কাউসার মিয়া
কাউসার মিয়া

‘বিচার কার কাছে চাইবাম, আল্লাহর কাছে দিয়া রাখছি’

বৃদ্ধ মা–বাবার একমাত্র অবলম্বন ছিলেন মো. কাউসার মিয়া (২২)। প্রাইভেট কার চালিয়ে সংসার চালাতেন। বিয়ের প্রস্তুতিও চলছিল। এ জন্য বাড়িতে নতুন ঘর নির্মাণের কাজ চলছিল। এখন সব থেমে গেছে। ছাত্র-জনতার আন্দোলনে ৫ আগস্ট শেখ হাসিনা দেশ ছাড়ার খবরে আনন্দ মিছিলে অংশ নিয়ে গুলিবিদ্ধ হন কাউসার। রাস্তায় পড়ে ছিল নিথর দেহ।

কাউসার মিয়া ময়মনসিংহের হালুয়াঘাট উপজেলার পূর্ব নড়াইল ইউনিয়নের কাওয়ালিজান গ্রামের মো. সাইদুল ইসলাম ফরাজির (৬০) ছেলে। মায়ের নাম বিলকিছ বেগম (৫২)। এক ভাই ও এক বোনের মধ্যে ছোট ছিলেন কাউসার। প্রাইভেট কার চালানোর আয় দিয়ে মা–বাবার দেখাশোনা করতেন। অভাবের সঙ্গে যুদ্ধ করে দশম শ্রেণি পর্যন্ত পড়ালেখা করেছিলেন। ২০১৭ সালে এসএসসি পরীক্ষায় এক বিষয়ে অকৃতকার্য হয়ে পড়ালেখা ছেড়ে দেন।

স্বজনেরা জানান, গাজীপুরের শ্রীপুর উপজেলার ওয়াপদা মোড় এলাকায় মেসে থেকে এক ব্যক্তির প্রাইভেট কার চালাতেন কাউসার। মাসে ২০ হাজার টাকা বেতন পেতেন। ৫ আগস্ট গুলিবিদ্ধ হন। মাওনা ওয়াপদা মোড় এলাকায় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ছোড়া দুটি গুলি বুকে ও অপর দুটি গুলি ডান হাতে লাগে। স্থানীয় লোকজন উদ্ধার করে হাসপাতালে নিলে চিকিৎসক মৃত ঘোষণা করেন। কাউসারের সঙ্গে থাকা মুঠোফোন থেকে খবর পেয়ে স্বজনেরা হাসপাতাল থেকে লাশ গ্রামের বাড়িতে নিয়ে যান। ৬ আগস্ট সকালে ময়নাতদন্ত ছাড়াই বাড়ির পাশে মসজিদের গোরস্তানে দাফন করা হয়।

কাউসারকে বিয়ে করানোর জন্য আলাপ চলছিল। এ জন্য বেসরকারি সংস্থা (এনজিও) থেকে দুই লাখ টাকা ঋণ তুলে বাড়িতে ঘর তোলার কাজও শুরু করেছিলেন। কাজ অর্ধেক হয়েছে। কিন্তু শেষ করার আগেই আন্দোলনের সময় গুলিতে প্রাণ হারিয়েছেন বলে জানান বড় বোন সাবিনা খাতুন।

৫ আগস্ট বেলা আড়াইটার দিকে মা–বাবার সঙ্গে সর্বশেষ কথা হয় কাউসার মিয়ার। আন্দোলনের কারণে ছেলেকে বাড়িতে চলে আসতে বলেছিলেন মা–বাবা দুজনেই। কিন্তু ছেলে তাঁদের কাছে ফেরে লাশ হয়ে। কাউসারের বাবা সাইদুল ইসলাম ফরাজি বলেন, ‘সেদিন কইছিলাম বাবা সবকিছু তো বন্ধ, তুমি বাড়িত আয়া পড়ো। আমারে কইছিন, তার কিছুই অইতো না। সাবধানে থাহনের লাইগ্যা কইছিলাম। কিন্তু আসরের নামাজের পর ফোন করে একজন খবর দেয়, আমার ছেলে গুলি খাইয়্যা মইর‌্যা গেছে। আমার বিশ্বাস অইতাছিল না। আমি তাদের কইলাম, কিছুক্ষণ আগেই তো আমার ছেলের সঙ্গে কথা হইলো, সে মরতে পারে না।’

পরে মাওনা এলাকায় থাকা কাউসারের মামা ও অন্য আত্মীয়দের পাঠান বাবা। তাঁরা গিয়ে লাশ নিয়ে বাড়িতে আসেন। সাইদুল ইসলাম বলেন, শ্রীপুরের মাওনা ওয়াপদা মোড় এলাকায় গুলিবিদ্ধ হয়ে কাউসার মারা যায়। বাড়িতে ছেলের লাশ আনার পর দেখেন, বুকের দুই পাশে দুটি ও ডান হাতে দুটি গুলি লাগার চিহ্ন। বুকের একটি গুলি বের হয়ে যায়। বাকিগুলো আটকে ছিল। তিনি বলেন, ‘ছেলে হত্যার ঘটনায় কোনো মামলা করছি না। বিচার চাই, কিন্তু আমরা মূর্খ মানুষ। ছেলে মইর‌্যা গেছে, কার নামে মামলা করি। মামলা করলে যদি নিরপরাধ কাউরে ঢুকায়া দেয়, তাইলে খারাপ না এউডা।’

কাউসার মিয়া ছিলেন মা–বাবার একমাত্র অবলম্বন। ছেলে মারা যাওয়ায় কাঁদতে কাঁদতে অসুস্থ হয়ে পড়েছেন মা বিলকিছ বেগম। তিনি বলেন, ‘গন্ডগোলের কারণে বাড়িত আয়া পড়তে কইছিলাম। কার কাছে জানি এক হাজার টাকা পাইব, হেই টাকা লইয়্যা বাড়িত আওনের কথা আছিন। হে (কাউসার) আন্দোলনে যাইব আমি বুঝবার পারি নাই। ছেলে মরলো বিচার কার কাছে চাইবাম আমি। আল্লাহর কাছে বিচার দিয়া রাখছি।’