মৌসুমের শেষ সময়ে এসে দেশের দক্ষিণ উপকূলে ইলিশ আহরণে বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে বৈরী আবহাওয়া। বঙ্গোপসাগরে সৃষ্ট লঘুচাপের প্রভাবে সাগর ব্যাপক উত্তাল থাকায় বরিশালসহ দক্ষিণের জেলেরা শূন্য হাতে বন্দরগুলোতে ফিরেছেন। মৌসুম শেষের দিকে এসে বৈরী আবহাওয়ার কারণে ইলিশ ধরতে না পেরে হতাশ জেলেরা।
সাগর থেকে ফেরা জেলেরা বলছেন, গতকাল মঙ্গলবার রাতেই ধীরে ধীরে উত্তাল হতে শুরু করে সাগর। সঙ্গে দমকা ও ঝোড়ো হাওয়া বয়ে যায়। আজ বুধবার সকাল থেকে সাগর ব্যাপক উত্তাল হয়ে যায়। তীব্র ঢেউয়ে টিকতে না পেরে তাঁরা ট্রলার নিয়ে খালি হাতে কিনারে ফিরে আসেন। সকাল থেকে বিকেলের মধ্যে উপকূলে আশ্রয় নেয় কয়েক হাজার ট্রলার।
বরিশাল আবহাওয়া বিভাগ বলছে, পশ্চিম-মধ্য বঙ্গোপসাগর ও তৎসংলগ্ন উত্তর-পশ্চিম বঙ্গোপসাগর এলাকায় লঘুচাপ তৈরি হওয়ায় দেশের চার সমুদ্রবন্দরে ৩ নম্বর স্থানীয় সতর্কসংকেত জারি করা হয়েছে। একই সঙ্গে নদীবন্দরগুলোতে ১ নম্বর স্থানীয় সতর্কসংকেত জারি করা হয়েছে। গত শনিবার লঘুচাপ তৈরির আভাস দেওয়ার পর তিন দিনের মাথায় গতকাল সন্ধ্যায় বঙ্গোপসাগরে লঘুচাপ সৃষ্টি হয়।
আবহাওয়া বার্তায় বলা হয়, লঘুচাপের প্রভাবে উত্তর বঙ্গোপসাগর ও উপকূলীয় এলাকায় গভীর সঞ্চরণশীল মেঘমালা তৈরি অব্যাহত আছে। উপকূলীয় এলাকা, উত্তর বঙ্গোপসাগর ও সমুদ্রবন্দরগুলোর ওপর দিয়ে ঝোড়ো হাওয়ার আশঙ্কা আছে। এ জন্য উত্তর বঙ্গোপসাগরে অবস্থানরত মাছ ধরার নৌকা ও ট্রলারকে পরবর্তী নির্দেশ না দেওয়া পর্যন্ত উপকূলের কাছাকাছি সাবধানে চলাচল করতে বলা হয়েছে। এর প্রভাবে উপকূলে ভারী বর্ষণেরও আশঙ্কা আছে।
এদিকে বৈরী আবহাওয়ার কারণে গতকাল রাত থেকেই বঙ্গোপসাগর ধীরে ধীরে উত্তাল হয়ে ওঠে। আজ সকালে তীব্র হয়। এতে সাগরে ইলিশ শিকারে যাওয়া ট্রলারগুলো খালি হাতে উপকূলের বন্দরের মৎস্যঘাটে ফেরে। এমনিতেই চলতি মৌসুমে জেলেরা কাঙ্ক্ষিত ইলিশ ধরতে পারেননি। এখন বৈরী আবহাওয়ায় হতাশ হয়েই তাঁদের তীরে ফিরতে হচ্ছে।
দুপুরে দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম মৎস্যবন্দর বরগুনার পাথরঘাটা, পটুয়াখালীর মহিপুরসহ কয়েকটি মৎস্যবন্দরে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, সাগরে ইলিশ শিকারে যাওয়া বেশির ভাগ ট্রলার বৈরী আবহাওয়ার কারণে বন্দরে ফিরেছে। বরগুনা সদরের নলী, তালতলীর সকিনা, পাথরঘাটার বিএফডিসি, চরদুয়ানি, পদ্মা; পটুয়াখালীর কলাপাড়া উপজেলার আলীপুর-মহিপুর মৎস্যবন্দরে ট্রলারগুলো আশ্রয় নিয়েছে। অনেক ট্রলার সুন্দরবনের ভেতরের খালগুলোতেও আশ্রয় নিয়েছে বলে জানা গেছে।
জেলেরা জানান, ইলিশ মৌসুমের শুরুতেই সামুদ্রিক মাছ আহরণের ওপর ৬৫ দিনের নিষেধাজ্ঞা ছিল। এরপর দফায় দফায় আবহাওয়া বৈরী থাকায় আশানুরূপ ইলিশের দেখা পাননি জেলেরা। আগামী ১৩ অক্টোবর ইলিশের প্রজনন মৌসুম শুরু হবে। এ সময়ে মা ইলিশ রক্ষায় শুরু হবে ২২ দিনের নিষেধাজ্ঞা। এ সময়ে সাগর-নদীতে সব ধরনের মাছ শিকার বন্ধ থাকবে। নিষেধাজ্ঞা শেষ হওয়ার মধ্য দিয়ে এবার ইলিশের মৌসুম শেষ হবে। এরপর নভেম্বর থেকে ৮ মাসের জাটকা ধরার নিষেধাজ্ঞা শুরু হবে। ফলে আবার কবে সাগরে নামতে পারবেন কিংবা আদৌ নামতে পারবেন কি না, সে ব্যাপারে অনিশ্চয়তায় জেলেরা।
মহিপুর মৎস্যবন্দরের আড়তদার ফজলু গাজী প্রথম আলোকে বলেন, এবার ইলিশ মৌসুমে ব্যবসা খুবই মন্দা। কাঙ্ক্ষিত ইলিশ মেলেনি। তাঁদের অবস্থা শোচনীয়। মৌসুমের শেষ সময়ে এখন কিছু মাছ পাওয়ার আশা করেছিলেন। তাতে বাগড়া দিয়েছে বৈরী আবহাওয়া। এখন কী হবে, বুঝতে পারছেন না। তিনি বলেন, কখনো নিম্নচাপ, কখনো লঘুচাপ—সব মিলিয়ে বড় রকমের ক্ষতির মধ্যে আছেন ট্রলারমালিক, লগ্নিকারী ব্যবসায়ী ও কয়েক লাখ জেলে।
দুপুরে দেশের পাথরঘাটা বিএফডিসি মৎস্য অবতরণ কেন্দ্রে গিয়ে দেখা যায়, বৈরী আবহাওয়ায় সাগরে টিকতে না পেরে অসংখ্য ট্রলার ঘাটে নোঙর করেছে। কয়েকটি ট্রলারকে ফিরে আসতে দেখা গেল। আজ বন্দরে ইলিশ এসেছে খুবই সামান্য।
ফিরে আসা ট্রলারের মাঝি জাফর হাওলাদার বলেন, প্রায় আড়াই লাখ টাকা ব্যয় করে দুই দিন আগে সাগরে গিয়েছিলেন। আশায় ছিলেন, মৌসুমের শেষ সময়ে ভালো ইলিশ ধরা পড়বে। কিন্তু গতকাল রাত থেকেই সাগর উত্তাল হয়। এরপর বাড়তে থাকলে টিকতে না পেরে সামান্য ইলিশ নিয়ে কিনারে রওনা দেন। তিনি বলেন, ‘আইজ ভোরে সাগর এত উত্তাল যে আমরা তরাইতে পারছিলাম না। বাধ্য অইয়্যা কিনারে আইছি। যে মাছ পাইছি হ্যাতে ৫০ হাজার টাকাও বিক্রি অইবে না। ক্যামনে যে মোরা বাঁচমু, কইতে পারি না।’
বরিশালে আজ সকাল থেকে বৃষ্টির পরিমাণ বেড়েছে। গতকাল সকাল ছয়টা থেকে সন্ধ্যা ছয়টা পর্যন্ত বরিশালে ৮ মিলিমিটার বৃষ্টি হলেও আজ সকাল ছয়টা থেকে বিকেল সাড়ে ৫টা পর্যন্ত ২৫ দশমিক ২ মিলিমিটার বৃষ্টি হয়েছে।
বরিশাল আবহাওয়া কার্যালয়ের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা বশির আহমেদ প্রথম আলোকে বলেন, লঘুচাপের প্রভাবে ভারী বৃষ্টি অব্যাহত থাকতে পারে।