ডেঙ্গুতে আক্রান্ত বাবা বাঁচতে চান কেবল মেয়ের হত্যার বিচার দেখবেন বলে

শিশু আলিনা ইসলাম আয়াত
সংগৃহীত

হাসপাতালের শয্যায় শুয়ে সোহেল রানা একদৃষ্টে তাকিয়ে ছিলেন ওপরের সিলিংয়ের দিকে। মশারির ভেতর থেকে একবার তাকিয়ে দেখলেন কেবল। হাতে স্যালাইনের ক্যানুলা লাগানো। নীরবতা ভেঙে হঠাৎ বলেন, ‘মরতে আমার ভয় নাই। কিন্তু মেয়ের হত্যার বিচার না দেখে মরতে চাই না।’

চট্টগ্রাম নগরের ইপিজেড থানার বন্দরটিলা এলাকার সোহেল রানার মেয়ে আলিনা ইসলাম আয়াতের প্রথম মৃত্যুবার্ষিকী আজ বুধবার। গত বছরের এই দিনে বাড়ি থেকে নিখোঁজ হয় আলিনা। ২০ লাখ টাকা মুক্তিপণের জন্য অপহরণ করা তাকে। তবে মুক্তিপণ আদায়ের সম্ভাবনা নেই দেখে সেদিনই তাকে হত্যা করেন অপহরণকারী। হত্যার পর ফুটফুটে আলিনাকে কেটে ৬ টুকরা করেন ২০ বছর বয়সী যুবক আবির আলী।

খুনি আবির আলিনাদের বাসায় ভাড়া থাকতেন। পরিবারের সদস্যদের সঙ্গেও আবিরের সখ্য ছিল। এ কারণে আবির এমন কাজ করতে পারেন, তা ধারণাও করতে পারেননি আলিনার মা–বাবা। এমন নৃশংসতার কথা ভুলতেও পারছেন তাঁরা।

ডেঙ্গুতে আক্রান্ত আলিনার বাবা সোহেল রানা এই হতাকাণ্ডের বিচার দেখে যেতে চান। গতকাল সন্ধ্যায় নগরের মা ও শিশু হাসপাতালে

আলিনার বাবা সোহেল রানা ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে বর্তমানে চট্টগ্রাম মা ও শিশু হাসপাতালে চিকিৎসাধীন। গতকাল মঙ্গলবার রাতে তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘একটি দিনের জন্যও মেয়েকে ভুলে থাকতে পারিনি। একমাত্র মেয়ের স্মৃতি নিয়ে এখনো বেঁচে আছি।’

পাঁচ দিন ধরে ডেঙ্গু আক্রান্ত হওয়ার কথা জানিয়ে সোহেল রানা বলেন, ‘আল্লাহর কাছে শুধু প্রার্থনা করছি মেয়ের হত্যার বিচার না দেখার আগে যেন মরণ না হয়। প্লাটিলেট ও রক্তচাপ কমে যাওয়ায় ভয় পেয়ে গেয়েছিলাম। এখন একটাই চাওয়া দ্রুতবিচার ট্রাইব্যুনালে দ্রুত মামলাটি নিষ্পত্তি করা হোক। আর আসামির ফাঁসি আদেশ যাতে হয়।’

গত বছরের ১৫ নভেম্বর নগরের ইপিজেড থানার বন্দরটিলা এলাকার সোহেল রানার মেয়ে আলিনা নিখোঁজ হয়। ইপিজেড থানায় সাধারণ ডায়েরি (জিডি) করা হলেও কোনো কিনারা হয়নি। পরে আলিনার বাবা পিবিআইয়ের কাছে যান। তারা ছায়া তদন্ত শুরু করে। ১০ দিন পর পিবিআই জানায়, ৫ বছরের শিশু আলিনাকে হত্যা করে ৬ টুকরা করে ফেলে দেওয়া হয়েছে। মুক্তিপণ আদায়ের জন্য আলিনাকে অপহরণ করেছিলেন তাদের বাসার ভাড়াটে আবির। আবিরের বাবা ভ্যানচালক আজহারুল ইসলাম। তাঁরা আলিনাদের বাসায় ভাড়া থাকতেন।

বাবার সঙ্গে আলিনা। এখন এই ছবি কেবলই স্মৃতি

২৫ নভেম্বর আবিরকে পিবিআই গ্রেপ্তারের পর তিনি হত্যার কথা স্বীকার করে আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দেন। ১১ মাস তদন্ত শেষে গত ১০ অক্টোবর পিবিআই চট্টগ্রাম মেট্রো পরিদর্শক মনোজ দে আদালতে অভিযোগপত্র জমা দেন। এতে মো. আবির ও তাঁর বন্ধু ১৭ বছর বয়সী এক কিশোরকে (কিশোর বলে নাম উল্লেখ করা হলো না) আসামি করা হয়। ২৩ নভেম্বর আদালতে এটি গ্রহণের শুনানির জন্য রয়েছে। আসামিদের মধ্যে আবির কারাগারে।

পিবিআইয়ের দেওয়া অভিযোগপত্রে বলা হয়, জবানবন্দিতে আবির ভারতীয় সিরিয়াল দেখে এমন পরিকল্পনা করার কথা জানিয়েছেন। আবির পিবিআইকে বলেন, শিশু আলিনাকে হত্যার পর আবির লাশ তাঁদের ভাড়া বাসায় লুকিয়ে রেখেছিলেন। এরপর নিজেই আলিনার মা-বাবার সঙ্গে মিলে আলিনাকে খুঁজতে থাকেন। এর আগেও তিনি কয়েকবার আলিনাকে অপহরণের চেষ্টা করে ব্যর্থ হন। বাসার আশপাশে লোকজন থাকায় কিছু করতে পারেননি। হঠাৎ বড়লোক হওয়ার ইচ্ছা জাগে আবির আলীর। এ জন্য অপরাধবিষয়ক ভারতীয় সিরিয়াল ‘ক্রাইম প্যাট্রলে’ আসক্ত আবির শিশু আলিনাকে অপহরণের পর ২০ লাখ টাকা মুক্তিপণ আদায়ের পরিকল্পনা করেন।

আলিনার খুনি আবির আলী

পরিকল্পনা অনুযায়ী আলিনাকে অপহরণও করেন আবির। কিন্তু মুক্তিপণ চাইতে গিয়ে বাঁধে বিপত্তি। যে সিম ব্যবহার করে আবির আলিনার বাবাকে ফোন করতে চেয়েছিলেন, সেটি ব্লক করা ছিল। পরিচিত নম্বর থেকে ফোন করলে পুলিশের হাতে ধরা পড়বেন এমন ভয় ছিল তাঁর। তাই মুক্তিপণ আদায়ের পরিকল্পনা ভেস্তে যেতেই শ্বাসরোধে হত্যার পর বস্তায় ভরে শিশুটির লাশ ভ্যানে নিয়ে যান আরেক বাসায়। পরে সেখানে কেটে ছয় টুকরা করে কিছু সাগরে আর কিছু খালের পাশে ফেলে দেন তিনি।

ডেঙ্গু থেকে তাড়াতাড়ি যাতে সুস্থ হয়ে উঠতে পারেন, এ জন্য দেশবাসীর কাছে দোয়া চান আলিনার বাবা সোহেল রানা। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, অন্তত মেয়ের হত্যাকারীর ফাঁসি দেখে যাওয়ার পর যেন মরণ হয়। তার আগে যেন মৃত্যু না হয়। আল্লাহর কাছে সেই দোয়া করছেন এখন।

আসামির ফাঁসি দ্রুত কার্যকরের জন্য মামলার বিচার দ্রুত শেষ করার দাবি জানান আলিনার দাদা মনজুর হোসেন। তিনি বলেন, এতে অপরাধীরাও বুঝতে পারবে যে অপরাধ করে পার পাওয়ার কোনো সুযোগ নেই।