‘আমি দৃষ্টিশক্তি প্রায় হারিয়েছি, বাবা হারিয়েছেন উপার্জনের মাধ্যম। এখন অনুদান নয়, আমি চাই উন্নত চিকিৎসা,’ কান্নাজড়িত কণ্ঠে কথাগুলো বলছিলেন বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে চোখে গুলিবিদ্ধ মেহেদী হাসান ওরফে শুভ (১৮)।
মেহেদী হাসান কুমিল্লা পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটের শিক্ষার্থী। ১৭ জুলাই কোটা সংস্কারের দাবিতে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের কুমিল্লার কোটবাড়ী এলাকায় পুলিশের গুলিতে আহত হন তিনি। ছররা গুলি লাগে তাঁর বুক, চোখ, মাথাসহ শরীরের বিভিন্ন স্থানে।
মেহেদীর বাবা কুমিল্লার লালমাই উপজেলার বেলঘর উত্তর ইউনিয়নের পালপাড়া গ্রামের বাসিন্দা লিটন মিয়া ব্যাটারিচালিত অটোরিকশাচালক। চার সন্তানের মধ্যে দ্বিতীয় মেহেদী হাসান ছোটবেলা থেকেই মেধাবী। এসএসসিতেও জিপিএ-৫ পেয়েছিলেন। বাড়িতে একটি দোচালা টিনের ঘর ছাড়া তেমন কিছুই নেই ব্যাটারিচারিত রিকশাচালক লিটনের। ছেলে মেহেদীকে নিয়ে ছিল বড় স্বপ্ন।
১৭ জুলাই দুপুরের পর ছেলে গুলিবিদ্ধ শুনেই সঙ্গে সঙ্গে নিজের উপার্জনের একমাত্র অবলম্বন ব্যাটারিচালিত রিকশাটি ৪৫ হাজার টাকায় বিক্রি করে দেন লিটন। সেই টাকায় হাসপাতালে হাসপাতালে ঘুরলেও মেহেদীকে সুস্থ করতে পারেননি। সম্ভব হয়নি ছেলের শরীর থেকে ছররা গুলি বের করা। এরই মধ্যে মেহেদীর চোখে পাঁচটি অস্ত্রোপচার করা হয়েছে। উন্নত চিকিৎসার অভাবে মেহেদী এখন দৃষ্টিহীন হওয়ার পথে।
বাবা লিটন মিয়ার ভাষ্যমতে, রাজধানীর গ্রিন রোডের ভিশন আই হাসপাতালের চিকিৎসকেরা অস্ত্রোপচার শেষে তাঁকে বলেছেন, ছররা গুলিতে মেহেদীর ডান চোখের প্রায় ৯০ শতাংশ ও বাঁ চোখের অন্তত ৫০ শতাংশ অকেজো হয়ে পড়েছে। উন্নত চিকিৎসা নেওয়া সম্ভব হলে দৃষ্টিশক্তি কিছুটা ফিরে পেতে পারেন মেহেদী। তবে তাঁকে সারা জীবনই ছররা গুলি শরীরে বহন করতে হবে। ছেলের চিকিৎসার ব্যয় আর পরিবারের ভরণপোষণ জোগাতে অনেকটাই দিশাহারা তিনি।মেহেদী কুমিল্লা পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটের সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের চতুর্থ সেমিস্টারের শিক্ষার্থী। তিনি অনুদান চান না। চান উন্নত চিকিৎসা আর বেঁচে থাকার অবলম্বন হিসেবে যেকোনো কর্মসংস্থান।
মঙ্গলবার বিকেলে পালপাড়া গ্রামের নিজ বাড়িতে কথা হয় মেহেদী হাসানের সঙ্গে। মেহেদী বলেন, ‘১৭ জুলাই শিক্ষার্থীদের সঙ্গে আমিও মহাসড়ক অবরোধ করেছিলাম। কোটবাড়ী এলাকায় পদচারী–সেতুর পূর্ব পাশে অবস্থান করছিলাম। হঠাৎ পুলিশের গুলি লাগে আমার বুকে, রক্ত বের হচ্ছে দেখে আমি মহাসড়কে বসে পড়ি। পুলিশ আবারও গুলি করে। এবার আমার চোখ, মুখ ও মাথায় গুলি লাগে। এতে আমি মাটিতে লুটিয়ে পড়লে আন্দোলনরত শিক্ষার্থীরা আমাকে কুমিল্লা শহরের দুটি বেসরকারি হাসপাতালে নেন। কিন্তু ঝামেলা মনে করে কেউ রাখেননি, পরে শিক্ষার্থীরা আমাকে কুমিল্লা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে ভর্তি করেন। ছাত্রলীগের হামলা ও গ্রেপ্তারের আতঙ্কে আমাকে ভর্তির ১২ ঘণ্টার মধ্যেই হাসপাতাল ছাড়তে হয়। এরপর বাবা আমাকে ঢাকার একটি বেসরকারি হাসপাতালে ভর্তি করেন। সেখানে আমার চোখের পাঁচটি অপারেশন হয়েছে। আমি এখন ওই হাসপাতালের একজন চিকিৎসকের তত্ত্বাবধানে বাড়িতে আছি।’
অনেকটা আবেগাপ্লুত মেহেদী এখনো জানেন না সামনে তাঁর চিকিৎসার ব্যয় কীভাবে চলবে। মেহেদী বলেন, ‘আমাদের পরিবারের একমাত্র আয়ের উৎস ছিল বাবার অটোরিকশাটি। সেটিও আমার চিকিৎসার জন্য প্রথম দিনেই বিক্রি করে দিয়েছেন বাবা। এর পর থেকে বাবার আয় বন্ধ। আমার চিকিৎসার জন্য ছোটাছুটি করতে গিয়ে বাবা অন্য কিছু করতেও পারছেন না। তবে আহত হওয়ার পরপরই আন্দোলনে অংশ নেওয়া কিছু ব্যক্তি আমাকে আর্থিক সহায়তা করেছেন। জামায়াতে ইসলামীর পক্ষ থেকেও চিকিৎসা বাবদ কিছু আর্থিক সহায়তা পেয়েছি। আন্দোলনের কারণে আমি দৃষ্টিশক্তি প্রায় হারিয়েছি। বাবা হারিয়েছেন উপার্জনের মাধ্যম। আমার পরিবারের হাল ধরার স্বপ্ন শেষ। চোখসহ পুরো শরীরে শতাধিক ছররা গুলি নিয়ে প্রতিনিয়ত যন্ত্রণার মধ্য দিয়ে দিন কাটাচ্ছি। তবে অন্তর্বর্তী সরকারের হয়ে কেউ কোনো সহযোগিতা করেননি। তবে সরকারের কাছে আমি কোনো অনুদানও চাই না। আমি চাই, এই সরকার আমিসহ সব আহত শিক্ষার্থীর উন্নত চিকিৎসার ব্যবস্থা করুক। আমাদের স্বাভাবিক জীবনে ফিরতে সহায়তা করুক। আহত ব্যক্তিদের সুস্থতা সাপেক্ষে কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করা হোক। আর আমার যেন সেমিস্টার ড্রপ না হয়, লেখাপড়াটা আমি শেষ করতে চাই।’
মেহেদীর বাবা লিটন মিয়া বলেন, ‘জুলাই মাসের ১৭ তারিখ আমার পোলা গুলিবিদ্ধ হইছে শুনি লগে লগে ব্যাটারিচালিত রিকশাটা বেচি দিসি। কিন্তু এই টাকা দিয়া পোলাডার চিকিৎসার কিছুই হয় নাই। এই সরকারের কাছে বেশি কিছু চাই না, আমার পোলাগার ভালা চিকিৎসা, শিক্ষা আর কর্মের একটা ব্যবস্থা চাই। আমি অটো চালাই যা পাইতাম, তা দিয়ে ঘরের খরচ ও পোলাপাইনের লেখাপড়ার খরচ চালাইতাম। এহন যদি কোনোভাবে একটা ব্যাটারিচালিত রিকশা কিনতে পাইরতাম, তাইলে পরিবার লইয়া চইলতে পাইরতাম।’