কারাম উৎসবে ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর সাংস্কৃতিক দলের গান ও নাচ পরিবেশনা। বুধবার বিকেলে নওগাঁর মহাদেবপুর উপজেলার দেওয়ানপুর আদিবাসী সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় মাঠে
কারাম উৎসবে ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর সাংস্কৃতিক দলের গান ও নাচ পরিবেশনা। বুধবার বিকেলে নওগাঁর মহাদেবপুর উপজেলার দেওয়ানপুর আদিবাসী সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় মাঠে

নওগাঁয় কারাম উৎসবে মাতোয়ারা ক্ষুদ্র জাতিসত্তার মানুষ

নওগাঁয় ক্ষুদ্র জাতিসত্তার কারাম বৃক্ষের (খিল কদম) ডালপূজাকে কেন্দ্র করে কারাম উৎসব হয়েছে। উৎসব উপলক্ষে আজ বুধবার বিকেলে মহাদেবপুর উপজেলার দেওয়ানপুর আদিবাসী সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় মাঠে ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী সমাবেশ ও সাংস্কৃতিক মিলনমেলার আয়োজন করা হয়।

অনুষ্ঠানে ক্ষুদ্র জাতিসত্তার তরুণ-তরুণীরা রঙিন সাজে সজ্জিত হয়ে বাদ্যের তালে নেচেগেয়ে উদ্‌যাপন করেন কারাম উৎসব।

বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা ইনিশিয়েটিভ ফর সোশ্যাল চেঞ্জ (আইএসসি) ও প্রথম আলোর সহযোগিতায় কারাম পূজাকে ঘিরে মহাদেবপুরের দেওয়ানপুরে সাংস্কৃতিক মিলনমেলা ও ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী সমাবেশের আয়োজন করে জাতীয় আদিবাসী পরিষদ। অনুষ্ঠানে ক্ষুদ্র জাতিসত্তার তরুণ-তরুণীদের নাচ ও গান উপভোগ করেন হাজারো মানুষ। মিলনমেলায় পরিণত হয় দেওয়ানপুর স্কুল মাঠ।

সমতলের ক্ষুদ্র জাতিসত্তার প্রধান উৎসব কারাম। ভাদ্র মাসের পূর্ণিমায় এ উৎসবের আয়োজন করে তারা। ক্ষুদ্র জাতিসত্তার–অধ্যুষিত গ্রামে গ্রামে কারাম বৃক্ষের ডালপূজাকে কেন্দ্র করে এ উৎসবের আয়োজন করা হয়। তাদের বিশ্বাস, এটি অভাবমুক্তি ও সৌভাগ্য লাভের উৎসব। ধর্মীয় বিভিন্ন আচার-অনুষ্ঠান পালনের মাধ্যমে সৃষ্টিকর্তার কাছে মনের কামনা-বাসনা পূরণের লক্ষ্যে প্রার্থনা করে থাকে ক্ষুদ্র জাতিসত্তার মানুষ। এ ছাড়া নিজেদের ভাষা ও সংস্কৃতি আন্দোলনের অংশ হিসেবে ১৯৯৬ সাল থেকে জাতীয় আদিবাসী পরিষদ এ পূজাকে ঘিরে নওগাঁসহ সমতলের বিভিন্ন অঞ্চলে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান ও আদিবাসী সম্মেলনের আয়োজন করে আসছে। এ বছর মহাদেবপুর উপজেলার দেওয়ানপুর আদিবাসী সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় মাঠে ২৯তম কারাম উৎসবের আয়োজন করে।

দুই দিনব্যাপী উৎসবের প্রথম দিন গতকাল মঙ্গলবার রাতে উপজেলার হাতুড় ইউনিয়নের দেওয়ানপুর বগাপাড়া, বাঁশপাড়া, পাহানপাড়া, কারামগোছা ও গোবরাপাড়া এবং এর আশপাশের গ্রামে ক্ষুদ্র জাতিসত্তার নর-নারীরা বিভিন্ন ধর্মীয় আচার–অনুষ্ঠান পালন করেন। মঙ্গলবার দিনভর উপোস ছিলেন তাঁরা। সন্ধ্যার আগে কারাম বা খিল কদমের ডাল কেটে এনে পূজার বেদিতে বসানোর কাজটি করেন যুবকেরা। আর সন্ধ্যার পর কারামগাছের ডাল বেদিতে বসানোর পর শুরু হয় পূজা। এরপর রাতভর মূল আচার–অনুষ্ঠানে অংশ নেন নারীরা। তাঁরা দিয়াবাতি, জাওয়া ডালি (অঙ্কুরোদগম শস্যবীজের ডালি), লাল মোরগ, ফলমূলের ডালা বা থালা সৃষ্টিকর্তার উদ্দেশে পূজার বেদিতে উৎসর্গ করেন। সেখানে পূজা পর্ব পরিচালনা করেন পুরোহিত মতিলাল পাহান।

রাত একটু গভীর হলে শিশু, কিশোর-কিশোরীসহ বিভিন্ন বয়সী নর-নারী গ্রামের পূজাস্থানে জড়ো হন। সেখানে পুরোহিত নবীন পাহান নতুন প্রজন্মের কাছে কিচ্ছা আকারে কার্মা ও ধার্মা—দুই ভাইয়ের কাহিনি তুলে ধরেন। কিচ্ছা বলা শেষ হলে হলে উপোস থাকা নারীরা পরস্পরকে খাবারের আমন্ত্রণ জানিয়ে উপোস ভাঙেন। পরে বেদিতে পুঁতে রাখা কারাম ডালের চারপাশ ঘুরে ঘুরে ঢাকঢোল ও মাদলের বাজনার তালে তালে নৃত্য পরিবেশন করেন নারীরা। রাতের পূজা পর্ব শেষে আজ বুধবার সকালে সবাই মিলে বিভিন্ন আচার শেষে গীত গাইতে গাইতে কারাম ডালকে গ্রামের পাশ দিয়ে বইয়ে যাওয়া আত্রাই নদে বিসর্জন দেন।

পূজা পর্ব শেষে বিকেলে দেওয়ানপুর আদিবাসী সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় মাঠে সাংস্কৃতিক মিলনমেলা ও ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী সমাবেশের আয়োজন করা হয়। এ মিলনমেলায় নওগাঁর মহাদেবপুর, পত্নীতলা, নিয়ামতপুর উপজেলা ছাড়াও জেলার অন্যান্য উপজেলা এবং বাইরের জেলায় বসবাসরত ক্ষুদ্র জাতিসত্তার সাংস্কৃতিক দলগুলো অংশ নেয়। ৩০টি সাংস্কৃতিক দল নিজ নিজ জাতিগোষ্ঠীর ঐতিহ্য তুলে ধরে ঢাকঢোল, মাদল ও করতালের (ঝুমকি) তালে তালে নাচ ও গান পরিবেশন করে। নাচে-গানে ও ঢোল-মাদলের আওয়াজে মাতোয়ারা হয়ে ওঠে দেওয়ানপুর স্কুল মাঠ।

বেলা তিনটায় ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী সমাবেশ ও সাংস্কৃতিক মিলনমেলার উদ্বোধন করেন হাতুড় ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান এনামুল হক। অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা আইএসসির নির্বাহী পরিচালক অনিক আসাদ। অন্যদের মধ্যে বক্তব্য দেন জাতীয় আদিবাসী পরিষদ কেন্দ্রীয় কমিটির সাধারণ সম্পাদক নরেন পাহান, কোষাধ্যক্ষ মার্টিন মুর্মু, জাতীয় আদিবাসী পরিষদ মহাদেবপুর উপজেলা শাখার সভাপতি দিলীপ পাহান প্রমুখ।

বক্তারা বলেন, কারাম মেলার আয়োজন শুধু নিছক বিনোদনের জন্য করা হয় না। ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠান পালন ও বিনোদনের পাশাপাশি ক্ষুদ্র জাতিসত্তার মানুষের ভাষা ও সংস্কৃতি রক্ষার আন্দোলন হিসেবে এ অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। বক্তারা ক্ষুদ্র জাতিসত্তার মানুষের সাংবিধানিক স্বীকৃতিরও দাবি করেন।