সৈকতের বালুতে বিশাল একটি কচ্ছপের ভাস্কর্য। মাছ ধরার জালে জড়ানো কচ্ছপের শরীর। মুখ ও হাত-পায়ে আঘাতের চিহ্ন। আশপাশে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে প্লাস্টিকের বোতল। পাশে দাঁড়িয়ে বিদেশি কয়েকজন তরুণ-তরুণী মুঠোফোনে কচ্ছপের ছবি তুলছেন। ধারণ করছেন ভিডিও চিত্র।
কচ্ছপের পাশে ছোট একটি ঘরে চেয়ার-টেবিলে বসে গান গাইছেন দেশি-বিদেশিরা। একটি মঞ্চের সামনে খোলা মাঠে বসানো দুই শতাধিক চেয়ার-টেবিল। তাতে বসা যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা, অস্ট্রেলিয়া, তুরস্ক, মালয়েশিয়া, সুইজারল্যান্ড, ভারতসহ অন্তত ২০টি দেশের দেড় শতাধিক বিদেশি নারী-পুরুষ। শীতের রাতে আলো-আঁধারি পরিবেশে গান, একে অপরের সঙ্গে আড্ডা-আলোচনায় মুখর ছিল কয়েক ঘণ্টা। উত্তরের হাওয়ায় ভেসে আসা সমুদ্র গর্জনের সঙ্গে চলে সামুদ্রিক মাছের রসনাবিলাস।
গতকাল শুক্রবার শীতের রাতের এ উৎসব হয়েছে বিশ্বের দীর্ঘতম কক্সবাজার সমুদ্রসৈকতের কলাতলী পয়েন্টের কাছে একটি রেস্তোরাঁয়। কক্সবাজারে অবস্থান করা বিদেশিদের জন্য এই উৎসবের আয়োজন করে ‘ইন্টু পজিটিভ’ নামে বেসরকারি একটি প্রতিষ্ঠানের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা সৈকত মজুমদার ও বাংলাদেশের সংগীতশিল্পী শামান্তা রহমান।
ভেন্যু পার্টনার ও প্যাসিফিক বিচ লাউঞ্জ ক্যাফের ব্যবস্থাপনা পরিচালক জাবেদ ইকবাল প্রথম আলোকে বলেন, সৈকত এলাকায় অনেক বিদেশি নিয়ে আনন্দঘন এমন আয়োজন অতীতে হয়নি। একটা সময় বিশ্বের এই দীর্ঘতম সমুদ্রসৈকতে বিদেশি পর্যটকে ভরপুর থাকত। নানা কারণে এখন আগের মতো বিদেশি পর্যটকের সাড়া মিলছে না। বিদেশিদের জন্য এমন আয়োজন, পরিবেশবান্ধব টেকসই পর্যটনে বিনিয়োগ, কক্সবাজার পর্যটনশিল্পের বিকাশ এবং বিদেশি পর্যটক টানতে বড় ভূমিকা রাখবে।
২০১৭ সালের ২৫ আগস্টের পর মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্য থেকে দেশটির সেনাবাহিনীর নির্যাতনের মুখে পালিয়ে আসে আট লাখ রোহিঙ্গা। উখিয়া ও টেকনাফের ৩৩টি আশ্রয়শিবিরে রোহিঙ্গাদের মাথা গোঁজার ঠাঁই হয়েছে। রোহিঙ্গা শরণার্থীদের মানবিক সেবায় যুক্ত হয় জাতিসংঘের উদ্বাস্তুবিষয়ক সংস্থা ইউএনএইচসিআর, আন্তর্জাতিক অভিবাসন সংস্থা আইওএম, বিশ্ব খাদ্য সংস্থা (ডব্লিউএফপি), ইউনিসেফসহ দেশি-বিদেশি অর্ধশতাধিক আন্তর্জাতিক ও দাতা সংস্থা। সংস্থাগুলোতে কর্মরত আছেন ছয় হাজারের দেশি-বিদেশি কর্মকর্তা-কর্মচারী। তাঁদের জন্য মূলত এই আড্ডা-গানের আয়োজন। ‘ইন্টু পজিটিভ’-এর প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা সৈকত মজুমদার বলেন, মাসে অন্তত একবার এ ধরনের আয়োজন দরকার।
আড্ডা-গানের এ উৎসবে জাতিসংঘের বিভিন্ন সংস্থার প্রধানসহ বাংলাদেশি কয়েকজন সরকারি কর্মকর্তা, জেলা প্রশাসনের কর্মকর্তা ও সাংবাদিক নেতারা অংশ নেন। সন্ধ্যা সাড়ে পাঁচটার আগে ক্যাফেতে হাজির হন বিদেশি কর্মকর্তা-কর্মচারীরা। এরপর শুরু হয় গান। পাঁচ-সাতজন করে দল বেঁধে খোলা মাঠের টেবিলে বসে বিদেশিরা আড্ডা-আলোচনায় অংশ নেন। সঙ্গে ছিল বাহারি খাবার।
অনুষ্ঠানে গান পরিবেশন করেন সংগীত শিল্পী আরমিন মুসা। সম্প্রতি গ্র্যামি পুরস্কারের জন্য মনোনীত একটি গানের অ্যালবামের অন্যতম শিল্পী তিনি। এটি বাংলাদেশের জন্য প্রথম গ্র্যামি মনোনয়ন। মনোনীত অ্যালবামে জাগো প্রিয়া নামে একটি গান গেয়েছেন আরমিন মুসা। গানটির গীতিকার, সুরকার ও মূল কণ্ঠশিল্পী তাঁর মা নাশিদ কামাল।
শুক্রবার রাত সাড়ে ১০টা পর্যন্ত উৎসবে নিজ নিজ দেশের ভাষায় গান পরিবেশন করেন বাংলাদেশের শিল্পী শামান্তা রহমান, বলিভিয়ার শিল্পী গ্রোভার, কেনিয়ার জিদেই, দক্ষিণ কোরিয়ার ক্য কে, সুইজারল্যান্ডের বাহিয়া। গানের মাধ্যমে বিদেশি দর্শক-শ্রোতাদের কয়েক ঘণ্টা মাতিয়ে রাখেন এই শিল্পীরা। করতালিও পান অজস্র।
উৎসবে প্রদর্শিত হয় নুজাত তাবাসসুমের চিত্রপ্রদর্শনী ‘দ্য ডিপ’। বাঁশ-বেত দিয়ে কচ্ছপ ভাস্কর্যটি তৈরি করেছেন কক্সবাজার আর্ট ক্লাবের সদস্যরা। ক্লাবের সাধারণ সম্পাদক রিয়াজুল কবির বলেন, সামুদ্রিক কচ্ছপ হাজার কিলোমিটার দূরের গভীর সাগর থেকে সৈকতের বালুচরে ডিম পাড়তে আসে শীতকালে। কিন্তু সাগরে মাছ ধরার জালে আটকা পড়ে শত শত মা কচ্ছপের মৃত্যু হচ্ছে। উপকূলের যত্রতত্র প্লাস্টিক বর্জ্য পড়ে থাকে। এসব খেয়ে কচ্ছপের মৃত্যু হচ্ছে। লোকজনকে সচেতন করতে কচ্ছপের ভাস্কর্যটি তৈরি করা হয়েছে, যা বিদেশিদের মনোযোগ আকর্ষণ করে।
সৈকতের দুই বর্গকিলোমিটার এলাকায় দুই দশকে পাঁচ শতাধিক হোটেল-মোটেল, গেস্টহাউস তৈরি হয়েছে জানিয়ে কক্সবাজার প্রেসক্লাবের সাধারণ সম্পাদক মোহাম্মদ মুজিবুল ইসলাম বলেন, বছরে অন্তত ৩০ লাখ পর্যটক সেখানে অতিথি হন। কিন্তু বিদেশিদের এক জায়গায় এনে কক্সবাজারকে তুলে ধরার এমন আয়োজন দারুণ ছিল।