহ্যের সাক্ষী এই পোড়াদহ মেলা। একসময় এই মেলা থেকে শখের মাছ কিনে ইছামতী নদীতে সওদাগরি নৌকা ভাসিয়ে ঘরে ফিরতেন বাণিজ্য করতে আসা সওদাগরেরা। ৪০০ বছরের ঐতিহ্য ধরে রেখে এখনো মাছের মেলা বসছে এখানে।
অর্থনৈতিকভাবেও এর গুরুত্ব অপরিসীম। প্রতিবছর এ মেলায় কয়েক কোটি টাকার লেনদেন হয় এবং লেনদেনের একটা বড় অংশ উচ্চবিত্ত থেকে নিম্নবিত্তগামী বলে গ্রামীণ অর্থনীতিতে অবদান রাখছে।
সকালে মেলায় গিয়ে দেখা যায়, মেলায় ক্রেতা–দর্শনার্থীদের ঢল নেমেছে। সিএনজিচালিত অটোরিকশা, ভটভটি, ইজিবাইক, রিকশা-ভ্যান, মোটরসাইকেল, টমটমে চড়ে দর্শনার্থীরা মেলায় এসেছেন। ভোররাত থেকে মাছের দোকানগুলোতে চলছে জমজমাট বেচাকেনা। পুকুর-দিঘি, নদ-নদী, বিলে চাষ করা বড় বড় মাছ নিয়ে দোকানে দোকানে পসরা সাজিয়ে বসেছেন ব্যবসায়ীরা। দোকানে দোকানে ঝুলছে রঙিন জরি। সারি সারি দোকানে পসরায় ছিল বড় বড় রুই-কাতলা, চিতল, আইড়, বোয়াল, বিগহেডসহ নানা জাতের মাছ। একেকটি মাছ ৫ থেকে ৪৪ কেজি পর্যন্ত ওজন। বড় বড় তাজা মাছ দেখতে ভিড় করেছেন হাজারো মানুষ। ক্রেতারা মাছ পরখ করছেন, দরদাম করে কিনছেন।
মেলার আয়োজক কমিটির সভাপতি ও মহিষাবান ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) চেয়ারম্যান আবদুল মজিদ মণ্ডল প্রথম আলোকে বলেন, অন্য বছরের তুলনায় এবারের মেলা সবচেয়ে বেশি জমজমাট ও উৎসবমুখর। মেলায় প্রায় ৩০০ দোকানে বাহারি মাছের পসরা সাজিয়ে বসেছেন বিক্রেতারা। প্রতি কেজি মাছ গড়ে ৩৫০ থেকে আড়াই হাজার টাকা কেজি দরে বিক্রি হয়েছে মেলায়। সেই হিসাবে মেলায় আনুমানিক ২০ কোটি টাকার ব্যবসা হয়েছে বলে ধারণা।
আয়োজক কমিটির সদস্য মোকছেদুল আলম বলেন, একসময় মেলায় যমুনা, করতোয়া, ইছামতী, বাঙ্গালী নদীতে ধরা পড়া মাছ বেশি বিক্রি হতো। এখন পুকুর-দিঘিতে চাষ করা বড় বড় শৌখিন মাছ বেশি বিক্রি হয়। এখানে বড় কাতলা মাছ প্রতি কেজি ১০০০ থেকে ১২০০ টাকা, রুই ৫০০ থেকে ১০০০ টাকা, বিগহেড ৩৫০ থেকে ৫০০ টাকা, সিলভারকার্প ৩৫০ থেকে ৪৫০ টাকা, গ্রাসকার্প ৫০০ থেকে ৬০০ টাকা, বোয়াল ১০০০ থেকে ১৪০০ টাকা, চিতল ১৫০০ থেকে ১৬০০ টাকা, পাঙাশ ৩৫০ থেকে ১০০০ টাকা, ব্লাডকার্প ৪০০ থেকে ৭০০ টাকা এবং আইড় মাছ ১৮০০ থেকে ২০০০ টাকা কেজি বিক্রি হয়েছে।
এবারের মেলার অন্যতম আকর্ষণ ছিল সাগরে ধরা পড়া ৪০ কেজি ওজনের তাজা সোর্ড ফিশ বা পাখি মাছ। টাঙ্গাইলের বাসাইল থেকে আসা মাছ ব্যবসায়ী শরীফ তালুকদার সকালের দিকে এ মাছের দাম চেয়েছেন ৬০ হাজার টাকা। অন্যদিকে ব্যবসায়ী রবিউল ইসলাম প্রামাণিক ও স্বপন ইসলাম ৪৪ কেজি ওজনের হিমায়িত একটি সোর্ড ফিশের দাম চেয়েছেন ৩৫ হাজার টাকা। তাঁদের দোকানে ৮ কেজি ওজনের একটি চাপা সুরমা মাছ দেখতেও ভিড় করেন ক্রেতারা।
শরীফ তালুকদার বলেন, ‘বঙ্গোপসাগরে ধরা পড়া ৪০ কেজি ওজনের সোর্ড মাছ বিক্রি করতে এসেছি। ৬০ হাজার টাকা দাম চেয়েছি। এখনো কেউ দরদাম করেনি। ৫০ হাজার টাকায় বিক্রি করতে পারব বলে আশাবাদী।’ সিরাজগঞ্জ থেকে মাছ বিক্রি করতে আসা বাচ্চু সরকার বলেন, ‘নদীতে ধরা পড়া ১৬ কেজি ওজনের চিতল মাছ ছাড়াও ১২ কেজি ওজনের আইড় ও বোয়াল মাছ এনেছি বিক্রির জন্য। এসব মাছ দেড় থেকে আড়াই হাজার টাকা কেজি দরে বিক্রি করছি।’
অন্যদিকে ব্যবসায়ী আতাউর রহমান ও আক্কাস আলীর দোকানে উঠেছিল ১৯ কেজি ওজনের একটি বোয়াল মাছ। গাবতলী উপজেলার পাররানীরপাড়ার বাসিন্দা আবদুস সালাম এই বোয়াল কিনেছেন ৪৩ হাজার টাকায়।
ব্যবসায়ী জানান, অন্যবারের চেয়ে এবার মেলায় মাছ উঠেছে বেশি, বেচাবিক্রিও জমজমাট। পাররানীরপাড়া গ্রামে শ্বশুরবাড়িতে নিমন্ত্রণে আসা সবুজ ইসলাম বলেন, ‘নতুন বিয়ে করেছি। মেলা থেকে মাছ কিনে শ্বশুরবাড়িতে বেড়াতে আসার চল রয়েছে এই অঞ্চলে। ৬ হাজার টাকার মধ্যে একটা মাছ কিনতে মেলায় এসেছি।’
মেলায় ঘুরতে আসা সরকারি আজিজুল হক কলেজের শিক্ষার্থী জাহিন আদনান বলেন, ‘পোড়াদহ মেলায় ঘুরতে আসার জন্য সারা বছর মুখিয়ে থাকি। এবার মেলার দিনে পয়লা ফাল্গুনের বসন্তবরণ উৎসব, ভ্যালেনটাইনস ডে, সরস্বতীপূজার উৎসব আমেজ। কিন্তু সবকিছু ফেলে বন্ধুদের সঙ্গে মেলায় ঘুরতে এসেছি। মেলায় আনন্দ উৎসবের সব আয়োজনই আছে এবার।’
অন্যবার মেলার প্রধান আকর্ষণ থাকত পদ্মা-যমুনায় ধরা পড়া বিশাল বিশাল বাগাড় মাছ। মহাবিপন্ন প্রজাতির এই বাগাড় মাছ বেচাবিক্রি নিষিদ্ধ ঘোষণা করেছে বন বিভাগের বন্য প্রাণী অপরাধ দমন ইউনিট। বিধিনিষেধ বাস্তবায়নে স্থানীয় প্রশাসন কঠোর হওয়ায় এবারের মেলায় কোনো বাগাড় মাছ বেচাকেনা হয়নি।
মাছের মেলায় বিশাল বড় রসগোল্লা বা মাছের আকৃতিতে বানানো মিষ্টির দোকানে বিক্রির হিড়িক পড়েছিল। এবার বিশ্ব ভালোবাসা দিবসে মেলা বসায় হৃদয় আকৃতির মিষ্টি বিক্রি হয় দোকানে দোকানে। সিরায় ডোবানো এসব মিষ্টি প্রতি কেজি ৫০০ থেকে ৬০০ টাকা বিক্রি হয়েছে।
১২ কেজি ওজনের ‘মাছ মিষ্টি’ দেখা গেল আল আমিন মিষ্টি ভান্ডার নামে একটি দোকানে। দোকানি আল আমিন বলেন, ‘১২ কেজি ওজনের মাছ মিষ্টি ছয় হাজার টাকায় বিক্রি করেছি।’
মেলায় চিত্তবিনোদনের জন্য ছিল নাগরদোলা, চরকিসহ নানা আয়োজন। শিশুদের জন্য ছিল মাটি ও কাঠের খেলনা, বাঁশি, টমটম, কাঠ ও মাটির খেলনা, ঝুড়ি, খগরাই, বাতাসা, জিলাপি; ছিল চটপটি, ফুচকা, মৌসুমি ফল, চাটনি, আচার; নারীদের জন্য ছিল কাচের চুড়ি, আলতা-ফিতা, লিপস্টিক-নেলপলিশ, প্রসাধনীসহ নানা পণ্যের দোকান।
স্থানীয় লোকজন জানান, ঐতিহ্যবাহী এই পোড়াদহ মেলাকে ঘিরে গাবতলীর মহিষাবান ইউনিয়ন ছাড়াও আশপাশের গাবতলী সদর, দুর্গাহাটা, বালিয়াদীঘি ও নশিপুর ইউনিয়নের শতাধিক গ্রামে ঘরে ঘরে জমে উঠেছে জামাই উৎসব। মেয়েরা বাবার বাড়ি নাইওর এসেছেন। শ্বশুরবাড়িতে নিমন্ত্রণ পেয়ে মেলা থেকে মাছ কিনে হাজির হয়েছেন জামাইয়েরা। চারদিকে উৎসব আমেজ।
আগামীকাল বৃহস্পতিবার সকালে এখানে বসবে ‘বউমেলা’, যে মেলায় পুরুষ দর্শনার্থী নিষিদ্ধ। শুধু নারীদের জন্য উন্মুক্ত থাকবে বউমেলা। মেলায় নারীদের জন্য প্রসাধনী ছাড়াও রকমারি পণ্যের পসরা বসবে।
গাবতলী মডেল থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা আবুল কালাম আজাদ বলেন, মেলায় আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি সুষ্ঠু ও স্বাভাবিক রাখতে এক দিন আগে থেকেই নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটের নেতৃত্বে পুলিশ তাদের দায়িত্ব পালন করছে।