একটি বজ্রবৃষ্টির বিকেল খোরশেদ আলীর নিয়তি চিরকালের জন্য পাল্টে দিল। ২০১৩ সালের মে মাসের সেই বিকেলে আকাশ কালো করে দিগন্ত ঢেকে দিয়ে মেঘ এল। শুরু হলো বিকট আওয়াজে একের পর এক বজ্রপাত। হঠাৎ কড়াৎ করে একটা বাজ এসে পড়ল চোখের সামনে। প্রচণ্ড শব্দে কেঁপে উঠল খোরশেদ আলীর পুরো বাড়ি। বাজ গিয়ে পড়ল বাড়ির সামনের উঁচু তালগাছের মাথায়। চোখের পলকে চিরে ছিন্নভিন্ন করে দিল গাছটা। নিজে বুক পেতে তালগাছটা যেন বাঁচিয়ে দিল খোরশেদ আলীর পুরো পরিবারকে।
সেদিনই নিয়ত করে ফেললেন খোরশেদ আলী। তালগাছ লাগাতে হবে গ্রামজুড়ে। বজ্রপাতের বর্ম হিসেবে। মানুষকে বাঁচাতে তালগাছের চেয়ে বড় রক্ষাকবচ আর নেই। খোরশেদ তালের বীজ জোগাড় করতে নেমে পড়লেন। তাল পেকে ওঠার ঋতুতে ঘুরতে থাকলেন মানুষের বাড়ি বাড়ি। সংগ্রহ করতে লাগলেন তালের আঁটি।
সংগ্রহ করতে লাগলেন আর সে বীজ পুঁতে দিতে লাগলেন গ্রাম্য পথের দুই ধারে। আঁটি লাগিয়েই তো কাজ শেষ হয় না। চলল পরিচর্যাও। খোরশেদ এভাবে ৯ বছর ধরে খ্যাপার মতো তালগাছ লাগিয়েই চলেছেন ঠাকুরগাঁও সদর ও বালিয়াডাঙ্গী উপজেলায়। হাজার হাজার তালগাছ এখন এলাকাজুড়ে খোরশেদের স্মারক।
খোরশেদের বাড়ি ঠাকুরগাঁও সদরের পাহাড়ভাঙা গ্রামে। লোকে ‘ডাক্তার’ হিসেবেই চেনে তাঁকে। লক্কড়ঝক্কড় একটা মোটরসাইকেল তাঁর মার্কা। দূর থেকে সেই মোটরসাইকেল দেখলেই সবাই বুঝত, খোরশেদ ছুটছেন। আগে ছুটতেন রোগীর চিকিৎসায়, এখন ছোটেন তালগাছের শুশ্রূষায়। সঙ্গে থাকে শাবল আর খুন্তি।
আশ্বিন আর কার্তিক তালের বীজ রোপণের সময়। এই দুই মাস তাই খোরশেদ আলীর ঘরে বসার ফুরসত নেই। একা তো এত কাজ সারা যায় না। জনা চারেক লোক রেখেছেন। তাঁদের দায়িত্ব বাড়ি বাড়ি ঘুরে তালের আঁটি জোগাড় করা। খোরশেদ তাঁদের কাছ থেকে এক-দুই টাকা দরে কিনে নেন সে আঁটি।
তালের আঁটি কেনা, রোপণ, যত্নআত্তি—এসবে ঝক্কি যেমন আছে, খরচাপাতিও কম নয়। কিন্তু খোরশেদ সব করেন নিজের টাকায়। লোকে বলে পাগলামি। পাগলামি বটে, এসব করতে গিয়ে জমি-জিরাতও খুইয়েছেন অনেক।
ঠাকুরগাঁও সদরের চিলারং, আখানগর, আকচা ও বালিয়াডাঙ্গীর দুওসুও ইউনিয়নের পথের দুই ধারে তালগাছের অন্ত নেই। প্রায় সবই খোরশেদ আলীর লাগানো। বাতাসে তালের পাতা দোলে। সেই পাতার সঙ্গে দোলে খোরশেদ আলীরও মনটা। দরদ বুক উথলে ওঠে তাঁর। গাছগুলো যেন তাঁর সন্তান, এতটাই মমতা অনুভব করেন তিনি।
সত্তরোর্ধ্ব মানুষটির মনে এত যে দরদ, মানুষের মনে সে দরদের ছিটেফোঁটাও ছিল না। জমির পাশে তালের আঁটি দেখলেই ক্ষিপ্ত হয়ে যেত অনেকে। তালের ছায়ায় ঢাকা পড়ে শীর্ণ হয়ে যাবে অন্য কচি গাছ, সে আশঙ্কায় রাস্তার ধারে আঁটি লাগাতে বাধা দিত তারা। আঁটি বা চারা যা-ই পেত উপড়ে ফেলত। আর শিশুরা সে আঁটি পেলে তুলে খেয়ে নিত ভেতরের শাঁস। এমন বৈরী পরিস্থিতিতে ভিন্ন পথে হাঁটলেন খোরশেদ আলী। বেরোতে শুরু করলেন রাতের বেলা; আঁধারে তালের আঁটি রোপণের অভিযানে।
শুরুর কথা বলতে গিয়ে খানিকটা স্মৃতি হাতড়ালেন খোরশেদ আলী। ২০১৪ সালের কথা। সেবার মোটরসাইকেলে চড়ে নিজেই হাজার পাঁচেক তালের আঁটি জোগাড় করেছিলেন। সেসব রোপণ করেছিলেন ঠাকুরগাঁও-বালিয়াডাঙ্গী আঞ্চলিক সড়কের দুই পাশে। তার পরের বছর আঁটি জোগাড়ের কাজ দিলেন আরও চারজন লোককে। সে বছর আরও পাঁচ হাজার তালের আঁটি লাগালেন ঠাকুরগাঁও সদরের পল্লী বিদ্যুৎ এলাকা থেকে রেলগুমটি পর্যন্ত সড়কজুড়ে।
খোরশেদ আলীর তালগাছ দেখতে গত ৩০ মে তাঁরই মার্কামারা মোটরসাইকেলে চড়ে ঘুরলাম ঠাকুরগাঁও সদর উপজেলার চিলারং ইউনিয়নের কয়েকটি সড়কে। পুরো দৃশ্যপট শাসন করছে সারি সারি তালগাছ। কোনোটা ছোট, কোনোটা বড়। রেলগুমটি থেকে চিলারং ইউনিয়ন পরিষদ কার্যালয়ের পাকা সড়কের দুই ধারে সেপাইয়ের মতো স্থির দাঁড়িয়ে ১৭৩টি তালগাছ। নানা বয়সী। পাঁচ ফুটের মতো উঁচু। বুড়ির বাঁধের দুই পাশে আঁটি থেকে সদ্য বেরোনো আরও ২৮৭টি তালের চারা।
আগের দিন সকালেই গিয়েছিলাম খোরশেদ আলীর খোঁজে, তাঁর বাড়িতে। তিনি নেই। তাঁর নাতনি কাসমিরা আকতার বলল, ‘দাদু তালগাছ-পাগল। ভোর ভোরই যন্ত্রপাতি নিয়ে বেরিয়ে যান তালগাছের পরিচর্যায়। আজও তা-ই গেছেন।’
খোরশেদ আলী কখন ফিরবেন, বলতে পারলেন না তাঁর স্ত্রী মর্জিনা বেগমও। বললেন, ‘উনার মাথা থাকিয়া তালগাছ লাগানোর ভূত বাইর হচেনি?’
সকাল সাড়ে ১০টার দিকে খোরশেদ আলীকে পাওয়া গেল মহাদেবপুর জলেশ্বরী বালিকা উচ্চবিদ্যালয়ের পাশের রাস্তায়। তালগাছের গোড়ার মাটি আলগা করছেন। এই বয়সে এত কষ্ট করার কারণ কী? একগাল হেসে সফেদ শ্মশ্রুমণ্ডিত লোকটি জানালেন, তিনি পত্রিকায় পড়েছেন, ২০২২ সালের এপ্রিল থেকে ২০২৩ সালের মে মাস পর্যন্ত নাকি বজ্রপাতে ৩৪০ জন মারা গেছেন। ১২টি শিশুও ছিল। বাজ পড়ে উঁচুতে। তাই তালগাছ থাকলে সেখানেই বজ্রপাত হয়। নিজের চোখেও সেটা দেখেছেন। তিনি বললেন, ‘তা ছাড়া গাছে তাল ধরলে তো মানুষ খেতে পারবে। পশুপাখি খাবে। তাই না?’
গত ৯ বছরে কতগুলো তালের আঁটি লাগিয়েছেন, জানতে চাইলে খোরশেদ আলী বলেন, ৫২ হাজার ৩০০টি। এর কি কোনো হিসাব আছে? এ প্রশ্নের উত্তরে তিনি একটি টালিখাতা বের করে দেখালেন। কোন বছর, কোথায়, কতটি তালের বীজ রোপণ করেছেন, সব সেখানে পরিষ্কার করে লেখা। টালিখাতায় দেখলাম, গত বছরের সেপ্টেম্বরে ২ হাজার ৬৫০টি তালের আঁটি লাগাতে আঁটি কেনা, মজুরি, ভ্যানভাড়া আর নাশতা বাবদ তাঁর খরচ হয়েছিল ৫ হাজার ২৮০ টাকা।
একেকটি তালের আঁটি কিনতে হয় ১ থেকে ২ টাকায়। পরিবহন, মজুরি, পরিচর্যা—সব মিলিয়ে প্রতি আঁটিতে খরচ হয় আরও ৭ থেকে ৮ টাকা। সে টাকা জোগাড় করতে বাপ-দাদার জমি বিক্রি করতে হয়েছে তাঁকে। কয়েক মাস আগে আবারও জমি বিক্রি করতে গেলে ছেলের বাধার মুখে পড়েন।
খোরশেদ আলীর ছেলে আবদুর রহমান বললেন, ‘বাবা তালগাছ লাগাক। আমরা এর বিপক্ষে তো না। কিন্তু জমি বিক্রি করা নিয়ে আমরা দুশ্চিন্তায় পড়ে গিয়েছিলাম। যখন দেখি তাঁকে থামানো যাচ্ছে না, তখন থানায় গিয়ে বলি।’
ছেলেদের কথা শুনে ঠাকুরগাঁও থানার তৎকালীন ওসি কামাল হোসেন তাঁকে ডেকে নিয়ে যান নিজের কার্যালয়ে। সব শুনে তিনি খোরশেদ আলীর হাতে ফুলের তোড়া তুলে তাঁকে সম্মান জানান। পরে বুঝিয়ে বলেন, তালের বীজ কেনার জন্য জমি বেচার দরকার নেই। স্থানীয় ইউপি চেয়ারম্যানের মধ্যস্ততায় তিনি তাঁর পৈতৃক ভিটা ছেলেমেয়েদের নামে লিখে দেন। ছেলেমেয়েরা বিনিময়ে মাসে ৬ হাজার টাকা দেন তাঁকে। সে টাকা দিয়েই এখন খোরশেদ তালের আঁটি লাগিয়ে চলেছেন।
মহাদেবপুর জলেশ্বরী বালিকা উচ্চবিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক মো. আসাদুজ্জামান বললেন, খোরশেদ আলীর মতো নিঃস্বার্থ মানুষ হয় না। পরিবারের আপত্তির বা গ্রামবাসীর উৎপাত—কোনো কিছুই তাঁকে তালগাছ লাগানোর পাগলামি দমন করতে পারেনি। ‘আমরা হিসাব করে দেখেছি, ছোট-বড় মিলিয়ে খোরশেদ আলীর লাগানো ২০ হাজারের মতো গাছ এখন টিকে আছে।’ বললেন আসাদুজ্জামান।
ঠাকুরগাঁওয়ের জেলা প্রশাসক মাহবুবুর রহমান বললেন, তালগাছগুলো একসময় খোরশেদ আলীর স্মৃতি হয়ে সবার মধ্যে বেঁচে থাকবে, এলাকার সম্পদ হয়ে উঠবে। তালের চারাগুলোর দেখাশোনা করতে সংশ্লিষ্ট ইউএনওদের বলা হয়েছে।
টালিখাতায় চোখ বোলাতে বোলাতে আবেগপ্রবণ হয়ে ওঠেন খোরশেদ আলী। খাতা বন্ধ করে বলেন, ‘আমি এক লাখ তালগাছ রেখে যেতে চাই। এ জন্য প্রতিবছর অন্তত ১০ হাজার তালের বীজ লাগানোর পরিকল্পনা নিয়েছি।’
খোরশেদ আলীর আবেগের মধ্যে মিশে থাকে গভীর মমতা—মানুষের প্রতি, প্রকৃতির প্রতি।