গাজীপুরের কোনাবাড়ীতে বিক্ষোভরত পোশাকশ্রমিকদের সঙ্গে পুলিশের সংঘর্ষে নিহত পোশাক শ্রমিক মোসা. আঞ্জুয়ারা খাতুনের (৩০) লাশ সিরাজগঞ্জের কাজীপুরে দাফন করা হয়েছে। গতকাল বুধবার দিবাগত রাত তিনটার দিকে উপজেলার চরগিরিশ ইউনিয়নের চরগিরিশ গ্রামে দাদাশ্বশুরবাড়ির আঙিনায় তাঁর লাশ দাফন করা হয়।
এর আগে রাত দুইটার দিকে অ্যাম্বুলেন্সে করে আঞ্জুয়ারার লাশ জামালপুরের সরিষাবাড়ী হয়ে সিরাজগঞ্জের কাজীপুর উপজেলার চরগিরিশ ইউনিয়নের সালাল গ্রামে তাঁর স্বামীর বাড়িতে এসে পৌঁছায়। এরপর দ্রুত লাশটি দাফন করা হয়।
আঞ্জুয়ারার এমন মৃত্যুতে কিছুতেই থামছে না তাঁর স্বজনদের আহাজারি। খবর পেয়ে রাতেই প্রতিবেশীরা আঞ্জুয়ারাকে শেষবারের মতো একনজর দেখতে ছুটে আসেন। তাঁর স্বামী জামাল মিয়ার খালাতো ভাই সুলতান হোসেন বলেন, ‘এই দুর্ঘটনায় পর থেকে প্রতিটি মুহূর্তে আমি আঞ্জুয়ারার লাশের পাশে ছিলাম। আঞ্জুয়ারার লাশটি গ্রামের বাড়িতে আনার পর পুলিশের পক্ষ থেকে দ্রুত দাফনের জন্য চাপ দেওয়া হচ্ছিল।’
আঞ্জুয়ারা সিরাজগঞ্জের কাজীপুর উপজেলার চরগিরিশ ইউনিয়নের চর নাটিপাড়া গ্রামের মাজেদা খাতুন ও মৃত মন্টু মিয়ার মেয়ে। চার ভাইবোনের মধ্যে আঞ্জুয়ারা ছিলেন দ্বিতীয়। ২০১৪ সালের ওই একই ইউনিয়নের সালাল গ্রামের জামাল মিয়ার সঙ্গে তাঁর বিয়ে হয়। তাঁদের ঘরে আরিফ নামের সাত বছরের একটি ছেলে ও জয়া নামের ছয় বছর বয়সী একটি মেয়ে রয়েছে। তারা দুজনই স্থানীয় চরগিরিশ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে দ্বিতীয় শ্রেণিতে পড়ে। গাজীপুরের কোনাবাড়ীর ইসলাম গার্মেন্টসে সেলাই মেশিন অপারেটর হিসেবে কাজ করতেন আঞ্জুয়ারা।
আজ দুপুরে শ্বশুরবাড়িতে গিয়ে দেখা যায়, আঞ্জুয়ারার মা, শাশুড়ি ও স্বজনেরা বাক্রুদ্ধ। কেউ কেউ মাঝেমধ্যেই আহাজারি করছেন। শাশুড়ি নূরজাহান বেগম কান্নাজড়িত কণ্ঠে প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমার বউমা আছিল আমার সন্তানের মতন। প্রতিদিনই মোবাইল কইরা আমি খাইছি কি না, কী করতেছি—সে সব খবর নিছে। সবশেষ মঙ্গলবার রাইতে আমাক মোবাইল কইরা কইছে, “মা, আমি শুক্কুরবারে বাড়িত যামু। আমার খাঁটি গরুর দুধ, চাইলের খুদ ও চাইলের গুঁড়া দরকার। এলা পিট্যা বানামু, মা।” আমি এসব ব্যবস্তা কইরা রাকছি।’
নূরজাহান বেগম আরও বলেন, ‘ছোট ছোট দুইডো মাসুম বাচ্চা এহুন এতিম। ওইলো, আমরা কিবা কইরা তাগোরে মায়ের দুঃখ দূর করমু? কিসের নিগা ছোট ছোট পোলাপান মাও হারাইল? আমরা এই বাচ্চাগরে কান্দাকাটি ক্যামনে থামামু?’
আঞ্জুয়ারার শ্বশুর শাহ আলম বলেন, ‘আমার বউমা ফোন কইরা প্রতিদিনই কইছে, “আব্বা, এই বয়সে বেশি কাটাখাটি কইরেন না। শরীল খারাপ ওইব। আপনেরা বালো থাইকলেই আমরা বালো থাকমু।” এই কতা আর কোনো দিন কেউ কইব না।’
চরগিরিশ ইউনিয়ন পরিষদের ১ নম্বর ওয়ার্ডের সদস্য আল আমিন বলেন, মায়ের মৃত্যুতে ফুটফুটে দুটি সন্তানের ভবিষ্যৎ এখন অনেকটাই অনিশ্চিত। কারণ, মা বেঁচে থেকে দূরে থাকলেও সন্তানের একটা শক্তি থাকে। তাই সমাজের সচেতন মানুষকে তাঁদের পাশে দাঁড়াতে হবে।
পোশাকশ্রমিকদের নিম্নতম মজুরি ২৩ হাজার টাকা করার দাবিতে দীর্ঘদিন ধরে গাজীপুরের বিভিন্ন এলাকায় পোশাক কারখানার শ্রমিকেরা বিক্ষোভ করে আসছিলেন। গত মঙ্গলবার মালিক ও শ্রমিক প্রতিনিধিদের সঙ্গে বৈঠকের পর ন্যূনতম মজুরি সাড়ে ১২ হাজার টাকা নির্ধারণ করে সরকার। কিন্তু এতে শ্রমিকেরা সন্তুষ্ট নন। তাই গতকাল সকাল সাড়ে নয়টার পর থেকে গাজীপুরের কোনাবাড়ী, জরুন, বাইমাইলসহ বিভিন্ন এলাকায় তাঁরা বিক্ষোভ শুরু করেন। একপর্যায়ে শ্রমিকেরা বিভিন্ন সড়ক অবরোধ করে কাঠ ও টায়ারে আগুন ধরিয়ে দেন। এ ছাড়া বিভিন্ন যানবাহন ভাঙচুরের চেষ্টা করেন।
পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে পুলিশ কাঁদানে গ্যাসের শেল, রাবার বুলেট ও সাউন্ড গ্রেনেড নিক্ষেপ করে। কোনাবাড়ী এলাকায় বিক্ষোভরত শ্রমিকদের সঙ্গে পুলিশের সংঘর্ষে আঞ্জুয়ারা আহত হন। গুরুতর আহত অবস্থায় ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেওয়ার পথে মারা যান তিনি।
আঞ্জুয়ারার স্বামী জামাল মিয়া বলেন, ‘গত মাসে দুর্গাপূজার ছুটিতে সন্তানদের আমাদের কাছে নিয়ে গিয়েছিলাম। ছুটি শেষ হলেও শুক্রবার মায়ের সঙ্গে বাড়িতে আসার কথা ছিল।’