দুর্যোগের আভাস পেলেই আঁতকে ওঠেন রাঙ্গাবালীর বিচ্ছিন্ন চরের মানুষ

ঘুর্ণিঝড় থেকে রক্ষায় দ্বীপের বাসিন্দাদের নিরাপদে নিয়ে আসছেন স্বেচ্ছাসেবীরা। আজ শনিবার সকালে পটুয়াখালীর দশমিনা উপজেলার চর হাদী এলাকায়
ছবি: সংগৃহীত

‘ঝড়-বাইন্যা আইলেই পোলাপানরে বুকে লইয়া ঝুপড়ি ঘরে কান্নাকাটি করি। পানি বাড়লে বনের গাছ ধইরা থাকা ছাড়া আর কোনো পথ থাকে না। আল্লাহর ওপরে ভরসা কইরা পোলামাইয়া লইয়া এইভাবে থাকতে হয় মোগো।’

কথাগুলো বলছিলেন নার্গিস বেগম (৩৮)। তিনি পটুয়াখালীর উপকূলীয় বিচ্ছিন্ন উপজেলা রাঙ্গাবালীর ছোট বাইশদিয়া ইউনিয়নের বিচ্ছিন্ন দ্বীপ চরনজিরের বাসিন্দা। তিন দিকে নদী ও দক্ষিণে সাগরমোহনায় জেগে ওঠা চরনজিরে ২৫ বছর ধরে বাস করছেন তিনি। তাঁর স্বামী মো. জসীম (৪৫) নদীতে মাছ ধরেন।

নার্গিস বেগম বলেন, সিডরের সময় যখন পানিতে চর তলিয়ে গেছে, তখন স্রোতের টানে ভেসে যায় তাঁর এক বছরের শিশুকন্যা। গাছ ধরে তিনি ও তাঁর স্বামী বেঁচে গেলেও সন্তানকে আর খুঁজে পাননি তিনি। সেই কথা মনে পড়লে এখনো আঁতকে ওঠেন তিনি। এখনো আকাশে কালো মেঘ দেখলেই অজানা আশঙ্কা পেয়ে বসে।

এই গ্রামের আরেক বাসিন্দা হামিরুল ফকির (৫১) ও তাঁর স্ত্রী রাজাবানু (৪৪)। তাদের দুই ছেলে মাসুদ রানা (২৪) ও মাসুম বিল্লাহ (১৮)। নদীতে মাছ ধরে চলে তাদের সংসার। হামরুল জানান, সিডরের সময় পানি বেশি উঠেছিল। পরিবারের সবাইকে নিয়ে নৌকায় গাছের সঙ্গে রশি বেঁধে বেঁচে ছিলেন তাঁরা।

ছোট বাইশদিয়া ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান ও চরনজির এলাকার বাসিন্দা কামাল পাশা বলেন, তাঁদের এই চরে ছয় শতাধিক মানুষ বাস করছেন। বেড়িবাঁধ ও আশ্রয়কেন্দ্র নেই। প্রাকৃতিক দুর্যোগ দেখা দিলে এই চরের মানুষ আতঙ্কে থাকেন। তবে ঘূর্ণিঝড় মোখার প্রভার থেকে রক্ষায় তাঁরা চরবাসীকে নিরাপদে সরিয়ে নেওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছেন।

জনপ্রতিনিধিদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, রাঙ্গাবালী উপজেলার ছয়টি ইউনিয়নের আটটি বিচ্ছিন্ন চরে ঘূর্ণিঝড় আশ্রয়কেন্দ্র নেই। বন্যা নিয়ন্ত্রণ বেড়িবাঁধও নেই। এ কারণে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে বাস করছেন এই ৮টি চরের প্রায় ১৫ হাজার মানুষ। তাই যেকোনো দুর্যোগ ও ঝোড়ো হাওয়া বইতে শুরু করলেই এই চরের বাসিন্দার আঁতকে ওঠেন।

রাঙ্গাবালী উপজেলার সদর ইউনিয়নের বিচ্ছিন্ন দ্বীপ চরকাসেম। দক্ষিণে বঙ্গোপসাগরের মোহনায় বুড়াগৌরাঙ্গ নদে জেগে ওঠা চরকাসেমের বাসিন্দা ছালেহা বেগম (৪৫) বলেন, ২০ বছর ধরে তিনি এই চরে বাস করছেন। তাঁর স্বামী ফিরোজ আকন (৪৯) নদীতে মাছ ধরেন। এক ছেলে ও এক মেয়ে নিয়ে তাঁদের সংসার। ছালেহা বেগম বলেন, অল্প বয়সেই বিয়ে হয়ে এই চরে আসেন তিনি। সিডরের সময় তিনি অন্তঃসত্ত্বা ছিলেন। ওই সময়ে যখন পানিতে চর তলিয়ে গেছে, তখন স্রোতের টানে ভেসে যাচ্ছিলেন। একসময় গাছ আগলে ধরে বেঁচে গিয়েছিলেন। এক দিন পর তিনি তাঁর স্বামীকে খুঁজে পেয়েছিলেন।

ছালেহা বেগম বলেন, ঘূর্ণিঝড় ফণীর সময় উপজেলা প্রশাসন থেকে ট্রলার পাঠিয়ে তাঁদের নিরাপদে নিয়ে আসা হয়েছিল। বিচ্ছিন্ন এই চরগুলোয় বেড়িবাঁধ না থাকা ও ঘূর্ণিঝড় আশ্রয়কেন্দ্র না থাকায় দুর্যোগে নদী পেরিয়ে মূল ভূখণ্ডে আসতে হয় তাঁদের।

রাঙ্গাবালী সদর ইউপির চেয়ারম্যান মামুন খান বলেন, গবাদিপশুর জীবর বাঁচাতে দুই বছর আগে চরকাসেমে একটি মাটির টিলা নির্মাণ করা হয়েছে। এ ছাড়া প্রাকৃতিক দুর্যোগ এলেই উপজেলা প্রশাসনের সহায়তা নিয়ে বিচ্ছিন্ন চরের বাসিন্দাদের নিরাপদের নিয়ে আসা হয়েছে। শুধু চরকাসেমই নয়, এই ইউনিয়নের চার কানকুনি, চরযমুনা ও মাদারবুনিয়া চরের বেড়িবাঁধের বাইরে সহস্রাধিক মানুষ দুর্যোগের ঝুঁকিতে রয়েছেন।

আগুনমুখা নদীর তীরে উপজেলার চালিতাবুনিয়া ইউনিয়ন। এই ইউনিয়নের বেড়িবাঁধ নির্মাণ করা হলেও দুই স্থান সম্পূর্ণ খোলা রয়েছে। ইউপির চেয়ারম্যান মো. জাহিদ হাসান বলেন, জলকপাট করার জন্য খোলা রাখা হয়েছে চালিতাবুনিয়া খাল ও ছালেহিয়া মাদ্রাসার সামনের খালের মুখ। এই অবস্থায় অমাবস্যা-পূর্ণিমার জোয়ার সময় পানিয়ে তলিয়ে যায় অর্ধেকেরও বেশি এলাকা। ঘূর্ণিঝড় মোখার প্রভাবে জলোচ্ছ্বাসে পানির উচ্চতা বাড়বে। তাই ইউনিয়নবাসী চিন্তিত।

উপজেলার চরমোন্তাজ ইউনিয়নের চরআন্ডা এলাকার প্রায় চার কিলোমিটার বন্যা নিয়ন্ত্রণ বেড়িবাঁধ ঝুঁকিতে রয়েছে। স্বাভাবিক জোয়ারে চেয়ে একটু বেশি পানি হলেই ওই এলাকার ভাঙা ও সংস্কারহীন বাঁধ দিয়ে পানি প্রবেশের শঙ্কা করা হচ্ছে। চরআন্ডা গ্রামের বাসিন্দা মো. বাচ্চু বলেন, চরআন্ডা ওয়ার্ডটির চারদিকেই নদী ও সমুদ্র। পূর্ব এবং পশ্চিম পাশে¦বেড়িবাঁধ ভাঙা। ফলে, খুব দ্রুত পানি লোকালয়ে প্রবেশ করে। এ ছাড়া চরআন্ডায় প্রায় চার হাজার লোকজনের জন্য একটি মাত্র ঘূর্ণিঝড় আশ্রয়কেন্দ্র, যা পর্যাপ্ত নয়। দুর্যোগ এলে সব সময় চিন্তায় থাকতে হয়।

কলাপাড়া পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী খালেদ বিন অলীদ প্রথম আলোকে বলেন, ‘রাঙ্গাবালীর চরআন্ডার চার কিলোমিটারের মতো বেড়িবাঁধ ঝুঁকিতে রয়েছে। চালিতাবুনিয়ায় বাঁধ নির্মাণ সম্পন্ন হলেও জলকপাট নির্মাণ শেষ হয়নি। এ ছাড়া বেশ কয়েকটি জেগে ওঠা চরে বসতি রয়েছে। সেগুলো আমরা এখনো বেড়িবাঁধের আওতায় আনতে পারিনি।’

রাঙ্গাবালী উপজেলা প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তা মো. হ‌ুমায়ূন কবির বলেন, আসলে সরকারি কিংবা বেসরকারি কোনো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান না থাকায় চরগুলোয় আশ্রয়কেন্দ্র নির্মাণে অনুমোদন পাওয়া যাচ্ছে না। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান অনুমোদিত হলে সেখানে প্রস্তাব পাঠিয়ে ঘূর্ণিঝড় আশ্রয়কেন্দ্র নির্মাণের উদ্যোগ নেওয়া যেত।

সার্বিক বিষয়ে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মহিউদ্দিন আল হেলাল বলেন, ঝড়-বন্যায় চরের মানুষের জীবন ঝুঁকিতে থাকে। উপজেলার অনেক এলাকায়ই এখনো আশ্রয়কেন্দ্র নির্মিত হয়নি। ঘূর্ণিঝড় মোখা মোকাবিলায় জরুরি সভা করে আগাম প্রস্তুতি নেওয়া হয়েছে। ঘূর্ণিঝড় আশ্রয়কেন্দ্রগুলো প্রস্তুত রাখার জন্য বলা হয়েছে। যদি সতর্কসংকেত বাড়ে, সে ক্ষেত্রে মাইকিং করে প্রচারণার মাধ্যমে সচেতনতা বাড়ানো হবে এবং মানুষকে আশ্রয়কেন্দ্রে নেওয়া হবে।